এবারের অমর একুশে বইমেলায় যে কয়েকটি বই নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে দেখা যাচ্ছে, সেগুলোরই একটি হচ্ছে ‘তিশার ভালোবাসা’।
বইটির লেখক খন্দকার মুশতাক আহমেদ, যিনি তার চেয়ে অনেক কম বয়সী এক তরুণীকে বিয়ের কারণে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে আলোচনায় এসেছেন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে খন্দকার মুশতাক আহমেদ ও তার স্ত্রী সিনথিয়া ইসলাম তিশাকে।
তাদের ঠিক পেছনেই একদল যুবককে “ভুয়া, ভুয়া” স্লোগান দিয়ে তিশা-মুশতাক দম্পতির দিকে এগিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।
ভিডিওতে এই দম্পতি নিয়ে বেশ কিছু তির্যক মন্তব্য ছুড়তেও দেখা গেছে তাদের।
ঘটনার পর থেকেই পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই নানান আলোচনা-সমালোচনা করছেন।
ঘটনার পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন তাদের যুক্তি হচ্ছে, তিশা-মুশতাক দম্পতি ‘অসম বিয়ে’কে উৎসাহিত করছেন।
অন্যদিকে, ঘটনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ব্যক্তিরা বলছেন, যুবকরা যেভাবে ওই দম্পতির ওপর চড়াও হয়েছেন, সেটি স্পষ্টতই ব্যক্তি এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ।
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ কিছুদিন আগে একই কলেজের শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলাম তিশাকে বিয়ে করে আলোচনায় আসেন।
‘তিশা এন্ড মুশতাক’ নামে আগেও একটি বই লিখেছেন মি. মুশতাক। এই দম্পতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ সক্রিয়।
‘তিশার ভালোবাসা’ বইটি ঘিরে এবছর মেলার শুরু থেকেই বেশ আলোচনায় ছিলেন তিশা-মুশতাক দম্পতি।
গত নয়ই ফেব্রুয়ারি বিকেলে তারা প্রথমবার মেলায় আসেন।
কিন্তু সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল?
সেদিনের ঘটনা, যা জানা যাচ্ছে
স্ত্রী সিনথিয়া ইসলাম তিশাকে নিয়ে গত শুক্রবার বিকেলে বইমেলায় যান খন্দকার মুশতাক আহমেদ।
এরপর সেখানে যে ঘটনা ঘটেছে, তার একটি বর্ণনা বিবিসি বাংলাকে দিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও মিজান পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান।
মি. রহমান জানান, বেলা তিনটার দিকে তিশা-মুশতাক দম্পতি তাদের প্যাভেলিয়নে আসেন। এরপর প্রায় দুই ঘণ্টা তারা সেখানে ছিলেন।
এই সময়ের মধ্যে মেলায় আগত দর্শনার্থীদের অনেকেই তিশা-মুশতাক দম্পতিকে দেখতে প্যাভেলিয়নের সামনে ভিড় করতে থাকেন।
ছবি তোলার পাশাপাশি তারা বইয়ে অটোগ্রাফও নিচ্ছিলেন। ফলে ‘তিশার ভালোবাসা’ বইটির বেশকিছু কপিও এ সময় বিক্রি হয়।
কিন্তু ভিড় বেড়ে যাওয়ায় আশপাশের বইয়ের প্যাভেলিয়ন থেকে অভিযোগ আসতে থাকে। ফলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন তিশা-মুশতাক দম্পতি।
কিন্তু উপচে পড়া ভিড়ের কারণে তারা বের হতে পারছিলেন না।
এ অবস্থায় দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা তাদেরকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন।
কিন্তু মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে বের হবার সময় একদল যুবক হঠাৎ-ই পেছন থেকে “ভুয়া, ভুয়া” বলে চিৎকার করতে থাকে।
তিশা-মুশতাক দম্পতিকে লক্ষ্য করে বেশ কিছু নেতিবাচক মন্তব্যও করতে দেখা যায় তাদের।
এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
সেখানে দেখা যাচ্ছে, যুবক দলের মিছিল এবং উৎসুক জনতার ঠেলাঠেলির মধ্যে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই মেলাপ্রাঙ্গণ ছাড়ছেন তিশা-মুশতাক দম্পতি।
ভিডিওতে এটাও দেখা গিয়েছে যে, যুবকদের কয়েকজন ‘তিশার ভালোবাসা’ বইটি কিনে এনে ছিড়ে ফেলছেন।
ঘটনার পর এই দম্পতি স্থানীয় বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের সাথেও কথা বলেছেন। সেখানেও তারা ঘটনার একই বর্ণনা দিয়েছেন।
“সবকিছু ঠিক-ঠাকই ছিল। এরপর আমরা যখন বের হয়ে আসছিলাম, তখন ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী কিছু ছেলে “ভুয়া ভুয়া” বলে চিৎকার শুরু করে” বলেছিলেন মিজ তিশা।
এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “না পড়েই তারা কীভাবে বইটিকে ভুয়া বলে? একটি বই, সেটি যত নিম্নমানেরই হোক না কেন, সেটি তারা ছিড়ে ফেলে? এ ঘটনায় আমরা কষ্ট পেয়েছি।”
পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক
এই ঘটনা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
তিশা-মুশতাক দম্পতি বই মেলায় এসে যেভাবে ‘আক্রোশের’ শিকার হয়েছেন, সেটির বিরুদ্ধে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
সঞ্জয় দে নামের একজন ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “একজন মানুষ, আরেকজন মানুষের সম্মতির ভিত্তিতে যদি কোনো জীবন গড়ে তোলেন, সেখানে পাহারাদারি করার এখতিয়ার অন্য মানুষ হিসেবে আমাদের নেই।”
তিনি আরও বলেন, “ওই বইয়ে কী আছে, লেখার মান কেমন- এসবের চেয়ে আমার কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বকপূর্ণ, বইটির লেখক বইটি লেখার কারণে একদল নৈতিক মাস্তানের হাতে প্রকাশ্যে স্ত্রীসহ নিগৃহীত হয়েছেন।”
শাখাওয়াত হোসেন নামের একজন বলছেন, “তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, এরা দু’জন অসম বয়সী বিয়ে করে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে আহত করেছেন।”
“কিন্তু আমাদের আশপাশে প্রচুর লোক আছে, যারা অনৈতিক উপায়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছেন, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদী মনোভাব পোষণ করি?” বলেন তিনি।
অন্যদিকে, তিশা-মুশতাক দম্পতিকে যারা অপমান করতে চেয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে তাদের পক্ষেও অনেকে অবস্থান নিচ্ছেন।
জাকির হোসেন নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, “এটা কোন সহজ স্বাভাবিক ভালবাসার বিয়ে ছিল না। পরিস্থিতির চাপে সমঝোতা ছিল।”
“ভাইরাল ট্রেন্ডে থাকতে থাকতে গিয়ে তারা পুরো যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করতে নেমেছে। এতে যদি পাঁচটা মেয়েও ভুল পথে পা বাড়ায়, তার দায় কি আপনি নিবেন?” বলেন তিনি।
শফিকুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন, “সমাজ-রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এটাকে অনুৎসাহিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় বন্ধন ভেঙে পড়বে। …..তাই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই মুশতাক-তিশাদের থামানো এবং মেন্টাল কাউন্সিলিং জরুরি।”
কী বলছে বাংলা একাডেমি?
তিশা-মুশতাক দম্পতির সাথে গত নয়ই ফেব্রুয়ারি বইমেলায় যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেটিকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ এবং ‘দুঃখজনক’ বলেই মনে করছে বাংলা একাডেমি।
“এটি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক ঘটনা। খবর পাওয়ার পরপরই আমাদের লোকজন ঘটনাস্থলে যান এবং নিরাপদে তাদেরকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসেন” বিবিসি বাংলাকে বলেন সচিব ড. মো. হাসান কবীর।
তবে কারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে, সেটি এখনও শনাক্ত করতে পারেনি বাংলা একাডেমি।
“বিক্ষুব্ধ একদল মানুষ ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে আমরা জেনেনি। তবে লিখিত অভিযোগ না পাওয়ায় কাউকে শনাক্ত করা বা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি” বিবিসি বাংলাকে জানান মি. কবীর।
ঘটনার পর মি. মুশতাকের সাথে যোগাযোগ হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি। পরবর্তীতে মেলায় আসার আগে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আসার পরামর্শ দিওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
“এটি বলা হয়েছে, যাতে আগে থেকেই আমরা উনার নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নিতে পারি” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. কবীর।
এদিকে, ঘটনার পর দর্শনার্থীদের অনেকেই মেলাপ্রাঙ্গণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ বিষয়ে আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য কী?
“এই ঘটনা ধরে মেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ নেই। কারণ নিরাপত্তাকর্মীরাই তাদেরকে নিরাপদে মেলাপ্রাঙ্গণ ছাড়তে সহায়তা করেছেন”, বিবিসি বাংলাকে বলেন অমর একুশে বইমেলার এবারের আয়োজনের সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম।
তবে এ ধরনের ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে খুব শিগগিরই লেখক, প্রশাসক ও আয়োজকরা আবারও বৈঠকে বসবেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন মি. ইসলাম।
সমাজবিজ্ঞানীরা যা বলছেন
বইমেলায় যে ঘটনা ঘটেছে, সেটিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকি বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
“দু’জন প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষ নিজেররা বিয়ে করে সংসার করছেন। এটা নিয়ে তাদেরকে অপমান করা কিংবা তাদের বই ছিড়ে ফেলার অর্থ তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা”, বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরিন।
একই কথা বলছেন আরেক সমাজবিজ্ঞানী সানজিদা নীরা।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কোন বই নিয়ে কারও আপত্তি থাকলে সংযত উপায়ে সেটার গঠনমূলক সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু সেটি না করে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমনাত্মক হওয়া কোন সভ্য সমাজের কাজ হতে পারেনা।”
এ ঘটনায় বাংলা একাডেমিরও দায় রয়েছে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ।
“আয়োজক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের উচিৎ ছিল একজন লেখকের সম্মান রক্ষা করা, যেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। কাজেই এই দায় তারা এড়াতে পারে না”, বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরিন।
ইতিহাস বিকৃতি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাজনৈতিক বিতর্ক বা অশ্লীলতা – এমন সব কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশে অতীতেও বিভিন্ন সময় বই নিষিদ্ধ করা, এমনকি লেখকদের উপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে।
এমনকি অমর একুশে বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিকেও বিভিন্ন সময় ‘বিতর্কিত’ বই প্রকাশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
‘বিতর্কিত’ বই প্রকাশ করায় ২০২৩ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণে বাধার মুখে পড়েছিল প্রকাশনা সংস্থা আদর্শ।
এবছর এখন পর্যন্ত সে ধরনের কিছু দেখা না গেলেও তিশা-মুশতাক দম্পতির সাথে যা ঘটেছে, সেটি নিয়েও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসছে।
এছাড়া ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক গল্প থাকায় সম্প্রতি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককেও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলতে দেখা গেছে।
“বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিকভাবে অস্থির একটি সময় পার করছে, যার প্রভাব মানুষের সমাজ জীবনেও পড়ছে। ফলে মানুষ ক্রমশই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, মোরাল পুলিশিং করছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরিন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাল দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলেও মনে করছেন মিজ নাসরিন।