চোখের সামনে তিনি যে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছেন, সেটি তার চেহারা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
ধ্বংসস্তূপ থেকে শিশুদের নির্জীব দেহ বের করে আনা, তাঁবুতে সাদা চাদরে মোড়ানো সারি সারি মৃতদেহ এবং বিমান হামলায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া ইমারত।
মাহমুদ বাদাভি তাঁর চোখের সামনে মানবতা গুঁড়িয়ে যেতে, পুড়তে, ছিন্নভিন্ন হতে দেখেছেন।
“অনেক কঠিন পরিস্থিতি আসে। একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে, যা ঘটছে তার অনেক কিছুই দেখতে হয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হাত, মাথা… দেহ – যাই হোক, আমরা অভ্যস্ত,” মাহমুদ বলেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী মাহমুদ বাদাভির অ্যাম্বুলেন্স হত্যাযজ্ঞের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে চলে। গাজার এক সরু গলিতে মাহমুদ দাঁড়ালেন, বিমান হামলায় আহত দুই শিশুকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার জন্য।
এক ব্যক্তি তার কোলে কিছু একটা নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে এগিয়ে এলেন। তাঁর কোলে মারাত্মকভাবে আহত এক বালক।
মাহমুদের এক বন্ধু যিনি আহতদের উদ্ধারকার্যে নিযুক্তদের সাহায্য করছেন, তাঁকে চিৎকার করে ওই আহত বালক সম্পর্কে আরও যত্নশীল হতে অনুরোধ করে বলেন, “নাসির, ওর মাথা চৌচির হয়ে গেছে।”
তারপরও মাহমুদ বিচলিত না হয়ে শান্তভাব বজায় রাখেন। এমনটা নয় যে এই পরিস্থিতি তাঁকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় না।
কিন্তু মাহমুদ যে কাজে ব্রতী, তা সুষ্ঠু ভাবে করার জন্য স্থির থাকাটা ভীষণ দরকার, যাতে তিনি আহতদের দিকে নজর দিতে পারেন, যাদের বাঁচানো সম্ভব।
বিবিসি-র সংবাদদাতার সঙ্গে কথা বলার সময় মিসাইল বিস্ফোরণের একটা বিকট শব্দ শোনা গেল।
“এখানে যা অবস্থা তাতে বিরতি নাওয়ার ফুরসত আমাদের কারও নেই। পরিস্থিতি ভীষণ খারাপ। এখন আমাদের খোঁজার চেষ্টা করতে হবে, কোথায় এই বিস্ফোরণ হল যাতে আহত আর মৃতদের কাছে পৌঁছতে পারি,” তিনি বলেছেন।
চিকিৎসা পরিষেবার কথা জানতে চাইলে, তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, “সবই চলছে।”
গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিগত দুই সপ্তাহে ছয় হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই শিশু বলে জানা গিয়েছে।
জাতিসংঘের তরফে সতর্ক করা হয়েছে, এক তৃতীয়াংশ হাসপাতাল এবং দুই-তৃতীয়াংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ করতে হয়েছে। এসব হাসপাতাল হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘ আরো জানিয়েছে যে, মজুত জ্বালানির ভাণ্ডার ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হতে চলেছে। আগামী দিনে, কোন পরিষেবাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে আর কোনটা হবে না, তা নিয়ে ‘কঠিন সিদ্ধান্ত’ নিতে হতে পারে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল গাজা ভূখণ্ডে কোনও রকম জ্বালানি সরবারহের বিরোধী। তাদের আশঙ্কা ওই জ্বালানি হামাসের হাতে। তারা হামাসের বিরুদ্ধে জ্বালানি লুট করার অভিযোগও করেছে।
গাজায় দিন, রাত প্রায় সব মিলেমিশে একাকার, যুদ্ধ চলছেই। গাজা ভূখণ্ডের এই ছোট্ট অংশ যা মাত্র ১৪১ বর্গমাইল (৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার) জুড়ে রয়েছে, তার সর্বত্রই যুদ্ধের চিহ্ন।
ইতোমধ্যে ইসরায়েল গাজার উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত প্রায় দশ লক্ষ মানুষকে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। হামাসকে নির্মূল করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনী যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে তাই এই নির্দেশ।
কিন্তু ইসরায়েল বিমান হামলা বন্ধ করেনি। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের বিমান আক্রমণ কিন্তু অব্যাহত।
পালিয়ে যাব কী-না? গেলে কোথায় যাব? কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেব? – গাজায় দিন-রাত এসব প্রশ্ন মরিয়া হয়ে ঘুরছে মানুষের মনে।
এর অর্থ, জরুরি পরিষেবার কাজে নিযুক্ত মানুষের ঘরে ফেরা বা সুরক্ষিত আশ্রয়ে থাকার প্রশ্নও নেই।
মাহমুদ যখন তাঁর কাজে বাসা থেকে বের হন, তখন তাঁর স্ত্রী আর ছয় সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন থাকেন। একই সাথে তার পরিবারের সদস্যরাও মাহমুদের নিরাপত্তার জন্য চিন্তায় থাকে।
যেদিন বোমার হানা তীব্র হয়, মাহমুদ চেষ্টা করেন, প্রতি ঘণ্টায় বাড়িতে ফোন করে কথা বলতে। কিন্তু টেলিফোন মারফত যোগাযোগ করাও কঠিন।
“পরিবারের সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করাটাও ভীষণ কঠিন। বাড়ির সকলে সুরক্ষিত আছে কী-না সেটুকু জানার জন্যও যতটুকু পরিষেবা প্রয়োজন তাও অনেকসময় থাকে না,” মাহমুদ বলেছেন।
সংসার চালাতে মাহমুদ কঠিন পরিশ্রম করেন। সঙ্গে তাঁর সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার তীব্র আকাঙ্খা।
মাহমুদের এক মেয়ে ডাক্তার হতে চায়, বাবা –ই তাঁর অনুপ্রেরণা। আর সঙ্গে রয়েছ গাজায় থাকাকালীন চোখের সামনে দেখা যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ।
মাহমুদের এক ছেলেও রয়েছে যে নার্স হিসেবে কাজ করতে চায়। অন্য এক মেয়ে শিক্ষিকা হওয়ার জন্য প্রস্তুত।
রাত ঘনিয়ে এলে এক সময় বোমা হানায় ছেদ পড়ে। মাহমুদ একটু থামেন, তারপর অ্যাম্বুলেন্স এবং ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়ান।
তাঁর বাঁ হাতে ধরা স্ট্রেচার। পরের জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকেন মাহমুদ। উত্তেজনা ক্রমশ কমে আসে।
কোনও অনুভূতিই যেন ছুঁতে পারে না তাঁকে। কিছুক্ষণের জন্য আবেগ-শূন্য হয়ে পড়েন তিনি, চোখ চলে যায় দূরে। যা কিছু তিনি দেখেছেন সেজন্য তার দু’চোখ কষ্টে ভরা।