নিজেদের ভূ-খণ্ডে ইরানের হামলার বিপরীতে দেশটিতে ‘প্রতিশোধমূলক’ পাল্টা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। বৃহস্পতিবার ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আস্তানা লক্ষ্য করে হামলা চালানো এবং এতে বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে দেশটি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসী আস্তানায় ‘মুর্গ বার সরমচার’ নামে একটি অত্যন্ত সমন্বিত সামরিক আক্রমণ শুরু করা হয়েছে।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী নিহতের কথা বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, দুই দিন আগে পাকিস্তানের আকাশসীমায় ইরানের হামলার ফলে দুই শিশু নিহত ও আরও তিন জন আহতের কথা জানা গেছে।
তখনই পাকিস্তান বিনা প্ররোচনায় তার আকাশসীমা লঙ্ঘন এবং ভূখণ্ডে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল এবং তার সার্বভৌমত্বের ওপর এই আঘাত ‘অগ্রহণযোগ্য’ এবং এর পরিণতি ‘মারাত্মক’ হতে পারে বলে উল্লেখ করেছিল।
“পাকিস্তান বহু বছর ধরে ইরানকে সন্ত্রাসীদের আস্তানার কথা জানিয়ে আসছে। পাকিস্তান এই সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি এবং কার্যকলাপের সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ বেশ কিছু দলিলও শেয়ার করেছে”, বলা হয়েছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতিতে।
ইরানের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করার কথা উল্লেখ করে বিবৃতিটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আজকের পদক্ষেপের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের নিজস্ব নিরাপত্তা এবং জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখা। এক্ষেত্রে কোনো আপস করা যাবে না।
ইরানি জনগণের প্রতি পাকিস্তানের জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদসহ অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা সবসময় সংলাপ ও সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছি এবং ভবিষ্যতেও যৌথ সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
পাকিস্তানের হামলা বিষয়ে ইরানি গণমাধ্যম যা জানাচ্ছে
এদিকে পাকিস্তানের দাবির পর, ইরানি গণমাধ্যমেও এই হামলার কথা এবং তাতে বেসামরিক হতাহতের কথা এসেছে।
মেহর বার্তা সংস্থাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি ফার্সি জানিয়েছে, ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তানের ডেপুটি সিকিউরিটি গভর্নর বলেছেন যে সারাওয়ানে বিস্ফোরণে ‘তিন নারী ও চার শিশু’ নিহত হয়েছে।
ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ সিস্তান-বেলুচিস্তানের ডেপুটি গভর্নর জেনারেল আলী রেজা মারহামাতি বলেছেন ইরানের একটি সীমান্তবর্তী গ্রামে স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ৫ মিনিটে হামলাটি চালানো হয়।
নিহত ৭ জনের ইরানি নাগরিকত্ব ছিল না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমে।
বৃহস্পতিবার সকালে সারাওয়ান শহরের আশেপাশে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়; পরে খবর আসে যে এই বিস্ফোরণগুলি পাকিস্তানের হামলার কারণে হয়েছে।
পাকিস্তানের হামলার কথা স্বীকার ইরানের
এর আগে ইরান পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে মঙ্গলবারের মিসাইল ও ড্রোন হামলার কথা স্বীকার করেছে।
ইসলামাবাদের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন বেলুচিস্তানে যে হামলা হয়েছে তাতে দুইজন শিশু নিহত এবং আরো তিনজন আহত হয়েছে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল জইশ আল আদলি জঙ্গি গ্রুপ। তিনি এদের পাকিস্তানে “ইরানিয়ান জঙ্গি গ্রুপ” নামে অভিহিত করেন।
এর ফলস্বরূপ পাকিস্তান সরকার ইরান থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে এবং তেহরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেও ফিরে যেতে বাধা দিয়েছে।
এই সপ্তাহের শুরুতে ইরাক এবং সিরিয়াতে হামলার পর বেলুচিস্তানে হামলা চালালো ইরান।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইসলামাবাদ বলেছিল, এই হামলা ‘বেআইনি কর্মকাণ্ড’ এবং এটি ‘সংকটজনক ফল’ ডেকে আনতে পারে।
যদিও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান, দাভোসে এই বিষয়ে জোর দিয়ে বলেছেন, কোনো পাকিস্তানি নাগরিককে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি, শুধু জইশ আল আদল এর সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
“আমরা শুধুমাত্র পাকিস্তানের মাটিতে ইরানিয়ান জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তু করেছি” মি. আমির আব্দুল্লাহিয়ান বলেছেন।
তিনি আরো যোগ করেন, তিনি পাকিস্তানি প্রতিপক্ষের সাথে কথা বলেছেন এবং “তাকে আশ্বস্ত করেছি আমরা পাকিস্তান ও ইরাকের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করি”
গাজায় ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে যুদ্ধের সময়ে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার সময়ে ইরান ও পাকিস্তান পরস্পরের ভূ-খণ্ডে হামলা চালালো।
তেহরান বলছে বৃহত্তর সংঘাতে তারা জড়াতে চায় না। কিন্তু এর তথাকথিত ‘এক্সিস অব রেসিসট্যান্স’ গ্রুপের অন্তর্গত ইয়েমেনে হুথি জঙ্গি, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়া ও ইরাকের বিভিন্ন গ্রুপ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করার জন্য ইসরায়েল ও তার মিত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে।
বাণিজ্যিক জাহাজে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্র হুথিদের ওপর বিমান হামলা চালায়।
চীন বুধবার পাকিস্তান এবং ইরানকে ‘সংযম’ এবং ‘যেসব কাজ উত্তেজনাকর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায় তা পরিহার করতে’ আহবান জানিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেছেন, বেইজিং এসব দেশগুলোকে ‘নিকটতম প্রতিবেশী’ হিসেবে দেখে।
পাকিস্তানে মঙ্গলবারের হামলায় দক্ষিণ -পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বেলুচিস্তানের একটি গ্রামে আঘাত করা হয়। তেহরান বলছে, তারা জাইশ আল-আদল বা “বিচারের বাহিনী”, একটি জাতিগত বেলুচ সুন্নি মুসলিম গোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করছে যারা ইরানের অভ্যন্তরের পাশাপাশি পাকিস্তানের সরকারি বাহিনীর উপর হামলা চালিয়েছে।
গত ডিসেম্বরে জইশ আল আদল পাকিস্তান সীমান্তের কাছে রাস্ক শহরের একটি পুলিশ স্টেশনে হামলা চালায়।
দুই সপ্তাহ আগে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান এর সবচেয়ে খারাপ অভ্যন্তরীণ হামলার শিকার হয়েছিলো। হামলাটি হয়েছিলো ইউএস এসাসিনেশনে ইরানের কুখ্যাত বিপ্লবী গার্ড জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার পর কারমানে একটি অনুষ্ঠানে।
দুটি বোমা হামলায় ৮৪ জন নিহত হয়েছিল ওই হামলায়।
সোমবার ইরান সিরিয়া এবং উত্তর ইরাকের কুর্দি শাসিত অঞ্চলে ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুঁড়ে।
ইরান বলেছে, তারা ইসলামিক স্টেট এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার ঘাঁটিকে টার্গেট করেছে; যারা উভয়েই কারমান বোমা হামলায় জড়িত ছিল।
কিন্তু তার পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিবেশী পাকিস্তানকে হামলা করা একটি নাটকীয় পরিস্থিতি।
এ ঘটনায় পাকিস্তান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, দেশগুলোর মধ্যে ‘যোগাযোগের বেশ কয়েকটি চ্যানেল থাকা সত্ত্বেও’ এই হামলা হয়েছে।
পাকিস্তান ও ইরানের সম্পর্ক কেমন?
পাকিস্তান এবং ইরানের সম্পর্ককে ‘খুবই স্পর্শকাতর কিন্তু আন্তরিক’ বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। উভয়েই একে অপরের বিরুদ্ধে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এনেছে বিভিন্ন সময়। যারা বছরের পর বছর ধরে তাদের সীমান্ত এলাকায় হামলা চালায়।
প্রায় নয়শ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা দুদেশের। এর দুইপাশের নিরাপত্তার বিষয়টি উভয় সরকারের জন্য দীর্ঘকাল ধরে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইরানি হামলাটি ইরানের সীমান্ত থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার এবং নিকটতম শহর পাঞ্জগর থেকে নব্বুই কিলোমিটার দূরে সবজ কোহ গ্রামে হয়েছিলো বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্থানীয় কর্মকর্তারা এলাকাটিকে গবাদিপশুর মালিক এমন বেলুচ উপজাতিদের একটি কম জনবহুল এলাকা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেখানে ব্যাপকহারে পণ্য, মাদক এবং অস্ত্রের চোরাচালান হয়।
“সীমান্তের উভয় পাশের জনগণ নিজেদের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা থেকে বঞ্চিত বলে মনে করে, বৈষম্যের সম্মুখীন হয় এবং নিজস্ব সম্পদ থেকে বড় অংশের দাবি করে” নিরাপত্তা ভাষ্যকার জাইঘাম খান বিবিসিকে বলেছেন।
ইরানে, সুন্নি মুসলিম বেলুচ সংখ্যালঘুরা শিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে বৈষম্যের অভিযোগ করে। যখন বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জইশ আল আদল হলো ‘সবচেয়ে সক্রিয় এবং প্রভাবশালী’ সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী যারা সিস্তান-বেলুচিস্তানে কাজ করে। ওয়াশিংটন এবং তেহরান তাদের জঙ্গি গ্রুপ নামে আখ্যায়িত করেছে।
পাকিস্তানের আরেকজন নিরাপত্তা ভাষ্যকার আমির রানা বিবিসিকে বলেছেন, “তিনি মনে করেন এই কূটনৈতিক সঙ্কট শান্ত হতে একটু সময় লাগবে কিন্তু বিষয়টা এমনও যে পাকিস্তান এটা বাড়াতে চায় না” ।
তিনি বলেন, অতীতে পাকিস্তান সীমান্তে ইরানের কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
কিন্তু বুধবার ইসলামাবাদ ইরান থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে এবং ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে।
বৃহস্পতিবার ইরানের ভূ-খণ্ডে ‘সন্ত্রাসীদের আস্তানা’য় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো পাকিস্তান। এর ফলে এ উত্তেজনা দীর্ঘ সংঘাতের দিকে মোড় নেবে কিনা এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।