বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দুটি আত্মহত্যার ঘটনা দেশ জুড়ে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় তারই একজন শিক্ষক ও একজন সহপাঠীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
কিন্তু আত্মহত্যার ঘটনার আইনি প্রতিকার কতটা আছে? আত্মহত্যার চেষ্টা সম্পর্কেই বা আইন কী বলছে?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা বলছেন আত্মহত্যার চেষ্টা করাটাই একটা ফৌজদারি অপরাধ।
“আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে এক বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে তার”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু আত্মহত্যার ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে অতি সম্প্রতি গত ১৩ই মার্চ সুপরিচিত গায়ক সাদী মহম্মদের আত্মহত্যা মানুষকে আলোড়িত করেছে।
তবে মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন তিনি অনেকদিন ধরেই মায়ের মৃত্যু-সহ নানা কারণে বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন।
সে আলোচনা থামতে না থামতেই শুক্রবার রাতে ফেসবুকে তাকে আত্মহননে বাধ্য করার জন্য তারই এক সহপাঠী ও এক শিক্ষককে দায়ী করে সুইসাইড নোট পোস্ট করে আত্মহত্যা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা।
শনিবার রাতেই পুলিশ সেই শিক্ষক ও সহপাঠীকে আটক করেছে অবন্তিকার মায়ের দায়ের করা মামলার সূত্র ধরে।
এর আগে ২০২২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ফেসবুক লাইভে এসে নিজের মাথায় নিজেই পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ী।
আত্মহত্যার আগে ফেসবুক লাইভে গুছিয়ে শান্ত গলায় ১৬ মিনিটের বেশি সময় ধরে কথা বলেছিলেন তিনি। সেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন যে ব্যবসায় কীভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এরপর ওই বছরেই ৪ঠা জুলাই প্রেসক্লাবের সামনের খোলা চত্বরে এক ব্যক্তি হঠাৎ করেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে মৃত্যু হয় তার।
বাংলাদেশে সব মিলিয়ে বছরে কত মানুষ আত্মহত্যা করে তার পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।
তবে সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২৩ সালে সারা দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল।
এর আগে ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৩২ জন।
আইনি প্রতিকার কতটা?
আইনজীবী মিতি সানজানা বলছেন আত্মহত্যার চেষ্টা যেমন অপরাধ তেমনি কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়াও অপরাধ।
“আত্মহত্যার চেষ্টা দণ্ডবিধি অনুযায়ী একটা ফৌজদারি অপরাধ। অনেকে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালায় কিন্তু চেষ্টা করে সে যদি ব্যর্থ হয় তাহলে তাকেও প্রচলিত আইনে শাস্তি দেয়া যাবে।”
“এছাড়া প্ররোচনা বা উস্কানি দেয়া কিংবা কাউকে অপমান বা তাচ্ছিল্য করে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়াও ফৌজদারি অপরাধ,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কেউ আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে সেই ব্যক্তিকে আত্মহত্যা বা নিজেকে ধ্বংস করার ‘অপচেষ্টা’র অপরাধে এক বছরের জেলে যেতে হতে পারে।
দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনও ব্যক্তি আত্মহত্যা করার উদ্যোগ নেন এবং অনুরূপ অপরাধ করার উদ্দেশ্যে কোনও কাজ করেন, তা হলে তার এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড হতে পারে, বা উভয় শাস্তিই হতে পারে।
আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন মিতি সানজানা।
এছাড়া আত্মহত্যায় প্ররোচনা বা উস্কানি দেয়ার বিষয়টি যথাযথভাবে প্রমাণিত হলে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর ৩০৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি আত্মহত্যা করে, তাহলে যে ব্যক্তি আত্মহত্যায় সাহায্য করবে বা প্ররোচনা দান করবে, সে ব্যক্তিকে ১০ বছর পর্যন্ত যে কোনও মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
“তবে আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে কারও বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা গেলে তখনই তাকে শাস্তি প্রদান করা যাবে”, জানাচ্ছেন মিতি সানজানা।
সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে শাস্তি হতে পারে?
আইনজীবী মিতি সানজানা বলছেন শুধু সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে শাস্তি না দেওয়া গেলেও এটি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হতে পারে।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২–এর ৩২ ধারায় বলা আছে, আত্মহত্যাকারীর মৃত্যুর আগে রেখে যাওয়া সুইসাইড নোট প্ররোচনা দানকারীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে।
তবে শুধু একটি সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। সে কারণে সুইসাইড নোটের সমর্থনে আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে হবে।
তার কথায়, “সে ক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে কোনও মনোমালিন্যের সূত্র ধরে তিনি যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটান, তবে আপনি তাতে আইনগত জটিলতার মুখোমুখি হতে পারেন।”
“এছাড়া তীব্র অপমান, তাচ্ছিল্য বা উপহাস কিংবা উত্তেজিত করার মাধ্যমে কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া দেশের আইন অনুযায়ী একটি অপরাধ”, বলছিলেন মিতি সানজানা।
কিন্তু এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আত্মহত্যায় প্ররোচনা বা উস্কানির অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা গেলেই কেবল শাস্তি দেওয়া যাবে।
তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, কোনও নারীর সম্মতি ছাড়া বা তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনও কাজ দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে কোনও নারী আত্মহত্যা করলে তা আত্মহত্যায় প্ররোচনার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে।
যার জন্য সে ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হবে।
মিতি সানজানা অবশ্য বলছেন আইনে যাই থাকুক মানুষ সাধারণত আত্মহত্যা করে মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায়, কারণ সে মনে করে তার ফিরে যাওয়ার পথ নেই।
“এজন্য সমাজ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব সবার দায়িত্ব আছে। কারও মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা থাকলে তার পাশে দাঁড়াতে হবে”, বলছিলেন তিনি।
তবে কোন ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেলে এক জন মানুষ নিজের প্রাণনাশের মতো সিদ্ধান্ত নেন, সে নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের মতামত ও অভিজ্ঞতা।
বস্তুত বহু ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার প্রবণতা এমন একটি সমস্যা, যা মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত।