ঘটনা ধামাচাপা দিতে কেনা হয়েছিল সোনা

 

বিমানবন্দরের কাস্টমস গোডাউন থেকে স্বর্ণ আত্মসাতের বিষয়টি প্রায় বিশ দিন আগেই জানতে পারেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। জানার পর আত্মসাৎকারীদের খুঁজে বের না করে প্রথমে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এজন্য খোলা বাজার থেকে প্রায় ১৫০ ভরি স্বর্ণ কিনে গোডাউনে রাখা হয়। পরে যখন বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের বার ও স্বর্ণালঙ্কার উধাও হওয়ার বিষয়টি বেরিয়ে আসে, তখন আর কেউ দায়িত্ব নিতে চায়নি। পরবর্তীতে চুরির নাটক সাজিয়ে থানায় মামলা করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও কাস্টমস সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে বিমানবন্দরের কাস্টমস হাউজ থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ উধাওয়ের আলোচিত ঘটনার মামলাটি থানা পুলিশের কাছ থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চার জন সিপাহীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা হেফাজতে নিয়েছে। তবে এই ঘটনায় এখনও কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করা হয়নি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আকরাম হোসেন জানান, স্বর্ণ চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে থানা পুলিশ যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, আমরাও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তাদের দেওয়া তথ্য যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ১৭ আগস্ট বিমানবন্দর কাস্টমস হাউজের গোডাউনে রাখা ৬টি ডিএম বা চালানের মাধ্যমে জব্দ হওয়া স্বর্ণ খোয়া যাওয়ার বিষয়টি কাস্টমস কর্মকর্তাদের মধ্যে জানাজানি হয়। বিষয়টি জানার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দায়িত্বরত দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম শাহেদকে স্বর্ণ বুঝিয়ে দিতে বললে তারা গড়িমসি শুরু করেন। গোডাউন থেকে স্বর্ণ লুটপাটের বিষয়টি বিমানবন্দরে কর্মরত অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যেও জানাজানি হলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও নির্দেশে লুটপাট করা চক্রটি রাজধানীর স্বর্ণের মার্কেট থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা দিয়ে ১৫০ ভরি স্বর্ণ কিনে ভল্টে ঢুকিয়ে রাখেন। কিন্তু এরপরই মূলত কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ছয়টি ডিএম বা চালানের স্বর্ণ আগের পরিমাণে রাখার পর অন্যান্য চালানের মাধ্যমে জব্দ করা স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার পরীক্ষা করা শুরু হয়। এসময় জানা যায়, শুধু ছয়টি ডিএম থেকে নয়, আরও অসংখ্য চালান থেকে স্বর্ণ গায়েব করা হয়েছে। এরপর তারা চালানে উল্লেখিত পরিমাণ স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার পরীক্ষা করে দেখেন শুধু ১৫০ ভরি নয়, ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। এত পরিমাণ স্বর্ণ গায়েব দেখে আর কোনও কাস্টমস কর্মকর্তা বিষয়টি সুরাহা করার দায়িত্ব নিতে চায়নি। বিষয়টি পুলিশকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় স্বর্ণ আত্মসাৎকারী চক্রের সদস্যরা চুরির নাটক সাজায়।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনার পরপরই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা গোডাউনের ভাঙ্গা আলমারি থেকে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছে। এছাড়া যেসব জিনিসপত্র দিয়ে আলমারি ভাঙা হয়েছে তারও ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা গেছে, আলমারি ভাঙ্গার জন্য গোডাউনের ভেতরেই সরঞ্জাম রক্ষিত ছিল।

দায়িত্বশীল একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বাইরের চোর চক্রের কারও জানার কথা নয় যে ভেতরে আলমারি ভাঙার সকল জিনিস মজুত রয়েছে। বাইরের কোনও চোর চক্র হলে তারা আলমারি ভাঙার জিনিসপত্র বা কাটার মেশিন নিয়ে প্রবেশ করতো। ভেতরের লোকজন নিজেদের কাটার মেশিন দিয়ে আলমারি ভেঙ্গে স্বর্ণ চুরির গল্প সাজিয়েছে। আর একসঙ্গে এত স্বর্ণ বের করাও কঠিন। আত্মসাৎকারীরা দীর্ঘ দিন ধরে অল্প অল্প করে স্বর্ণ বাইরে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যে আলোচিত এই ঘটনায় দুই কাস্টমস কর্মকর্তাসহ তিনজনকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তারা হলো- সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম শাহেদ ও সিপাহী নিয়ামত হাওলাদার। বিমানবন্দর থানায় মামলার প্রেক্ষিতে তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে থানা পুলিশ। শহিদুল ও শাহেদ দীর্ঘ দিন ধরে গোডাউনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেওয়া তথ্যে ব্যাপক গড়মিল পেয়েছে পুলিশ। তাদের সঙ্গে সিপাহী নিয়ামত হাওলাদারও জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তাদের আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

কাস্টমস সূত্র জানায়, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম শাহেদ বিমানবন্দর কাস্টমস হাউজের এক শীর্ষ কর্মকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। তাদের ভয়ে তটস্থ থাকতেন অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। শীর্ষ কর্মকর্তার আশকারা পেয়েই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেন। বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের বার ও স্বর্ণালঙ্কার লুটের ঘটনায় একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্র জানায়, সুরক্ষিত ভল্ট থেকে স্বর্ণ লুটের বিষয়টি সকলের মধ্যে জানাজানি হয় গত রবিবার। এ ঘটনায় চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চার সিপাহীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। পরে শুল্ক বিভাগ একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

উল্লেখ্য, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ঢাকা কাস্টম হাউজের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি ৫০১ গ্রাম সোনা খোয়া গেছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৫০ কোটি টাকারও বেশি। সাধারণত বিমানবন্দরে যাত্রী কিংবা চোরাচালানকারীদের কাছ থেকে জব্দ করা স্বর্ণের বার ও অলংকারসহ মূল্যবান জিনিস এই গুদামে রাখা হয়। গুদামে রক্ষিত স্বর্ণের হিসাব মেলাতে গিয়েই ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে।

source: Bangla Tribune

এই পোস্টটি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে ফেইসবুক পেজটি লাইক দিন এবং এই রকম আরো খবরের এলার্ট পেতে থাকুন

 আরো পড়তে পারেন:  

Loading...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *