ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক ও সশস্ত্র সামরিক যানগুলোকে গাজা সিটির কাছাকাছি একটি প্রধান সড়কে দেখা গেছে।
গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণে যে সড়ক রয়েছে, সালাহ-আল-দীন নামের যে সড়ক দিয়ে হাজার হাজার মানুষ নিরাপদে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, সেই সড়কে ইসরায়েলি বাহিনীর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
বিবিসির যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি গাড়ির টিকে ট্যাঙ্কের গোলা ছোড়া হচ্ছে।
বিবিসির সংবাদদাতা পল অ্যাডামস বলছেন, বিস্তৃত স্থল অভিযানের অংশ হিসাবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যে গাজা দিকের দিকে মূল নজর দিচ্ছে, সেটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে।
ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক এমন এলাকায় দেখা গেছে, যে ওয়াদি গাজাকে উত্তরের একটি সীমানা হিসাবে বর্ণনা করে বাসিন্দাদের দক্ষিণে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। তারা আস্তে আস্তে তাদের স্থল অভিযানকে আরও বাড়িয়ে চলেছে।
সেই সঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলাও অব্যাহত রয়েছে। ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় তারা ছয়শর বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।
তারা দাবি করেছে, অভিযানের সময় তার বেশ কয়েকজন ‘সন্ত্রাসীকে’ হত্যা করেছে যারা বিভিন্ন ভবন ও টানেলে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিল।
গাজার সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম তীরেও। জেনিনের কাছাকাছি ফ্ল্যাশপয়েন্ট শহরে সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদের চার ব্যক্তিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। রবিবার রাতে তাদের হত্যা করা হয়। নিহতদের একজন জেনিন ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা বলে জানা যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রবিবার রাতে ইসরায়েলি একটি ড্রোন জেনিনের শরণার্থী ক্যাম্পের ভেতরে একটি বাড়িতে আঘাত করে। এরপর ইসরায়েলি সৈন্য এবং ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীদের মধ্যে অনেকক্ষণ গোলাগুলি চলে। এরপর ইসরায়েলি বুলডোজার এসে ক্যাম্পের প্রবেশ পথ গুড়িয়ে দেয়। সেই সময় বেশ কয়েকটি দোকানও ভেঙ্গে দেয়া হয়।
‘’এটা যেন গাজার মতোই পরিস্থিতি,’’ একজন সাংবাদিক বলেছেন।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাতই অক্টোবরের পর থেকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী এবং বসতি স্থাপনকারীদের হাতে ১২০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। বেশ কিছু ফিলিস্তিনি কম্যুনিটিকে বসতি স্থাপনকারীরা জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য জরুরি কোবরা কমিটির বৈঠক ডেকেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। ওই যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাজ্যে ইহুদি বিরোধী এবং মুসলিম বিরোধী যেসব ঘটনা বেড়ে চলেছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখপাত্র।
গাজায় থাকা ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট বলেছে, ইসরায়েল তাদেরকে গাজার গুরুত্বপূর্ণ আল কুদস হাসপাতাল খালি করার নির্দেশ দিয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, এই হাসপাতালটির নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট আইসিইউতে রোগী রয়েছে। সেই সাথে ইনিকউবেটরে নবজাতক শিশু রয়েছে। তাদেরকে সরিয়ে নেয়া অসম্ভব বলে জানিয়েছে রেড ক্রিসেন্ট।
এছাড়া হাসপাতালটিতে প্রায় ১৪ হাজার বেসামরিক নাগরিক আশ্রয় নিয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
হাসপাতালের ওই এলাকাটিতে প্রায় সারা দিনই বিমান হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। তারা দাবি করেছে, রবিবার ‘কয়েক ডজন সন্ত্রাসীকে’ হত্যা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।
এর আগে মিশর থেকে ১০টি ত্রাণবাহী ট্রাককে গাজায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। আগের দিন হাজার হাজার মানুষ জরুরি খাবারের জন্য ডিপোতে হামলা চালায়।
গত সাতই অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকেই গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে আসছে তেল আবিব।
ওই হামলায় ১৪০০ মানুষ নিহত এবং ২২০ জনের মত মানুষকে জিম্মি করা হয়।
গাজায় থাকা হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের বোমা হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত আট হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
গাজার হাসপাতালে সবাই ভীত- চিকিৎসক
গাজার উত্তরাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ আল-কুদস হাসপাতাল এলাকায় বোমা হামলার বিষয়ে বিবিসি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।
রবিবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী হাসপাতালটি খালি করার নির্দেশ দিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছে।
কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নেয়া শত শত রোগীকে স্থানান্তর করাটা সম্ভব হবে না।
হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বিবিসি নিউজ টুনাইটকে এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়েছেন, “আল-কুদস হাসপাতালের দৃষ্টি সীমার মধ্যেই এখন বোমা নিক্ষেপ শুরু হয়েছে।”
“সবাই, সবাই, বিশেষ করে শিশুরা ভীত সন্ত্রস্ত,” তিনি বলেন। “তারা হাসপাতালের পেছনে আবাসিক ভবনে বোমা হামলা চালিয়েছে।”
এর আগে আমরা গাজার একজন বাসিন্দার কাছ থেকে একটি ‘ভয়েজ নোট’ বা ‘কণ্ঠ বার্তা’ পেয়েছি, যেখানে তিনি বলেছেন, “তারা দুটি আবাসিক টাওয়ারে বোমা হামলা চালিয়েছে। এখন তৃতীয় আরেকটি টাওয়ার হামলা চালাচ্ছে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।”
ধারণা করা হচ্ছে, ভিডিও ফুটেজটি হাসপাতালের ভেতর থেকে ধারণ করা হয়েছে।
যেখানে দেখা যাচ্ছে কক্ষগুলো ধুলায় পূর্ণ হয়ে গেছে আর জানালা গুলো উড়ে গেছে।
বোমা নিক্ষেপ থেমে নেই
বিবিসির প্যাট্রিক জ্যাকসন বলেন, তিনি যে লাইভ ভিডিও ফুটেজ দেখছিলেন সেখান থেকে দূরে গাজা শহর দেখা যাচ্ছিল।
আর সেখানে বোমা নিক্ষেপের কানে তালা লাগানো আওয়াজ একটানা চলেই যাচ্ছিল।
মাঝে মাঝে রাতের আঁধারে আকাশে কমলা রঙের আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছিল।
ইসরায়েল বলেছে যে, শুধু শনিবারেই তারা হামাসের সাড়ে চারশোর বেশি স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
এসব স্থাপনার মধ্যে কমান্ড সেন্টার থেকে শুরু করে টহল পোস্ট পর্যন্ত সবই রয়েছে।
‘ইসরায়েল থেকে যাওয়া ফ্লাইট পৌঁছানোর’ আগে রুশ বিমানবন্দরে হামলা
রবিবার ইসরায়েলের তেল আবিব থেকে একটি ফ্লাইট রাশিয়ার দাগেস্তান অঞ্চলের একটি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর আগে আগে সেখানে হামলা চালায় দাঙ্গাকারীরা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত কিছু ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, অনেক মানুষের একটি জটলা যাদের কেউ কেউ ফিলিস্তিনি পতাকা বহন করছেন।
তারা মাখাচকালা বিমানবন্দরের টার্মিনাল দিয়ে দৌড়ে জোর করে দরজা খুলে রানওয়েতে ঢোকার চেষ্টা করছে।
অন্যদের কেউ কেউ বিমানবন্দরের বাইরে গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের কাছে কাগজপত্র দেখতে চাইছে। মূলত তারা ইসরায়েলি পাসপোর্টধারীদেরই খুঁজছিল।
সন্দেহ করা হচ্ছে, গাজায় চলমান সংঘাতের কারণে ক্ষোভ থেকে এই জনতা ইসরায়েলি বা ইহুদী যাত্রীদের উপর হামলা চালাতে চাইছিল।
দাগেস্তান রাশিয়ার একটি সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হলেও এটি দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত, যার বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সরকার বলেছে, “যেকোন জায়গায় ইসরায়েলি নাগরিক এবং ইহুদিদের ক্ষতি করার চেষ্টাকে” গভীরভাবে গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ্য করছে দেশটি।
বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসরায়েল আশা করে, ইসরায়েলি নাগরিক এবং ইহুদিরা রাশিয়ার যেখানেই থাকুক না কেন, রুশ আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সেই সাথে দাঙ্গাবাজ এবং ইহুদি ও ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে লাগামহীন আইন বহির্ভূত আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।”
দাগেস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেছেন, এ ঘটনায় বেশ কয়েক জন আহত হয়েছে এবং তারা চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত আর কিছু জানান নি।
স্থানীয় গভর্নর সের্গেই মেলিকভ বলেন, গাজার মানুষদের “এমন দুর্দশার জন্য দাগেস্তানের সব বাসিন্দা সমবেদনা জানাচ্ছে”।
একই সাথে তিনি দাঙ্গার এই ঘটনাকে ‘গর্হিত কাজ’ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি যথাযথভাবে সামাল দিবে।”
নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
রবিবার সন্ধ্যায় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিমানবন্দর থেকে ‘অনুমোদনহীন নাগরিকদের’ সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং আগামী ছয়ই নভেম্বর পর্যন্ত বিমানবন্দর বন্ধ থাকবে বলেও জানানো হয়।
ইসরায়েল বা গাজায় মার্কিন সেনা নয়- কামালা হারিস
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কামালা হারিস আবারো জোর দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েল বা গাজায় সেনা পাঠানোর কোন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা নেই তার দেশের।
সিক্সটি মিনিটসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ইসরায়েল বা গাজায় কোন সেনা পাঠানোর কোন ইচ্ছা বা কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই।”
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে উপদেশ, সরঞ্জাম এবং কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে সাহায্য করছে।
“প্রশ্নাতীতভাবে ইসরায়েলের নিজের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। এটাও বলা হচ্ছে যে, হামাস এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে যাতে মিলিয়ে ফেলা না হয় – সেটি নিশ্চিত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ,” তিনি বলেন।
“ফিলিস্তিনিরাও সমানভাবে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, আত্ম-সংকল্প এবং মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। আর আমরা বরাবরই স্পষ্ট করেছি যে, যুদ্ধের নিয়ম যাতে মেনে চলা হয় এবং মানবিক ত্রাণ সহায়তার সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।”
তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত আরো বেড়ে যাওয়াটা প্রতিরোধ করতে চায় এবং তিনি সতর্ক করে বলেন, ইরান যাতে এতে না জড়ায়।
‘দুই আলাদা রাষ্ট্রের সমাধান’ চান অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীরা
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ছয় জন প্রধানমন্ত্রী দুই রাষ্ট্রের সমাধানের পক্ষে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ‘ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ভিত্তি হচ্ছে’ এই দুই রাষ্ট্র সমাধান।
সোমবার সকালে প্রকাশিত বিবৃতিতে গত সাতই অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার নিন্দা জানানো হয় এবং গাজায় থাকা হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্তির আহ্বান জানানো হয়।
বিবৃতিতে সই করেন জন হাওয়ার্ড, কেভিন রাড, জুলিয়া গিলার্ড, টনি অ্যাবট, ম্যালকম টার্নবুল এবং স্কট মরিসন। পল কিটিং হচ্ছেন একমাত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী যিনি এতে সই করেননি।
বিবৃতিতে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উত্তেজনার বিষয়টি তুলে ধরা হয় এবং অস্ট্রেলিয়ানদের পরস্পরকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়।
এতে বলা হয়, “আমাদের হৃদয় যদি ঘৃণায় পরিপূর্ণ থাকে, তাহলে আমরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডই করবো।”
এই প্রধানমন্ত্রীরা মানবিক প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন যাতে করে ফিলিস্তিনিরা ত্রাণ পায়।