ছবির উৎস, EPA-EFE/REX/Shutterstock
ঘটনাস্থলে পড়ে আছে হামলাকারীদের ফেলে যাওয়া একটি রাইফেল
রাজধানী মস্কোর ক্রোকাস সিটি কনসার্ট হলে এই হামলাটিকে গত ২০ বছরের মধ্যে রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় হামলা বলেই মনে করা হচ্ছে। যে হামলায় এখন পর্যন্ত ১৩৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এই হামলার পর দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি-গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস-কে।
কারা এই আইএস-কে? কেন তারা হঠাৎ করে রাশিয়ার একটি কনসার্ট হলে হামলা চালালো?
ইসলামিক স্টেট বা আইএস বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে আস্তে আস্তে। এই গোষ্ঠীটির বিভিন্ন শাখা রয়েছে যাদের বিভিন্ন নামে পরিচিতি রয়েছে।
রাশিয়ার মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে হামলার পরপরই এর দায় স্বীকার করে আইএস। তবে এই হামলায় আইএস’র কোন গোষ্ঠীটি জড়িত সেটি তারা নিশ্চিত করেনি।
বিশ্বের কোথাও বড় কোন সন্ত্রাসী হামলার পরপরই এর দায় স্বীকার করে নেয়া আইএস’র অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর এর সবই ঘটে থাকে আমাক নিউজ এজেন্সি নামে একটি সংবাদ সংস্থার তথ্য থেকে।
কারণ আইএস’এর দায় স্বীকার এবং সব ধরনের হুমকির বিষয়গুলো প্রকাশ করে থাকে আমাক নিউজ এজেন্সি।
রাশিয়ায় কনসার্ট হলে হামলার পরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শুক্রবার রাতেই হামলার ঘটনায় এই আমাক এর মাধ্যমে দায় স্বীকার করে আইএস। তবে তাদের কোন শাখা হামলা চালিয়েছে সে সম্পর্কে কোন তথ্য প্রকাশ করে নি।
তবে, হামলার দায় স্বীকার করার পর ইসলামিক স্টেট-খোরাসান বা আইএস-কে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রয়টার্স। সেখানে গোষ্ঠীটির উত্থান ও মস্কোয় হামলার কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ছবির উৎস, EPA-EFE/REX/Shutterstock
হামলার পর ঘটনাস্থল থেকে রাশিয়ান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিপুল পরিমান গুলি উদ্ধার করে
‘আইএস-কে’ কারা?
আইএস’র এই শাখা সংগঠনটির পুরো নাম পুরো নাম ইসলামিক স্টেট-খোরাসান। সংক্ষেপে যা আইএস-কে। ইরান, তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত খোরাসান অঞ্চলে (পুরনো নাম) সক্রিয় রয়েছে সংগঠনটি।
মূলত ২০১৪ সালের শেষের দিকে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সংগঠনটির উত্থান। চূড়ান্ত পর্যায়ের নৃশংসতা দেখিয়ে কম সময়েই বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে গোষ্ঠীটি। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে তাদের সদস্য সংখ্যা কমে এসেছে।
প্রায়ই আফগানিস্তানে তাদের হামলার খবর পাওয়া যায়। ঐসব হামলায় সাথে ইসলামিক স্টেট-খোরাসানের নাম প্রায়ই উঠে আসে।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর কাউন্টার টেররিজমের মতে, মূল সংস্থা থেকে তহবিল সরবরাহ কমে আসার ফলে আইএস-কের সদস্য সংখ্যা কমতে থাকে।
২০২১ সালে আফগানিস্তানে আশরাফ গনি সরকার হটিয়ে ক্ষমতায় আসে তালেবান গোষ্ঠী । সেই সময় দেশটিতে মোতায়েন মার্কিন বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটানোর পেছনে এই আইএস-কের হাত রয়েছে বলে খবরে জানিয়েছে রয়টার্স।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ইরানে জোড়া বোমা হামলায় প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হয়। ধারণা করা হয় ওই হামলায় আইএসের এই শাখাটি দায়ী। এদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কাবুলে রাশিয়ার দূতাবাসে হামলা ও ২০২১ সালে কাবুলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলা।
ছবির উৎস, Getty Images
২০২০ সালে আফগান বাহিনীর হাতে আটক আইএসকেপি’র কয়েকজন সদস্য।
রাশিয়ায় হামলা কেন?
শুক্রবার রাতে রাজধানী মস্কোয় কনসার্ট হলে ভয়াবহ হামলা চালায় আইএস। এই হামলার পরই প্রশ্ন উঠেছে আইএস কেন রাশিয়াকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলো।
এ নিয়ে নানা রকম মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে বিশ্লেষকদের কাছ থেকে। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি তাদের সহিংস কর্মকাণ্ড নাটকীয়ভাবে বাড়িয়েছে। যার একটি এই রাশিয়া।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গোষ্ঠীটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরোধিতা করে আসছিল। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সোফান সেন্টারের কলিন ক্লার্ক বলেন, “দুই বছর ধরেই রাশিয়াকে টার্গেট করেছিলো আইএস কে। এই সংগঠনটি তাদের প্রচার প্রচারণায় বিভিন্ন সময় টার্গেট করে রাশিয়ার সমালোচনা করতে শুরু করেছিলো।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, মুসলিম বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন কারণে আইএস’র টার্গেটে পরিণত হয়েছে রাশিয়া।
ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের গবেষক মাইকেল কুগেলম্যান রয়টার্সকে জানিয়েছে, “রাশিয়াকে নিয়মিতভাবে মুসলিমবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকা দেশ হিসেবে দেখে থাকে আইএস’।
যে কারণে দেশটি এই হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন কুগেলম্যান।
ছবির উৎস, Getty Images
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে একটি ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে অভিহিত করে নিন্দা জানিয়েছে।
আগেই সতর্ক করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র
শুক্রবার মস্কোর শহরতলির ৬২০০ আসনের ক্রোকাস সিটি হলে রক দল ‘পিকনিক’এর কানসার্ট শুরুর ঠিক আগে বন্দুকধারীরা বেসামরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। হলটি তখন কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো।
২০০৪ সালে বেসলান স্কুলে হামলার ঘটনার পর থেকে এটিই রাশিয়ায় হওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা।
মস্কোতে কোনো বড় জনসমাগমস্থলে হামলা হতে পারে, তা এ মাসের শুরুর দিকেই রাশিয়াকে জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই সতর্ক বার্তাকে ‘মিথ্যা প্রচারণা’ বলে উড়িয়ে দেয় ক্রেমলিন।
গত ৭ মার্চ রাশিয়ায় মার্কিন দূতাবাস একটি নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করে। সতর্কবার্তায় বলা হয়, মস্কোয় বড় জমায়েতে উগ্রপন্থিদের হামলার পরিকল্পনার খবর জানা গেছে। এ সতর্কবার্তায় বড় জমায়েতের মধ্যে কনসার্টের কথাও বলা হয়েছিল।
সেই সঙ্গে সতর্কবার্তায় মস্কোয় অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের ৪৮ ঘণ্টার জন্য বড় জমায়েত এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া এক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, আইএস-কে শিগগিরই বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র আদ্রিয়েন ওয়াটসন বলেন, মস্কোতে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা হচ্ছে, বিশেষ করে কনসার্টসহ কোনো জনসমাগমস্থলে, এমন তথ্য মাসের শুরুর দিকেই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এসেছিল।
ওই সময় রাশিয়ায় থাকায় নাগরিকদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তা আমলেই নেয় নি রাশিয়া।
বিশ্লেষকদের মতে, আইএস-কে এর ক্ষমতা বেড়ে চলেছে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরেও তারা হামলা চালানোর মত শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
ছবির উৎস, REUTERS
মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে হামলার পর উদ্ধার কাজ চালানো হচ্ছে।
ইউক্রেনকে কেন অভিযুক্ত করা হচ্ছে?
রাশিয়ায় হামলাকারীদের সাথে সাথে ইউক্রেনের যোগাযোগ ছিলো বলে দাবি করেছে রাশিয়ার সিকিউরিটি সার্ভিস।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বার্তা সংস্থা রিয়া নোভোস্টি বলছে, রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থা তাদেরকে জানিয়েছে যে ‘শনিবার সকালে হামলাকারীদের ব্রায়ানস্ক অঞ্চলে আটক করা হয়েছিল। ঐ সময় তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউক্রেন পার হতে চেয়েছিল এবং ইউক্রেনের পক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছিল’।
এই হামলার সাথে ইউক্রেনের সংশ্লিষ্টতা যে খোঁজা হবে সেটি আগে থেকেই ভালোভাবে ধারণা করা যাচ্ছিলো। পরবর্তীতে রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থার দাবি সেই বিষয়টিই প্রমাণ করে। যদিও এই দাবি করার বিষয়টির সতত্যা যাচাই করা বেশ কঠিন।
শুক্রবার রাতে হামলার খবরটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলনোস্কির উপদেষ্টা মাইখাইলো পোডোলিয়াক স্পষ্টভাবে ইউক্রেনের জড়িত থাকার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন।
তিনি তখন বলেছিলেন যে ‘তার দেশের এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কোন সুযোগ নেই’।
এর আগে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত চলছে এই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ।
ছবির উৎস, Reuters
ক্রোকাস সিটি হলে আহতদের খুঁজছে উদ্ধার কর্মীরা
সীমান্ত পাড়ি দিতে চেয়েছিলো হামলাকারীরা?
কিয়েভে বিবিসির পূর্ব ইউরোপের সংবাদদাতা জানিয়েছেন হামলার পর হামলাকারীরা ইউক্রেন সীমান্ত পাড়ি দিতে চেয়েছিলো বলে রাশিয়া দাবি করলেও ওই দাবিকে পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছে ইউক্রেন।
রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) একটি বিবৃতি জারি করে দাবি করেছে যে, মস্কো ক্রোকাস সিটি হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীরা ইউক্রেনের সীমান্ত অতিক্রম করার পরিকল্পনা করছিল এবং ইউক্রেনের দিকে তাদের “যোগাযোগ” ছিল। .
তাৎক্ষণিকভাবে ইউক্রেন এই অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করেছে।
ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মুখপাত্র আন্দ্রি ইউসভ বিবিসিকে বলেছেন যে, ইউক্রেনের সাথে সীমান্ত এলাকা সামরিক বাহিনীতে পরিপূর্ণ। এছাড়াও বেলগ্রেড অঞ্চল এবং কুরস্কের সাম্প্রতিক ঘটনার কারণে সেখানেও সামরিক তৎপরতা রয়েছে। এসব সীমানা তাদের জন্য একটা ফ্রন্টলাইন।
‘সন্দেহভাজনরা ইউক্রেনে যাচ্ছিল বলে বক্তব্য প্রচার করাটা এক ধরনের বোকামি বলেও মন্তব্য করেন ইউসভ।
তিনি বলেন, গত রাতে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দারা দাবি করেছে যে পুরো আক্রমণটি মস্কোর একটি পরিকল্পিত অপারেশন ছিল। যাতে ইউক্রেনকে দোষারোপ করা যায় এবং যুদ্ধকে বাড়িয়ে তোলার জন্যই এটা করা হতে পারে।
ছবির উৎস, EPA
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
হামলাকারীরা ছাড় পাবে না: পুতিন
মস্কোর ক্রোকাস সিটি কনসার্ট হলের হামলার পরদিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
সেখানে তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ”আমাদের শত্রুরা আমাদের বিভক্ত করতে চায়। যারাই এই হামলার সাথে জড়িত তারা ছাড় পাবে না।”
হামলায় নিহতদের স্মরণে আগামীকাল রোববার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট।
ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, লাকারীরা ইউক্রেনের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এর ফলশ্রুতিতে ওইদিকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।”
তিনি আরও জানান, প্রাথমিক তদন্ত শেষে তারা জানতে পেরেছেন হামলাকারীদের সীমান্ত পার করে দিতে ইউক্রেনে একটি দল কাজ করছিল।
রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ”এ হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল চার বন্দুকধারী। সব হামলাকারীকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করা হয়েছে।”
ভয়াবহ এ হামলাকে ‘বর্বর ও সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেন মি. পুতিন।
হামলার পরপরই নিরাপত্তা বাহিনীর যেসব সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া ও যারা আহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।