উম্মে হুজাইফা জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রয়াত নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির প্রথম স্ত্রী। যখন তাকে বিয়ে করেন আবু বকর আল-বাগদাদি, সে সময় সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল এলাকায় আইএস-এর নিষ্ঠুর শাসনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি।
এই মুহূর্তে ইরাকের এক জেলে বন্দি রয়েছেন উম্মে হুজাইফা। সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তার বিচার চলছে।
জেলে থাকা অবস্থাতেই এক বিরল সাক্ষাৎকারে তার জীবনের কথা বিবিসিকে জানিয়েছেন।
সময়টা ২০১৪ সালের গ্রীষ্মকাল। স্বামী আবু বকর আল-বাগদাদির সাথে সিরিয়ার রাক্কায় বাস করছিলেন তিনি। ওই শহর ইসলামিক স্টেটের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এক চরমপন্থী সংগঠনের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ নেতা হওয়ায় নিরাপত্তার কারণে ঘন ঘন বাসা বদল করতে হতো আবু বকর আল-বাগদাদিকে।
একদিন তিনি তার দুই ছেলেকে নিয়ে আসার জন্য তার দেহরক্ষীকে বাড়িতে পাঠান।
সে কথা বলতে গিয়ে উম্মে হুজাইফা বিবিসিকে জানিয়েছেন, “ওরা আমায় বলেছিল বেড়াতে যাচ্ছে। সেখানে বাচ্চাদের সাঁতার শেখাবে।”
বাড়িতে একটা টেলিভিশন সেট ছিল, যেটা মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন উম্মে হুজাইফা।
“ও (আবু বকর আল-বাগদাদি) যখন বাড়িতে থাকত না , তখন আমি টিভি দেখতাম,” তিনি বলেন। আইএস নেতা জানতেন ওই টেলিভিশন সেটটা খারাপ হয়ে গিয়েছে, চলে না।
উম্মে হুজাইফাকে বাস্তব জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন তার স্বামী। তাকে টিভি দেখতে দিতেন না। ২০০৭ সাল থেকে মোবাইল ফোনসহ কোনোও রকম প্রযুক্তি ব্যবহারও করতে দেওয়া হতো না তাকে।
আবু বকর আল-বাগদাদির দেহরক্ষীরা সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পর টিভি চালু করেন তিনি।
টিভিতে তার স্বামীকে দেখে একেবারে ‘হতচকিত’ হয়ে যান। তিনি দেখেন ইরাকের মসুল শহরের নুরি মসজিদে বক্তৃতা দিচ্ছেন তার স্বামী। যেখানে প্রথমবার নিজেকে তথাকথিত ইসলামি খিলাফতের প্রধান হিসেবে পরিচয় দেন আবু বকর আল-বাগদাদি।
এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে তার (আবু বকর আল-বাগদাদির) যোদ্ধারা ওই অঞ্চল তাদের কব্জায় নিয়েছিল।
আদালতে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের দায়ের করা মামলা
বহু বছর পর এই ভিডিওতে আবু বকর আল বাগদাদিকে প্রথমবার জনসমক্ষে দেখা গিয়েছে। তার মুখে লম্বা দাড়ি, গায়ে কালো আলখাল্লা। মুসলিমদের কাছে তিনি আনুগত্যের দাবি জানাচ্ছেন।
এই ভিডিও সারা বিশ্বে দেখা গেছে। সে সময় ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
উম্মে হুজাইফা জানিয়েছেন কীভাবে তিনি এটা দেখে অবাক হয়েছিলেন যে, তার দুই ছেলে ফোরাত নদীতে সাঁতার না শিখে তাদের বাবার সঙ্গে মসুলে গিয়ে পৌঁছেছে।
বাগদাদের একটি জনাকীর্ণ কারাগারে বন্দি এই নারী একেএকে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে চলেন। আইএস সংগঠনে এবং তাদের অপরাধমূলক কাজে উম্মে হুজাইফার কী ভূমিকা ছিল তা খতিয়ে দেখছেন ইরাকের কর্মকর্তারা।
শোরগোলে ঠাঁসা এই কারাগারে মাদক সেবন, যৌনকর্মসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্তদের রাখা হয়। বাইরে থেকে তাদের জন্য খাবার ও পানীয় আসে।
জেলের লাইব্রেরিতে একটি শান্ত জায়গা খুঁজে আমরা উম্মে হুজাইফার সাথে প্রায় দু’ঘণ্টা কথা বলেছি।
বিবিসির সঙ্গে কথোপকথনের সময়, একজন ‘ভুক্তভুগী’ হিসাবে নিজের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেন উম্মে হুজাইফা। তার দাবি স্বামীর কাছ থেকে একাধিকবার পালানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। একইসঙ্গে জানিয়েছিলেন তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের সহিংস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার কোনওরকম যোগ নেই।
কিন্তু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের দায়ের করা মামলায় উম্মে হুজাইফার যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে এই দাবির কোনও মিল নেই।
ইয়াজিদি নারীদের অভিযোগ ইসলামিক স্টেটের সদস্যরা তাদের অপহরণ এবং ধর্ষণ করেছে। নারী ও অল্প বয়সী মেয়েদের দিয়ে যৌন দাসত্ব করানোর ঘটনায় উম্মে হুজাইফা জড়িত ছিলেন বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে।
বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় একবারের জন্যও মাথা তোলেননি উম্মে হুজাইফা। কালো পোশাকে তার সর্বাঙ্গ ঢাকা, শুধুমাত্র নাকের নিচ থেকে কিছুটা দেখা যায়।
১৯৭৬ সালে ইরাকের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই নারী। ১৯৯৯ সালে ইব্রাহিম আওয়াদ আল-বদরি (আবু বকর আল-বাগদাদি) কে বিয়ে করেন।
হেফাজতে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ
উম্মে হুজাইফা জানিয়েছেন তার স্বামী বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরিয়া অর্থাৎ ইসলামি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।
সে সময় তার স্বামী কেমন ছিলেন সে কথাও জানিয়েছেন। তার কথায়, “অবশ্যই ধার্মিক ছিল, তবে চরমপন্থী ছিল না। রক্ষণশীল হলেও মন উন্মুক্ত ছিল।”
এরপর ২০০৪ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের পর মার্কিন সামরিক বাহিনী আবু বকর আল-বাগদাদিকে আটক করে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর আটক কেন্দ্র ‘ক্যাম্প বুকা’য় প্রায় এক বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল তাকে।
ক্যাম্প বুকায় এমন অনেক ব্যক্তি ছিলেন যারা পরে আইএস এবং অন্যান্য জিহাদি গোষ্ঠীর উঁচু পদ গ্রহণ করেন।
উম্মে হুজাইফার দাবি, ওই ডিটেনশন সেন্টার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার স্বামী বদলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “অল্পতেই রেগে যেত এবং রাগের বহিঃপ্রকাশও করত।”
আবু বকর আল-বাগদাদিকে যারা চেনেন তাদের দাবি ক্যাম্প বুকায় যাওয়ার আগে থেকেই আল-কায়েদার অংশ ছিলেন তিনি। যদিও তার স্ত্রীর মনে করেন, ক্যাম্প বুকা ছিল আবু বকর আল-বাগদাদির জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এরপরই তিনি আরও বেশি চরমপন্থী হয়ে ওঠেন।
উম্মে হুজাইফা বলেন, “ও (আবু বকর আল-বাগদাদি) মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছিল।”
তবে সমস্যার কারণ জিজ্ঞাসা করলে স্ত্রীকে আবু বকর আল-বাগদাদি বলেন, “আমায় এমন কিছু জিনিসের মুখোমুখি হতে হয়েছে যা তুমি বুঝবে না।”
সরাসরি না বলেও উম্মে হুজাইফা বিশ্বাস করেন যে হেফাজতে থাকাকালীন তার স্বামীকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছিল।
সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত আরেক বন্দিশিবির, আবু গারিবের ছবি প্রকাশ্যে এসেছিল। সেখানে বন্দিদের যৌন কর্মে বাধ্য করা এবং আপত্তিজনক পরিস্থিতিতে দেখা গিয়েছিল।
আমরা উম্মে হুজাইফার এই অভিযোগগুলো মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের কাছেও জানিয়েছি কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
ইরাকে যুদ্ধ
উম্মে হুজাইফা জানিয়েছেন তার সন্দেহ হতে থাকে তার স্বামী জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত কি না। “ও স্নানে গেলে বা ঘুমোলে আমি জামা কাপড় ঘেঁটে দেখতাম।”
“শরীরে কোনও কষ্ট আছে কি না সেটাও দেখার চেষ্টা করতাম…আমি উদ্বিগ্ন থাকতাম,” বলেছেন তিনি। যদিও কিছুই খুঁজে পাননি উম্মে হুজাইফা ।
“সে সময় আমি বলেছিলাম তুমি পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছ। আমার সে কথা শুনে রেগে উঠেছিল।”
কথোপকথনের সময় উম্মে হুজাইফা জানিয়েছেন কীভাবে তার স্বামী মিথ্যে পরিচয় দিয়ে প্রায়শই তার বাসস্থান পরিবর্তন করতেন। এরপর আরো একবার বিয়ে করেন আবু বকর আল-বাগদাদি।
উম্মে হুজাইফা জানিয়েছেন, স্বামীর কাছ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়েছিলেন কিন্তু তার (আবু বকর আল-বাগদাদির) শর্ত মানতে পারেননি। আবু বকর আল-বাগদাদির শর্ত ছিল সন্তানদের তার (আবু বকর আল-বাগদাদির) কাছে রেখে যেতে হবে। তাই শেষ পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গেই থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে যখন ইরাকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চরমে, সে সময়ে উম্মে হুজাইফা নিশ্চিত হয়ে যান যে তার স্বামী সুন্নি জিহাদি গোষ্ঠীর অংশ।
২০১০ সালে আবু বকর আল-বাগদাদি তথাকথিত ইসলামিক স্টেট অফ ইরাকের নেতা হন। ২০০৬ সালে এই সংগঠন তৈরি হয়। ইরাকি জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর ঐক্যমঞ্চ এই সংগঠন।
উম্মে হুজাইফা বলেন, “২০১২ সালের জানুয়ারিতে আমরা সিরিয়ার ইদলিবের গ্রামীণ এলাকায় চলে আসি। এটা ততদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে আমার স্বামী কোনও বড় গোষ্ঠীর আমির (নেতা)।”
এর দু’বছর পর তথাকথিত ইসলামিক স্টেট যখন খিলাফত ঘোষণা করে, তখন ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক গ্রুপও এর অংশ হয়ে যায়।
উম্মে হুজাইফা জানিয়েছেন, সেই সময় তার স্বামী আফগান পোশাক পরা শুরু করেন, দাড়ি রাখেন আর সঙ্গে একটা পিস্তলও রাখতে শুরু করেন।
উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময় পরিস্থিতির অবনতি হলে আবু বকর আল-বাগদাদি রাক্কায় চলে যান এবং সেটিকে আইএস-এর ‘খিলাফতের’ রাজধানী বানিয়ে ফেলেন।
এই সময়েই উম্মে হুজাইফা তার স্বামীকে প্রথম টিভিতে দেখতে পান।
মানবতাবিরোধী অপরাধ
যে গোষ্ঠীগুলো একত্রিত হয়ে আইএস গঠন করেছিল তাদের নৃশংসতার কথা আগে থেকেই সবার জানা ছিল। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৫ সালে নৃশংসতা আরও ব্যাপক এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
জাতিসংঘের একটি তদন্তকারী দল জানিয়েছে তারা প্রমাণ পেয়েছে যে আইএস ইরাকের সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের উপর মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে , এই তালিকায় গণহত্যা, অপহরণ এবং দাসত্বও রয়েছে।
আইএস তাদের হেফাজতে থাকা জিম্মিদের শিরোশ্ছেদ ও জর্ডানের পাইলটকে পুড়িয়ে মারার মতো নৃশংস ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রচারও করেছে।
আরেক কুখ্যাত ঘটনায়, ওই জঙ্গি সংগঠন প্রায় ১ হাজার ৭০০ (মূলত শিয়া) প্রশিক্ষণার্থী ইরাকি সৈন্যকে হত্যা করে। এই প্রশিক্ষণার্থী সৈন্যরা বাগদাদের উত্তরে স্পিচার সেনাঘাঁটি থেকে তাদের শহরে ফিরেছিল।
আইএসের সদস্যদের সঙ্গে যে নারীরা থেকেছেন, তাদের অনেকেই বলেন কোন পরিস্থিতির সঙ্গে তারা জড়িয়ে যাচ্ছেন তারা তা বুঝে উঠতে পারেননি।
তাই আমি উম্মে হুজাইফাকে জোর দিয়েছিলাম এই নৃশংস ঘটনাগুলো সম্পর্কে তার মতামত জানানোর জন্য।
উম্মে হুজাইফা জানিয়েছেন সে সময়েও (নৃশংসতার সময়) তিনি কোনও ছবি দেখতে পারতেন না এবং এই নৃশংসতাকে ” যন্ত্রণাদায়ক, অমানবিক” এবং “অন্যায়ভাবে রক্তপাত ঘটানো একটা ভয়ঙ্কর জিনিস এবং তারা (আইএস) মানবতার সীমা অতিক্রম করেছে” বলে মন্তব্য করেন।
উম্মে হুজাইফা জানিয়েছেন, তার স্বামীর হাতে “এই নিরপরাধ মানুষের রক্ত লেগে থাকার” বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন যে “ইসলামের আইন মেনে আরও অন্যান্য পন্থা অবলম্বন নেওয়া যেত যেমন, তাদের (যাদের হত্যা করা হয়েছে) অনুশোচনা হয় এমন পথে চালিত করা।”
আবু বকর আল-বাগদাদির প্রথম স্ত্রী জানিয়েছেন কীভাবে তিনি (আবু বকর আল-বাগদাদি) ল্যাপটপের সাহায্যে আইএস নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।
একটা ব্রিফকেসে তালাবদ্ধ ওই ল্যাপটপ রাখা হতো।
“কী ঘটছে তা জানার জন্য আমি (ল্যাপটপ) খোলার চেষ্টা করেছিলাম।”
“তবে আমি প্রযুক্তির দিক থেকে নিরক্ষর ছিলাম আর আমার কাছে সব সময় পাসকোড চাইত।”
মসুল দখল
কথোপকথনের সময় পালানোর ব্যর্থ চেষ্টার কথাও বলেন উম্মে হুজাইফা। তার দাবি পালানোর চেষ্টা করলেও একটা চেকপয়েন্টে মোতায়েন সশস্ত্র ব্যক্তিরা তাকে বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল।
একইসঙ্গে উম্মে হুজাইফার দাবি স্বামী আবু বকর আল-বাগদাদি ব্যক্তিগতভাবে কোনও যুদ্ধে অংশ নেননি। তিনি জানিয়েছেন যে সময় আইএস মসুল দখল করে, তখন তার স্বামী রাক্কায় ছিলেন। পরে সেখান থেকে তিনি ভাষণ দিতে মসুলের উদ্দেশে রওনা হন।
এরপরপরই আবু বকর আল-বাগদাদি তাদের ১২ বছরের মেয়ে উমাইমাকে তার বন্ধু মনসুরের সঙ্গে বিয়ে দেন। মনসুরকে তার পারিবারিক সমস্ত বিষয় দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন।
উম্মে হুজাইফা জানিয়েছেন এই বিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা তিনি করেছিলেন। কিন্তু তার আপত্তির উপর আমল দেওয়া হয়নি।
ইরাকের একটি নিরাপত্তা সূত্র আমাদের জানিয়েছে, এর আগে মাত্র আট বছর বয়সে উমাইমার আরও একবার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় আইএস-এর এক মুখপাত্রর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই শিশুর।
নিরাপত্তার কারণে আবু বকর আল-বাগদাদির অনুপস্থিতিতে তার স্বামী যাতে বাড়িতে ঢুকতে পারেন, সেজন্যই উমাইমার প্রথম বিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে উম্মে হুজাইফা আরেক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন যার নাম নাসিবা। তার এই সন্তান জন্ম থেকেই হৃদরোগে ভুগছিল। এদিকে ঠিক এই সময়েই মনসুর ইয়াজিদি নারী ও অল্পবয়সী মেয়েদের বাড়িতে নিয়ে আসতে থাকে যাদের বয়স ছিল নয় বছর থেকে শুরু করে তিরিশের মধ্যে।
সে সময় তথাকথিত আইএস হাজার হাজার ইয়াজিদি নারীকে ক্রীতদাস বানিয়েছিল। হত্যাও করা হয়েছিল হাজারে হাজারে।
উম্মে হুজাইফা অবশ্য বলেছেন যে তিনি এই ঘটনায় গভীরভাবে মর্মাহত এবং বিব্রতবোধ করেছেন।
ইয়াজিদি নারীদের অপহরণ ও দাসত্বর মামলা
মনসুর যে মেয়েদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল তাদের মধ্যে ছিল সামর এবং জেনা (নাম পরিবর্তন করা হয়েছে)।
উম্মে হুজাইফা দাবি করেছেন অন্যত্র পাঠানোর আগে এই মেয়েরা মাত্র কয়েকদিনের জন্য তার রাক্কার বাড়িতে থাকত।
কিন্তু উম্মে হুজাইফা তার পরিবারের সাথে মসুলে চলে গেলে সামর ফিরে আসে। সেই সময় প্রায় দুই মাস তাদের সঙ্গে এক বাড়িতে ছিল।
আমি সামরের বাবা হামিদকে খুঁজে বের করতে পেরেছি। মেয়েকে কীভাবে অপহরণ করা হয়েছিল সে কথা বলতে গিয়ে সামরের বাবার চোখ কান্নায় ভিজে যাচ্ছিল।
হামিদ জানান, তার দুই স্ত্রী ও ২৬ সন্তান রয়েছে। তার দুই ভাই এবং পরিবারের সমস্ত সদস্যকে সিনজারের খানসুর এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়েছিল, কোনোমতে কাছাকাছি একটা পাহাড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি।
সামরসহ হামিদের ছয় সন্তান এখনো নিখোঁজ। মুক্তিপণ পাওয়ার পর তার অন্য সন্তানদের মধ্যে কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়া হয় আর বাকি কয়েকজন ফিরে আসে যেই অঞ্চলে তাদের আটকে রাখা হয়েছিল সেই সব অঞ্চল মুক্ত হওয়ার পর।
তারই ভাইজি জেনা (সমরের সঙ্গে থাকা অন্যজন) এখনও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আটকা পড়ে আছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেনার বোন সৌদ জানিয়েছেন, তার সঙ্গে কখনও উম্মে হুজাইফার সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে সৌদের অভিযোগ, জেনাকে ক্রীতদাস বানানো হয়েছে, তাকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। শুধু তাই নয় সাতবার বিক্রি করা হয়েছে জেনাকে।
হামিদ এবং সৌদ ইয়াজিদি নারীদের অপহরণ ও দাসত্বে জড়িত করার অভিযোগে উম্মে হুজাইফার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
তারা বিশ্বাস করে না যে, উম্মে হুজাইফা একজন অসহায় নারী। তাদের দাবি, আবু বকর আল বাগদাদির প্রথম স্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক।
“উনি সবকিছুর জন্য দায়ী,” বলেন সৌদ।
“কোনো মেয়ে তার সেবা করবে আর কোন মেয়ে তার স্বামীর সেবা করবে সেটা উনিই বেছে নিতেন। ওই মেয়েদের মধ্যে আমার বোনও ছিল।”
সৌদ জানিয়েছেন তার এই অভিযোগ আইএস-এর কবল থেকে ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে।
“হুজাইফা অপরাধী আবু বকর আল-বাগদাদির স্ত্রী এবং তিনি নিজেও একজন অপরাধী,” সৌদ বলেন।
তদন্তের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা
আমরা উম্মে হুজাইফাকে হামিদ এবং সৌদের সাক্ষাৎকার দেখিয়েছিলাম।
সেটা দেখার পর উম্মে হুজাইফা বলেছিলেন, “আমি অস্বীকার করছি না যে আমার স্বামী অপরাধী ছিল এবং ইয়াজিদি নারীদের সঙ্গে যা ঘটেছে তার জন্য আমি দুঃখিত।”
তবে তার নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো কিন্তু অস্বীকার করেছেন উম্মে হুজাইফা।
তিনি জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে অপহৃত মার্কিন ত্রাণকর্মী কায়লা মুলারের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। কায়লা মুলার আইএস-এর হেফাজতে প্রায় ১৮ মাস বন্দি ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত মারা যান।
কায়লা মুলারের মৃত্যুর বিষয়ে সঠিকভাবে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। আইএস সে সময় দাবি করেছিল, জর্ডানের বিমান হামলায় তার মৃত্যু হয়েছে যদিও এ কথা মানতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকের এক নিরাপত্তা সূত্রও আমাদের জানিয়েছে তাকে হত্যা করেছে এইএস।
২০১৯ সালে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আবু বকর আল-বাগদাদি এবং তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য লুকিয়ে ছিলেন।
এই অভিযানের সময় গ্রেফতার এড়াতে তিনি আত্মহত্যা করেন। সেই সময় বিস্ফোরণে তার সন্তানরাও মারা যায়। অন্যদিকে, আবু বকর আল-বাগদাদির চার স্ত্রীর মধ্যে দুই স্ত্রীর মৃত্যু হয় গুলিবিদ্ধ হয়ে।
ওই ঘটনার সময় উম্মে হুজাইফা সেখানে ছিলেন না। ওই সময় তিনি তুরস্কের একটা কারাগারে ছিলেন। ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে তুরস্কে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে ইরাকে নিয়ে আসা হয়, সেখানে আইএস সংগঠনে তার ভূমিকা নিয়ে তদন্ত চলছে।
বড় মেয়ে উমাইমা তারই সঙ্গে কারাগারে রয়েছেন। এবং ১২ বছরের আরেক মেয়ে ফাতিমাকে রাখা হয়েছে শিশুদের জন্য তৈরি একটি কেন্দ্রে।
উম্মে হুজাইফার এক ছেলের মৃত্যু হয় স্বামী আবু বকর আল-বাগদাদির সঙ্গে এবং অন্যজনের মৃত্যু হয় সিরিয়ায় রুশ বিমান হামলায়। ছোট ছেলে একটা অনাথালয়ে থাকে।
আমাদের কথোপকথন শেষ হলে উম্মে হুজাইফা কিছুক্ষণ মাথা তোলেন। তার মুখটি এক ঝলক দেখতে পেলাম আমি।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে থাকলে তার সন্তানদের সম্পর্কে তথ্য জানতে চান উম্মে হুজাইফা।
এখন তিনি কারাগারে আছেন, তার বিরুদ্ধে যে তদন্ত চলছে তার ফলাফলের অপেক্ষায়।