দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কেরালায় একটি ভূমিধসে মঙ্গলবার সকাল থেকে অন্তত ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিবিসি সংবাদদাতারা জানিয়েছেন। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ৯৮ জন।
এর রাজ্যের মুখ্যসচিব ভি ভেনু সংবাদ সংস্থা এএনআই কে জানিয়েছিলেন যে তারা ৮০টি মৃতদেহ উদ্ধার করতে পেরেছেন।
মৃতের সংখ্যা দুপুরের পর থেকে খুব দ্রুত বাড়তে থাকে।
তবে প্রবল বৃষ্টি এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ভেঙ্গে পড়ায় উদ্ধার কাজে সমস্যা হচ্ছে।
বিবিসির সহযোগী সংবাদদাতা ইমরান কুরেশী এবং আশরাফ পদান্না জানাচ্ছেন যে এখনও পর্যন্ত ২৫০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে।
যে ওয়েনাডের মেপ্পাডি অঞ্চলে মঙ্গলবার রাত দুটো থেকে তিনটের মধ্যে ভূমিধসের ঘটনা হয়েছে, সেখানকার সংসদ সদস্য ছিলেন ভারতের পার্লামেন্টের বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী।
জাতীয় বিপর্যয় মোকাবেলা বাহিনী এনডিআরএফ, কান্নুর ডিফেন্স সিকিউরিটি কোর এবং বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে।
কিন্তু বৃষ্টির কারণে উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটছে।
মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের দফতর থেকে জানানো হয়েছে, ভূমিধসের জায়গায় পৌঁছনোর জন্য একটি অস্থায়ী সেতু নির্মাণে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে।
উদ্ধার তৎপরতা
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন যে মঙ্গলবার রাতে প্রথম ভূমিধসটি নামে মুণ্ডাক্কাই শহরে। সেই সময়ে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল।
সেখানে উদ্ধার তৎপরতার মধ্যেই ভোর চারটে নাগাদ চুড়ালমালায় একটি স্কুলের কাছে দ্বিতীয় ভূমিধস হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়। ওই স্কুলটিকে একটি অস্থায়ী আশ্রয় শিবির হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
ভূমিধসের সঙ্গে সঙ্গেই পুরো এলাকার সব দোকান ও বাড়ি জল আর কাদায় ভরে যায়।
অন্যদিকে খবর পাওয়া গেছে যে একটি সেতু ভেঙ্গে পড়ায় ওই অঞ্চলে প্রায় চারশো পরিবার আটকে পড়ে আছে।
সংবাদ সংস্থা এএনআই জানাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জর্জ কুরিয়ান ওয়েনাডের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন, অন্যদিকে কেরালার বন মন্ত্রী একে শশীন্দ্রন ইতোমধ্যেই সেখান পৌঁছে গেছেন।
তিনি এবং আরও এক মন্ত্রী ঘটনাস্থল থেকেই উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা করছেন। আরও একাধিক মন্ত্রীকে সেখানে পৌঁছনোর নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন।
মি. শশীন্দ্রন বিবিসিকে বলেছেন, “ভূমিধসে ঠিক কতজন মানুষ আটকিয়ে পড়েছে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল।”
কেরালার ইংরেজি সংবাদ পোর্টাল ওয়ানমনোরমা জানাচ্ছে ভূমিধস যেখানে হয়েছে, তারই অন্যতম মুণ্ডাক্কাই এলাকার চা, কফি ও এলাচ বাগানগুলিতে বহু পরিযায়ী শ্রমিক আটকিয়ে পড়েছেন।
এই পরিযায়ী শ্রমিকরা মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে সেখানে কাজ করতে যান। একটি বাগান মালিককে উদ্ধৃত করে ওই সংবাদ পোর্টাল জানিয়েছে যে তাদের চা বাগানগুলিতে প্রায় ছয়শ শ্রমিক নিযুক্ত আছেন, যারা পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে এসেছেন।
সেখানে মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ায় রাত থেকে ওই শ্রমিকদের অবস্থা কী, তা জানতে পারেননি বাগানের মালিক।
কয়েকদিন ধরেই বৃষ্টি
গত কয়েকদিন ধরেই কেরালার বিভিন্ন জায়গায় প্রবল বৃষ্টি হয়েছে।
ওয়েনাড একটি পার্বত্য জেলা এবং এটি পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অংশ। বর্ষার মৌসুমে সেখানে ভূমিধসের ঝুঁকি থাকে। আগেও এই অঞ্চলে ভূমিধসের ঘটনা হয়েছে।
এই মুহূর্তে সেখানে বহু পর্যটকও রয়েছেন।
কেরালার বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা বিভাগ সাধারণ মানুষকে ভূমিধসপ্রবণ এলাকা থেকে দূরে থাকতে বলেছে।
ওই দফতর একই সঙ্গে মঙ্গলবার ৩০শে জুলাই ওয়েনাড, কোঝিকোড়, মালাপ্পুরম এবং কান্নুরে লাল সতর্কতা জারি করেছে।
আবহাওয়া দফতর সূত্রে খবর, এই সব এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় ২০৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে।
কেরালার আরও কয়েকটি এলাকায় বৃষ্টির জন্য কমলা এবং হলুদ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কাঁচা রাস্তা ও বনাঞ্চল দিয়ে কাদাজল ঢুকে পড়ছে, ঘরবাড়ি ভেসে যাচ্ছে এবং মানুষ ও যানবাহন আটকে পড়েছে।
চুরালমালা থেকে মুন্ডাক্কাই এবং আট্টামালার মধ্যে সংযোগকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ভেঙে পড়েছে, যার ফলে ওই দুটি এলাকা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
এর ফলে আটকে পড়া পরিবারগুলির কাছে উদ্ধার-কর্মীদের পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা রশিদ পাদিক্কালপারাম্বান সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, মধ্যরাতের দিকে অন্তত তিনটি ভূমিধসের ঘটনা ওই এলাকায় আঘাত হানে।
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা রাঘবন সি অরুণামালা ওই এলাকায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন।
“আমি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকিয়ে পড়া একজনকে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে শুনতে পাই। উদ্ধারকর্মীরা গত কয়েক ঘণ্টা ধরে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। আমরা আশঙ্কা করছি শত শত মানুষ গ্রামের ভেতরে আটকিয়ে আছেন,” জানিয়েছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাহুল গান্ধীর সমবেদনা
ভূমিধসে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের সঙ্গেও কথা বলেছেন মি. মোদী।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, ভূমিধসে নিহতদের পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য ও উদ্ধার অভিযানের সাফল্য কামনা করেছেন।
ওয়েনাডের সদ্য প্রাক্তন সংসদ সদস্য রাহুল গান্ধী সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, “ওয়েনাডে ভূমিধসের ঘটনায় আমি ব্যথিত। যাঁরা তাঁদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। যারা এখনো আটকে পড়ে আছেন তাদের দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।”
পিনারাই বিজয়ন এবং ওয়েনাডের জেলাশাসকের সঙ্গেও কথা বলেছেন রাহুল গান্ধী।
রাহুল গান্ধী একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপনের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “ত্রাণের কাজে যদি কোনও প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাদের বলুন।”
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও ভূমিধসের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। রাহুল গান্ধী ওয়েনাড আসন ছেড়ে দেওয়ার পর প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এই আসন থেকে কংগ্রেসের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।