ফিলিস্তিনি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের উপর শনিবার থেকে এক নজিরবিহীন আক্রমণ শুরু করেছে। হামাস যোদ্ধারা গাজা উপত্যকার কাছাকাছি ইসরায়েলি বসতিগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং অতর্কিত হামলা চালায়। এতে বহু ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয় এবং অনেককে জিম্মি করে হামাস।
হামাস কেন ইসরায়েলের উপর হামলা চালিয়েছে তা জানতে হলে আপনাকে এর সাথে জড়িত ব্যক্তি, স্থান ও একই সাথে সেখানকার রাজনীতিকে বুঝতে হবে।
হামাস কী?
হামাস একটি ফিলিস্তিনি ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা গাজা উপত্যকা শাসন করে। হামাস ২০০৭ সালে ইসরায়েলকে হঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর ইসরায়েলের সাথে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করে তারা।
এই যুদ্ধগুলিতে হামাস ইসরায়েলের দিকে হাজার হাজার রকেট নিক্ষেপ করেছে এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেও ইসরায়েলের দিকে রকেট নিক্ষেপ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছে। তারা ইসরায়েলে অনেকবার মারাত্মকভাবে হামলা পরিচালনা করেছে।
জবাবে ইসরায়েলও বারবার হামাসকে বিমান হামলার মাধ্যমে আক্রমণ করেছে এবং মিশরের সাথে একজোট হয়ে ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকাকে অবরোধ করে রেখেছে। ইসরায়েল বলছে তারা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই অবরোধ দিয়ে রেখেছে।
মূলত ইরান হামাসকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে, তারা হামাসকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়।
যদিও ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি অন্যান্য অনেক প্রভাবশালী দেশ হামাসকে একটি ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিশেষ করে হামাসের সামরিক শাখাকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ বলে এসব দেশ।
গাজা উপত্যকা কী?
গাজা উপত্যকা ইসরায়েল, মিশর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে একটি ৪১ কিমি দীর্ঘ এবং ১০ কিমি-প্রশস্ত অঞ্চল। যেখানে প্রায় ২৩ লাখ লোক বসবাস করে এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
ইসরায়েল গাজা এবং এর উপকূলীয় এলাকার আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করে পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে কারা যাতায়াত করবে ও কী ধরনের পণ্য প্রবেশ করতে পারবে তা তদারকি করে। একইভাবে মিশরও গাজা সীমান্ত দিয়ে কারা প্রবেশ করবে তা নিয়ন্ত্রণ করে।
কেন ইসরাইল ও হামাস যুদ্ধ করছে?
ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে পারস্পরিক উত্তেজনা নিয়মিত ঘটনা। তবে শনিবার হামাসের হামলা ছিল একেবারে অতর্কিত। কোন ধরনের আগাম সতর্কবার্তা পায়নি ইসরায়েল।
হামাস ইসরায়েলে এক সাথে হাজার হাজার রকেট নিক্ষেপ করে এবং অনেক হামাস যোদ্ধা সীমানা পার হয়ে ইসরায়েলি বসতিতে আক্রমণ করে। এতে অনেক ইসরায়েলি নিহত হয় এবং অন্যদের বন্দী করা হয়।
এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল তাৎক্ষণিকভাবে বিমান হামলা শুরু করে। বিশেষ করে হামাসের বিভিন্ন অবস্থান লক্ষ্য করে তারা এই বিমান হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে।
এই হামলা কতটা নজিরবিহীন?
বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন বলেছেন- “এটি গাজা থেকে হামাসের পরিচালিত সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী অভিযান এবং ইসরায়েলের একটি প্রজন্ম কোনদিন তাদের দেশ এমন গুরুতর আক্রমণের শিকার হতে দেখেনি।
হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা গাজা-ইসরায়েলের সীমানার তারের বেড়া পার হয়ে ইসরায়েলি বসতির বিভিন্ন জায়গায় ঢুকে পড়ে।
পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৩ সালে মিশর ও সিরিয়া ইসরায়েলে এই ধরনের আচমকা হামলা চালায়। এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ লেগে যায়। ওই হামলার ৫০তম বার্ষিকীর একদিন পরে এই নজিরবিহীন আক্রমণ চালায় হামাস। হামলার এই তারিখটি হামাসের নেতারা একটি স্মরণীয় দিন হিসেবেই মনে রাখবেন। ”
এটা কি ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের বড় ব্যর্থতা?
এই হামলাকে একটি গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডনার। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা, শিন বেট, বহিরাগত হুমকি নিয়ে কাজ করা গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল শাখা কার্যত এই হামলার কোন আভাসই পায়নি। ফলে হামাসের এই আক্রমণে তারা সময় মতো সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক রয়েছে ইসরায়েলের, তারা এই খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে। লেবানন, সিরিয়া এমনকি ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যেও তাদের নিয়োজিত তথ্য দাতা রয়েছে। যারা নিয়মিত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তথ্য দিয়ে থাকে।
এছাড়া গাজা-ইসরায়েল উত্তেজনাপূর্ণ সীমানায় তারের বেড়া বরাবর ক্যামেরা, গ্রাউন্ড-মোশন সেন্সর এবং নিয়মিত সেনা টহল রয়েছে।
আক্রমণ ঠেকাতে এই ধরনের ব্যবস্থাকে একটি “স্মার্ট বাধা” বলে মনে করা হতো। তারপরও হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি বসতিতে প্রবেশ করেছে। তারা তারের বেড়া কেটে বা সমুদ্র থেকে প্যারাগ্লাইডার দিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে।
ফিলিস্তিন কী এবং এর সাথে এই ঘটনাগুলোর কী সম্পর্ক আছে?
বর্তমানে পশ্চিম তীর এবং গাজা এগুলো ফিলিস্তিনি অঞ্চল হিসাবে পরিচিত, রোমান সময়ে পূর্ব জেরুজালেম এবং ইসরায়েল এগুলোও ফিলিস্তিন নামে পরিচিত ছিল।
এদিকে বাইবেলে ওই অঞ্চলে একটি ইহুদি রাজ্যের কথা উল্লেখ্য আছে। তাই ইহুদিরা ওই অঞ্চলকে তাদের প্রাচীন মাতৃভূমি হিসাবে দাবী করে।
ইসরায়েলকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় ১৯৪৮ সালে। যে সব রাষ্ট্র এখনও ইসরায়েলের অস্তিত্বকে স্বীকার করেনা তারা ওই অঞ্চলকে এখনও ফিলিস্তিন হিসেবে উল্লেখ করে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরাও পশ্চিম তীর, গাজা এবং পূর্ব জেরুজালেমকে এক সাথে ফিলিস্তিন নামে ডাকে।
হামাসের হামলার পর কী হতে পারে?
হামাসের সশস্ত্র কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরবদের “(ইসরায়েলের) দখলদারিত্ব দূর করতে” সশস্ত্র অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিবিসির জেরুসালেমের সংবাদদাতা ইয়োলান্দ নেল বলেছেন, এখন একটি বড় প্রশ্ন হল অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুসালেম বা এই অঞ্চলের অন্যান্য ফিলিস্তিনিরা তার আহ্বানে সাড়া দেবে কিনা।
ইসরায়েল নিঃসন্দেহে একটি তীব্র যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখছে যাতে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ যুক্ত হতে পারে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হবে যদি শক্তিশালী লেবানিজ সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ এই যুদ্ধে অংশ নেয়।
এদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ব্যাপকভাবে সেনা মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে।
পাল্টা আক্রমণ হিসেবে গাজায় তারা এখন তীব্র বিমান হামলা চালাচ্ছে। পাশাপাশি সেখানে স্থল অভিযানেরও ইঙ্গিত দিয়েছে।