সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রধান একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী মারা গেছেন।
তিনি ঢাকার উত্তরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাত সোয়া তিনটায় মৃত্যুবরণ করেন বলে তার প্রেস সচিব জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন।
ফুসফুস সংক্রমণের পর গত দোসরা অক্টোবর তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। মি. চৌধুরী আগে থেকেই ‘স্কিমিক হার্ট ডিজিজে’ ভুগছিলেন।
রাজনীতিতে একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পরিচিতি শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে।
কিন্তু ২০০২ সালে সে দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল গঠন করেন তিনি। যদিও গত দুই দশকেও তার নতুন দলটি বড় সাড়া জাগাতে সফল হয়নি।
তবে রাজনীতিতে একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বরাবর ছিলেন আলোচিত এক চরিত্র।
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া বলছে, বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১৯৭৯ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, যখন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন।
তিনি ছিলেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব।
সেসময় মানে ১৯৭৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
মি. চৌধুরী জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়া – দুই সরকারের সময়ই মন্ত্রী ছিলেন, এবং বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা, শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, কিন্তু তিনি হঠাৎ করে রাজনীতিতে এসেছিলেন।
তিনি বলছেন, “রাজনীতি করার ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকায় তার মধ্যে প্রচলিত অর্থে রাজনীতিবিদ সুলভ আচরণ কম দেখা যেত। তিনি বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পর্যায় পর্যন্ত পৌছাতে পেরেছিলেন।
রাজনীতিতে নিজেকে ব্যতিক্রম হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট হবার পর।”
যদিও সেটি বিএনপি মেনে নেয়নি।
রাষ্ট্রপতি হওয়া-পদত্যাগ, এবং বিএনপির ক্ষোভ
মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে তিনি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুইবার জাতীয় সংসদের উপনেতা এবং একবার বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে তিনি খালেদা জিয়ার সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান।
এরপর ২০০১ সালের ১৪ই নভেম্বর বাংলাদেশের ১৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শুরু করেন।
ওই সময় শপথ গ্রহণের আগে তিনি বিএনপির সকল পদ ও দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “মি. চৌধুরীর রাজনীতিতে অভিষেক ছিল নাটকীয়, কিন্তু বিএনপি থেকে তার প্রস্থান ছিল ‘বিয়োগান্তক’।”
কিন্তু, তারপরেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন মি. চৌধুরীকে একজন ব্যতিক্রমী চরিত্র হিসেবে মনে রাখবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
ছবির উৎস, Getty Images
বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট হবার পর এমন নাটকীয় পদত্যাগের ঘটনা আর ঘটতে দেখা যায়নি।
২০০২ সালের ২১শে জুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন মি. চৌধুরী।
সেসময় বিএনপি সংসদে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিল।
তার আগে বিএনপির সংসদীয় দলের বৈঠকে অনেক সংসদ সদস্য দাবী তোলেন যে রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী পদত্যাগ করুন। অন্যথায় তাকে ইমপিচ করার হুমকি দেন তাঁরা।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার মাত্র সাত মাস সাত দিনের মাথায় বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে কেন বিদায় নিতে হয়েছিল, তার নানাবিধ কারণ উল্লেখ করে তখনকার সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল।
যেসব কারণের কথা ওইসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে:
* জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর সমাধিতে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদন না করা।
* রাষ্ট্রপতির বাণীতে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা।
* বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে মুন্সিগঞ্জে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতির ছেলে এবং সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরীর তোরণ নির্মাণ।
* রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তব্যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ব্যবহার না করা, কারণ ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বিষয়টি বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করে।
* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফতাব আহমদকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর না করা। অধ্যাপক আফতাব আহমদের নাম প্রধানমন্ত্রীর দফতর অনুমোদন করেছিল।
রাষ্ট্রপতি সেই ফাইলে স্বাক্ষর না করায় পরবর্তীতে আফতাব আহমদকে বাদ দিয়ে অধ্যাপক জিন্নাতুননেসা তাহমিদা বেগমকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
* রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনে’ রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বেশি সময় পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তোলেন বিএনপির কিছু নেতা। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির কভারেজ কমিয়ে দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বিটিভিকে বলা হয়েছিল – এমন খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে।
* তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য এক মাস আমেরিকায় অবস্থান করে দেশে ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি কোন খোঁজ-খবর নেননি।
* দলের মনোনীত হয়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মি. চৌধুরীর নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়া।
* রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ব্যয় বাড়ানো।
* সেনাবাহিনীসহ কয়েকটি বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেন রাষ্ট্রপতি।
* রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বাইরে অধিক সংখ্যক জাতীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া।
* বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন নিয়ে সরকারের একটি মহল থেকে আপত্তি এলে তা পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তোলে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগের পর তিনি বিএনপি কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন।
এরপর ‘বিকল্পধারা বাংলাদেশ’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি।
তবে দলগঠনের পর দেশজুড়ে সংগঠনের কার্যক্রম বিস্তৃত বা জনপ্রিয় করতে পারেননি তিনি, লেখক মহিউদ্দিন আহমদ যাকে বলছেন বাংলাদেশের দ্বি-দলীয় রাজনীতির কাঠামোর ফল।
“বাংলাদেশে দ্বি-দলীয় রাজনীতির বাইরে ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারার নজির তেমন নেই। মি. চৌধুরী মেজর মান্নানকে নিয়ে রাজনৈতিক দল শুরু করেছিলেন, তিনিও ফুলটাইম রাজনীতিবিদ ছিলেন না।
আর ছিল উনার (মি. চৌধুরী) ছেলে, যে বয়সে ও প্রজ্ঞায় নবীন। ফলে শুরু থেকেই ব্যাপকতা অর্থে দলের সাফল্য নিয়ে হয়ত খুব বড় সম্ভাবনা ছিল না,” বলেন মি. আহমদ।
কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের সময় বড় দলগুলোর সাথে জোটগঠনে ভূমিকা রেখেছে বিকল্পধারা বাংলাদেশ।
ছবির উৎস, Getty Images
তার নেতৃত্বে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটে যোগ দিয়েছিল বিকল্পধারা বাংলাদেশ। যদিও পরে সে ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
সবশেষ, ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচন যেটিতে বিএনপি অংশ নিয়েছিল, সেসময় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির সাথে যোগ না দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন মি. চৌধুরী ও তার দল বিকল্প ধারা বাংলাদেশ।
চিকিৎসক উপস্থাপক পরিচয়
রাজনীতিতে সক্রিয় হবার আগে থেকেই চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন মি. চৌধুরী।
এছাড়া ভালো ছাত্র এবং উপস্থাপক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি।
সাবেক সংসদ সদস্য এবং লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী পান্না কায়সার সম্পর্কে মি. চৌধুরীর আত্মীয়।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, মি. চৌধুরী ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত একজন মানুষ। যেকোন সামাজিক অনুষ্ঠানে আসর জমাতে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল।
“খুব সহজেই হাসি দিয়ে তিনি সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। যে কোন বিষয় নিয়ে গল্প বলতে পারতেন, ঠাট্টা করতে পারতেন—মানে ভীষণ প্রাণবন্ত একজন মানুষ ছিলেন তিনি।”
মি. চৌধুরী ১৯৩২ সালের ১লা নভেম্বর কুমিল্লায় নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এবং ব্রিটেনের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
ছবির উৎস, Getty Images
তিনি এডিনবার্গ, লন্ডন ব্রোম্পটন চেস্ট ইন্সটিটিউট, লন্ডনের হ্যামার স্মিথ পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল স্কুল থেকে স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা গ্রহণ করেন।
বদরুদ্দোজা চৌধুরী এম.বি.বি.এস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন, পরবর্তীতে তিনি একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
রাজনীতির বাইরে তিনি চিকিৎসকদের কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
‘টিউবারকিউলোসিস অ্যান্ড চেস্ট ডিজিজ’ নিয়ে বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের হয়ে যোগ দিয়েছেন, এবং এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বাংলাদেশে হেলথ এন্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নামে তার প্রতিষ্ঠিত একটি ট্রাস্টের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন।
এই ট্রাস্টের মাধ্যমে দেশের প্রথম মহিলা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি নিজের চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখতেন।