সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে দীর্ঘ মেয়াদে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ মেয়াদের এই আন্দোলন সফল করতে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে ৬৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে।
সোমবার দ্বিতীয় দিনের অবরোধ কর্মসূচির পর রাতে দাবি আদায়ে সরকারকে তিন দিনের আল্টিমেটাম দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
একই সাথে আগামী তিনদিন দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি সারা দেশে গণসংযোগ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি পালন করবেন তারা।
আগের দিনের মতো সোমবার দুপুরের পর থেকে রাজধানীর শাহবাগ-সহ বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। এতে রাজধানীর ঢাকার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা-সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায়।
রাজশাহী ও ময়মনসিংহে রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমরা দেখছি সরকার এক ধরনের নীরব ভূমিকা পালন করছে ও দায় এড়িয়ে চলছে। সেখান থেকে মনে হচ্ছে এ আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদে যেতে পারে।”
শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে সোমবার দুপুরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ৫জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বৈঠকে বসেন। তবে বৈঠক শেষে সেখানে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটি নিয়ে কেউ কথা বলেননি।
তবে বৈঠকের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মি. কাদের বলেছেন, “বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। উচ্চ আদালতের রায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। রায় না হওয়া পর্যন্ত মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি পরিহার করা উচিত।”
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের দাবি যৌক্তিক। তা মানা না হলে এ আন্দোলন থেকে তারা সরবেন না।
দ্বিতীয় দিনের অবরোধে ‘অচল’ সড়ক মহাসড়ক
কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এদিন রাজধানীর শাহবাগ, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, সায়েন্সল্যাব মোড়, গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট, আগারগাঁও, মৎস্য ভবন মোড় ও নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোটা আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে এসে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে। এরপর তারা মিছিল নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনের রাস্তাও অবরোধ করেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মিছিলটি ফার্মগেট মোড়ে এসে রাস্তা অবরোধ করে। তাতে চারপাশের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
বিকালে প্রায় একই সময়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ও গুলিস্তানে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা।
গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট অবরোধ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি প্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা। এদিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরাও।
এই অবরোধ কর্মসূচির কারণে সন্ধ্যায় রাজধানীতে ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়। ঘণ্টার পর ঘন্টা আটকে থাকতে হয় দীর্ঘ যানজটে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীরা শিক্ষার্থীরা দুপুর থেকে ক্যাম্পাসের প্রধান গেটের সামনে জড়ো হয়ে বন্ধ করে দেয় গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা আরিচা মহাসড়ক। এতে দুই পাশের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় অবস্থান নিয়ে তারা মিছিল ও স্লোগান দিতে থাকে।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আগের দিনের মতো অবরোধ কর্মসূচি পালন করে।
সড়ক মহাসড়কের বাইরে রেলপথ অবরোধ করেও কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। এদিন রাজশাহী ও ময়মনসিংহে রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।
৬৫ সদস্যের কমিটি গঠন
সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এই আন্দোলন সফল করতে সোমবার ৬৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্মটি।
কমিটিতে ২৩ জন সমন্বয়ক এবং সহ-সমন্বয়ক হিসেবে ৪২ জন শিক্ষার্থীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিনিধিদের এখানে নাম আছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন সুসংগঠিত হওয়ার জন্য এবং অন্য কেউ যেন কোনও সুবিধা নিতে না পারে সে জন্য সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করা হয়েছে।
আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “প্রাথমিকভাবে আমাদের কোনও কমিটি করার পরিকল্পনা ছিল না। সরকারের নীরবতার কারণে আমরা দীর্ঘ মেয়াদে আন্দোলন চালিয়ে যেতে প্রাথমিকভাবে এই কমিটি গঠন করেছি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজের প্রতিনিধিসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি নিয়ে সমন্বয়ক ও সহ সমন্বয়ক নিয়ে কমিটি করা হয়েছে প্রাথমিকভাবে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক মি ইসলাম বলেন, “দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন সুসংগঠিত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা। সামনের দিনগুলোতে সারা দেশের জেলা ও কলেজগুলোতে কমিটি করা হবে।”
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, রাস্তায় আন্দোলনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফোরামে কোটা সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়েও দাবি তুলে ধরবেন তারা।
হঠাৎই বৈঠকে সরকারের মন্ত্রীরা
সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ দিন সংবাদ সম্মেলন খুব অল্প সময়ের জন্য হয়।
সংবাদ সম্মেলন শেষে দপ্তর কক্ষে চলে যান ওবায়দুল কাদের।
সেখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
দপ্তর কক্ষে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাদের দুজনকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। বেলা দেড়টার দিকে আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডি কার্যালয়ে যান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। একই সময়ে আসেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বেগম শামসুন্নাহার চাপা। তারা দুজনও যোগ দেন বৈঠকে৷
বৈঠক শেষে সাংবাদিকরা শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন কোটা বিরোধী আন্দোলন ইস্যুতে। তবে তারা স্পষ্ট কিছু বলতে রাজি হননি।
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, “যে বিষয়গুলো আলোচনা করেছি, আসলে সেগুলো নিয়ে এই মুহূর্তে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনার করার মতো কোনও বিষয় না।”
কোটা আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আদালতে যে বিষয়টি বিচারাধীন আছে, আমরা এ বিষয়ে এই মুহূর্তে তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। সেটা আদালতের বিষয়।”
২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় বিক্ষোভ হয়। কোটা-ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন তখনকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু তখন সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে) কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। সেই রিটের রায়ে চলতি বছরের ৫ জুন পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত।
পরে এই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু গত ৯ জুন প্রাথমিক শুনানির পর আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠানো হয়।
এই অবস্থায় কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত পহেলা জুলাই থেকে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা।