বাংলাদেশে প্রায়ই ভুল চিকিৎসা বা অবহেলাজনিত কারণে রোগী মৃত্যুর অভিযোগ করেন স্বজনরা। তবে, দেশটির আইনি কাঠামোতে চিকিৎসকদের দায়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো কিছু বলা হয়নি। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৮০ এবং ৮৮ ধারাতে ‘সরল বিশ্বাসে পরিচালিত চিকিৎসাকার্যে’ সংঘটিত দুর্ঘটনার দায় থেকে চিকিৎসককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে অভিযোগ করার একমাত্র জায়গা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।
বিএমডিসির নিয়মানুযায়ী, কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তা অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে জবাব দেয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির উত্তর অভিযোগকারীকে জানানো হবে।
তিনি তা গ্রহণ না করলে তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত চিকিৎসকের লাইসেন্স স্থগিত করার বিধান রয়েছে।
তবে, বাংলাদেশের আইনজীবীরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা বিএমডিসির এই প্রক্রিয়া জানে না বা এর মধ্য দিয়ে যায় না। আইনে চিকিৎসকদের দায় নিয়ে স্পষ্টভাবে কোনো কিছু বলা হয়নি।
সুপ্রিম কোর্ট ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড ট্রাস্টের আইনজীবী অনিক আর হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এ ধরনের ক্ষেত্রে খুব বেশি হলে বিএমডিসিতে অভিযোগ করা যায়। তদন্ত কমিটিতে চিকিৎসকরাই থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণ হয় না।”
“ভুক্তভোগী তখন বাধ্য হয়ে হাইকোর্টে রিট করে। তবে, অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু হলে ফৌজদারি মামলা করার সুযোগ আছে,” বলেন মি. হক।
ভুল চিকিৎসা বা অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগে ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা এ রকম বেশ কয়েকটি রিট হাইকোর্টে বিচারাধীন বলে জানান তিনি।
এছাড়া “স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৩” নামে একটি আইনের খসড়া করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে, এটি এখনো আইনে পরিণত করা হয়নি।
এর খসড়াতেও চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে ফৌজদারি আইনে বিচার এবং আদালত কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলা হয়েছে।
এতে, হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানের এবং চিকিৎসা প্রদানকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে লাইসেন্স বাতিল ও চিকিৎসকের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশের কথা উল্লেখ আছে খসড়ায়।
এবং একইসাথে এ সকল অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনজীবীরা বলছেন, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৩৮ ধারাটি ডাক্তারি অবহেলা সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিকারের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ ধারায় উল্লেখ আছে, যে কোনো ধরনের বেপরোয়া কাজ বা অবহেলার কারণে আঘাত দিলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা দুটি একসঙ্গে দেওয়া যাবে।
তবে, বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনায় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা নিষ্পত্তি হয় না বলে জানাচ্ছেন আইনজীবীরা। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির মতো কর্মসূচিও দিতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়।
ভারতের আইনে চিকিৎসা অবহেলা নিয়ে যা আছে
ভারতের আদালত চিকিৎসায় অবহেলা নিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে।
এর মধ্যে কুসুম শর্মা বনাম বাট্রা হাসপাতালের মামলাটি উল্লেখযোগ্য। কারণ এ মামলায় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ নির্ধারণে ১১টি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
ভারতে চারভাবে চিকিৎসায় অবহেলার প্রতিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
ফৌজদারি দায়বদ্ধতার অধীনে অবহেলা, দেওয়ানি দায়বদ্ধতার অধীনে অবহেলা, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং ভোক্তা সুরক্ষা আইনের অধীনে অবহেলা।
ভারতের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী, অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
একইসাথে আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য যথাযথ সিভিল কোর্টে যাওয়ার বিধান রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের বিভিন্ন ধারায় ভুক্তভোগীকে এক কোটি থেকে দশ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশের মতোই ভারতে “ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল” রয়েছে যারা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়।
চিকিৎসকদের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারে এই প্রতিষ্ঠান।
থাইল্যান্ডের আইনে যা রয়েছে
বাংলাদেশের জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে যায়। সে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় দুইটি আইনের কথা বলা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট “দ্যা মেডিকেল কাউন্সিল অব থাইল্যান্ড” এ দুই আইনের কথা বলা হয়েছে।
চিকিৎসকরা কীভাবে প্রাকটিস করবে, রোগীদের সাথে কেমন ব্যবহার করবেন এবং চিকিৎসায় অবহেলার জন্য তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা বলা হয়েছে আইন দুইটিতে।
“দ্যা মেডিকেল কাউন্সিল রেগুলেশনস অন মেডিকেল এথিকস প্রিজারভেশন ২০০৬” এ চিকিৎসকরা কীভাবে প্র্যাকটিস করবেন, রোগীদের সাথে কেমন আচরণ করবেন, অন্য চিকিৎসক বা সহকারীদের সাথে কেমন আচরণ করবেন প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
এই আইনের কয়েকটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, চিকিৎসকরা স্বাভাবিকের চাইতে অতিরিক্ত মজুরি নিতে পারবেন না।
নিজের সুবিধার জন্য চিকিৎসক রোগীদের কোনো চিকিৎসা নিতে প্ররোচিত করতে পারবেন না।
একজন চিকিৎসককে অনুরোধ করা হলে এবং তার সামর্থ্যের মধ্যে থাকলে গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না।
“দ্যা মেডিকেল প্রফেশন অ্যাক্ট – ১৯৮২” এর মুখবন্ধে বলা হয়েছে, জনগণের সঠিক চিকিৎসা সেবা পেতে থাইল্যান্ডে চিকিৎসার প্র্যাকটিস আইন ও প্রবিধান দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই আইনে বলা হয়েছে, চিকিৎসা নৈতিকতা না মেনে চিকিৎসা করায় কোনো চিকিৎসকের দ্বারা কেউ যদি ভুক্তভোগী হয় সেক্ষেত্রে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মেডিকেল কাউন্সিলে অভিযোগ করার অধিকার যে কোনো ব্যক্তির রয়েছে।
তবে, ঘটনার এক বছরের মধ্যে এ ধরনের অভিযোগ দায়ের করতে বলা হয়েছে আইনে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঘটনার তদন্তে কমিটি গঠন করা হবে।
তদন্তের ফলাফলের উপর কমিটি পাঁচ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর মধ্যে অভিযোগ খারিজ করা, সতর্কতা, তিরস্কার করার মতো ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়াও তদন্ত কমিটি চাইলে অভিযুক্ত চিকিৎসকের লাইসেন্স স্থগিত করতে পারবেন তবে সেটি দুই বছরের বেশি নয়। থাইল্যান্ডের এই আইনে চিকিৎসকদের লাইসেন্স প্রত্যাহার করার বিধানও রয়েছে।
এই আইনের একটি ধারায় তিন বছরের বেশি নয় এমন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। একইসাথে ৩০ হাজার থাইল্যান্ডি বাথ পর্যন্ত জরিমানা করার বিধানও রয়েছে।
আরেকটি ধারায়, এক বছর বা তার বেশি নয় এমন কারাদণ্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া জরিমানা হিসেবে দশ হাজার বাথ বা তার বেশি নয় এমন শাস্তির বিধান রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের আইনে যা রয়েছে
যুক্তরাজ্যে চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করে জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল এবং হাসপাতালগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে কেয়ার কোয়ালিটি কমিশন।
দেশটিতে চিকিৎসায় অবহেলা হলে কঠোর আইনের বিধান রয়েছে। এটি “মেডিকেল ম্যানস্লটার ল” নামেই বেশি পরিচিত।
আইনটি অনেক পুরনো হলেও ২০১৮ সালে এটি সেদেশের পার্লামেন্ট রিভিউ করে।
দেশটিতে কোনো রোগী যদি অভিযোগ করে সেক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে চিকিৎসকের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল।
লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন বিভাগের ক্লিনিক্যাল লেকচারার মনজুর শওকত বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি স্বাধীন কমিটি তদন্ত করে বড় ধরনের কোনো ভুল বা অবহেলা হয়েছে কিনা। এটি প্রমাণিত হলে লাইসেন্স বাতিল এবং দুই থেকে দশ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।”
বাংলাদেশে আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করে আইনপ্রণেতা, চিকিৎসকসহ সকলকে সাংঘর্ষিক অবস্থায় না গিয়ে জনগণকে রক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করার আহ্বান জানান মি. শওকত।
“এ ধরনের দুর্ঘটনায় একটি স্বাধীন কমিটি করে দায়িত্ব গাফিলতি আছে কিনা তা তদন্ত করা প্রয়োজন”।
চিকিৎসকদের উপযুক্ত ট্রেনিং, দেশের আইনকেও যুগোপোযোগী করা উচিত বলে মনে করেন মি. শওকত।