আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে ঋণের তৃতীয় কিস্তির বিষয়ে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতায় পৌঁছেছে। তবে ঢাকায় আসা কর্মকর্তারা যে পর্যালোচনা করেছেন সেটি সংস্থাটির নির্বাহী বোর্ডে অনুমোদন পেতে হবে।
একই সাথে সংস্থাটি ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে অগ্রাধিকার দেয়া এবং ২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে বাস্তব সম্মত কর নীতি প্রণয়নের রাজস্ব বাড়িয়ে কর-জিডিপির অনুপাত .৫ শতাংশ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে।
আইএমএফ’র নির্বাহী বোর্ড অনুমোদন করলে চলতি মাসের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ ঋণের পরবর্তী কিস্তিতে ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার আশা করছে। এর আগে ৪৭০ কোটি ডলারের মোট ঋণ চুক্তির অংশ হিসেবে দুই কিস্তিতে ১১৫ কোটি ৮২ লাখ ডলার ঋণ ছাড় করেছে সংস্থাটি।
“বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ক্রলিং পেগ পদ্ধতি, বিনিময় হার নির্ধারণসহ কিছু সংস্কার এবং সুদ হার পূর্ণ উদারীকরণের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে আইএমএফ সমর্থিত সংস্কার কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে,” এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে সংস্থাটি।
গত চব্বিশে এপ্রিল ঢাকা সফরে আসা আইএমএফের ডেভেলপমেন্ট মাইক্রো ইকোনমিক্স ডিভিশনের প্রধান ক্রিস পাপাগেওর্জিউর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে।
এসব বৈঠক সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পর্যালোচনা শেষে মঙ্গলবার অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সার্বিকভাবে তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আশ্বাসের পাশাপাশি সংশোধিত কিছু শর্তসহ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন তারা।
আজ সন্ধ্যায় ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি আকারে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করেছে আইএমএফ।
আইএমএফ আরও যা বললো
সংস্থাটি বলছে যেসব নীতিগত বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া সম্পন্ন করতে হবে সেগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের কর্মকর্তা পর্যায়ে একটি সমঝোতা হয়েছে।
আইএমএফ সমর্থিত কর্মসূচির আওতায় কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে আছে জ্বালানি খাতে মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা।
তবে এ সত্ত্বেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা, পণ্য ও খাদ্যের আন্তর্জাতিক দাম বৃদ্ধি, কিছু অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত আছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, যা অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিময় হারের বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ এবং একই সাথে ক্রলিং পেগ সিস্টেম চালুর কথা উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। বাইরের বা মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ বাড়লে কর্তৃপক্ষকে আরও শক্ত নীতি নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে তারা।
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে বলে উল্লেখ করে তারা বলছে ২০২৫ অর্থবছরে এটি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
চলতি বছরে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ দশমিক ৪ শতাংশ থাকবে তবে আগামী অর্থবছরে এটি কমে সাত দশমিক দুই শতাংশ হতে পারে বলে সংস্থাটি তাদের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে।
“ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি কমানো একটি অগ্রাধিকার। নন পারফর্মিং লোন কমিয়ে আনার কৌশল আর্থিক অগ্রগতিকে সহায়তা করবে যা দেশের অর্থনীতির জন্য দরকার। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংককে আর্থিক খাতের সক্ষমতা বাড়াতে নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে,” বলেছে আইএমএফ।
একই সাথে তারা বলেছে যে বাংলাদেশে কর ও জিডিপির অনুপাত খুবই কম এবং এটি বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক কল্যাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমে বিনিয়োগ বাড়াতে টেকসই রাজস্ব প্রবৃদ্ধিতেও অগ্রাধিকার দেয়ার দরকার। এজন্য আগামী বাজেটে বাস্তব কর নীতি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দিয়েছে তারা।
সংস্থাটি মনে করে, ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতি হওয়ার ক্ষেত্রে সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, বিনিয়োগের পরিবেশ ও সুশাসনের মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে।
একই সাথে তারা মনে করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার চেষ্টার পাশাপাশি সরকারের উচিত জলবায়ু প্রতিক্রিয়া ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও গ্রিন অবকাঠামো বিনিয়োগে জোর দেয়া।
আইএমএফ’র বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে অর্থ মন্ত্রণালয় বা সরকারের দিক থেকে এখনো কোনো বক্তব্য আসেনি।
ঋণ ও শর্ত
আইএমএফ যখনই বাংলাদেশকে কোনো ঋণ দিয়েছে তখনই তারা কিছু শর্ত বা পরামর্শ দিয়েছে। এসব শর্তের কিছু বাংলাদেশে মেনে নিয়েছে আবার কিছু মেনে নেয়নি।
ঋণের ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে আইএমএফ এর বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। সেসব শর্তের আলোকে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর চালু করা হয়।
এছাড়া বাণিজ্য উদারীকরণ, ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের শর্তও এসেছিল। এসব প্রক্রিয়ার সাথে বিশ্বব্যাংকও জড়িত ছিল।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আইএমএফ এর কাছ থেকে কোনো ঋণ নেয়নি।
এরপর বাংলাদেশ আবার আইএমএফ’র কাছে থেকে ঋণ নেয় ২০০৩ সালে।
সেবার বড় শর্ত ছিল, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনতে হবে। তখন আইএমএফ এর শর্ত মেনে আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার।
এরপর ২০১২ সালে ঋণ নেয় বাংলাদেশ, যার পরিমাণ ছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের অনুমোদন দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ।
আইএমএফ জানিয়েছে, মোট সাত কিস্তিতে এই ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদ হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
তবে ঋণ পেতে বরাবরের মতোই বেশ কিছু সংস্কারের শর্ত আছে আইএমএফ’র।
যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি কমানো, টাকার বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া, রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার, কর আদায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক মুদ্রানীতি তৈরি করা, আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করা এবং নজরদারি বাড়ানো ইত্যাদি।
এসব বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই নিয়েছে সরকার।