প্রায় ৮০ বছর বয়সে, গত মাসে মারা গেলেন বুধনি মেঝান। খুব বেশি মানুষ তাকে মনে রাখেন নি। তিনি যে বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, সেটাই বা ক’জন জানতেন?
একটি বিখ্যাত জাতীয় ইংরেজি দৈনিক তো সেই ২০১২ সালেই তাকে মৃত বলে খবর দিয়ে ফেলেছিল।
আবার গত ১৭ই নভেম্বর মৃত্যুর পরে তাকে নিয়ে লেখা হতে শুরু করল, যে তিনি ছিলেন ‘নেহরুর প্রথম আদিবাসী স্ত্রী’।
এই অপমানজনক তকমাটা মিসেস মেঝান অবশ্য বয়ে বেড়িয়েছেন গত ৬৪ বছর ধরেই।
স্বাধীন ভারতের প্রথম বহুমুখী নদী প্রকল্প – দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনার অন্তর্গত পাঞ্চেত বাঁধের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করতে মি. নেহরু সেখানে এসেছিলেন ১৯৫৯ সালের ছয়ই ডিসেম্বর।
ওই প্রকল্পটি যে বৃহৎ সরকারি সংস্থাটির অধীন, সেই দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন বা ডিভিসি কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানানোর জন্য বেছে নিয়েছিল বুধনি মেঝান এবং আরও এক আদিবাসী রমণীকে।
প্রধানমন্ত্রী নেহরুর গলায় একটা মালা পড়িয়ে ছিলেন মাত্র ১৫ বছর বয়সী বুধনি মেঝান, আর তারপর সেই মালাটিই আবার স্নেহের বশে কিশোরী বুধনির গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলেন মি. নেহরু।
তাকে দিয়েই বোতাম টিপে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন করিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ওই ঘটনাটা যেমন স্বাধীন ভারতের উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নের শুরু করেছিল, বুধনি মেঝানের জীবনটা সেদিনই বদলিয়ে গিয়েছিল।
সমাজচ্যুত বুধনি মেঝান
ওই দিন থেকেই বুধনি মেঝানের নতুন জীবন শুরু ‘নেহরুর প্রথম আদিবাসী স্ত্রী’ তকমা নিয়ে।
সাঁওতালি সমাজের রীতি অনুযায়ী কাউকে মালা পড়ালে তার সঙ্গেই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর জওহরলাল নেহরু যতই দেশের প্রধানমন্ত্রী হোন, তিনি সাঁওতালি সমাজে বাইরের মানুষ। সমাজের বাইরে কাউকে বিয়ে করলে তাড়িয়ে দেওয়ার কঠোর নিয়মও আছে।
সেই ছয়ই ডিসেম্বর, ১৯৫৯ সাল সন্ধ্যায় এক কাপড়ে সমাজ, ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন ১৫ বছরের বুধনি মেঝান।
তার সম্বন্ধে যে খুব বেশি কিছু জানা যায়, তা নয়। তার নামে একটি উইকিপিডিয়া পাতা তৈরি হয়েছে গত মাসে তার মৃত্যুর পরে। টুকরো টুকরো তথ্য নানা সময়ে খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে।
এই আদিবাসী নারীর সম্বন্ধে তথ্যের খোঁজ করতে গিয়েই কেরালার বাসিন্দা লেখিকা সারা যোসেফ বুধনি মেঝানকে নিয়ে একটা বই লিখে ফেলেন।
মিজ যোসেফ বলছিলেন যে, ২০১৯ সালে প্রথমবার যখন বুধনি মেঝানের সঙ্গে তার দেখা হয়, তারা একে অপরের ভাষা বুঝতে পারছিলেন না।
“কিন্তু আমি তাকে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলাম,” বলছিলেন মিজ যোসেফ।
ঝাড়খণ্ডের কয়লা-শহর ধানবাদে বড় হয়েছিলেন বুধনি মেঝান।
তার মতো কয়েক হাজার স্থানীয় মানুষকে ডিভিসির প্রকল্পে চাকরি দেওয়া হয়েছিল।
ওই বাঁধ নির্মাণের জন্য হাজার হাজার আদিবাসী মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল তাদের পূর্বপুরুষের জমি থেকে। প্রকল্প সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কাবোনা সহ কয়েকশো গ্রাম ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই বাঁধের জমা জলে।
এই কাবোনাতেই থাকতেন বুধনি মেঝান – সমাজ তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার আগের দিন পর্যন্ত।
মোড়লের হুকুম
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যে বুধনি মেঝানকে মালা পরিয়ে দিয়েছেন, সেই খবর গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিল।
সন্ধ্যায় গ্রামে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই মোড়ল ডেকে পাঠান বুধনিকে। জানিয়ে দেওয়া হয় যে মি. নেহরুর গলায় মালা পরিয়ে দেওয়ায় তিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী। সমাজের বাইরে বিয়ে করার জন্য রীতি অনুযায়ী সাজাও পেতে হবে বুধনিকে।
সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে গ্রাম থেকে।
এমনিতে সাঁওতাল সমাজ বেশ শান্তিতেই বাস করে, কিন্তু কঠোর রীতি নীতি মেনে চলে এই সমাজ।
এই আদিবাসী সমাজে পুরুষরা কাজ করতে বাইরে যান, কিন্তু অবিবাহিত নারীরা গ্রাম ছেড়ে বাইরে কাজে যাচ্ছেন, এরকম ঘটনা খুবই কম দেখা যায়।
বুধনি মেঝান জানতেন যে তিনি যদি গ্রাম ছেড়ে চলে যান, জীবনেও আর ফিরতে পারবেন না সেখানে।
মোড়লের হুকুমের প্রতিবাদ করেছিলেন, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু সমাজের নির্দেশই চূড়ান্ত, তার নড়চড় হওয়ার উপায় নেই।
মিজ যোসেফের কথায়, “কেউ তার পাশে দাঁড়ায় নি। নিজের সমাজের মানুষের কাছ থেকেই তিনি খুনের হুমকি পর্যন্ত পেয়েছেন।“
বাধ্য হয়েই ১৫ বছরের কিশোরী তার সামান্য জিনিষপত্র নিয়ে গ্রাম থেকে চলে যান।
‘সেই সাঁওতাল কিশোরী’
বাঁধ উদ্বোধনের যে সব খবর ছাপা হয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র একটি পত্রিকায় কিছুটা বড় করে লিখেছিল ‘ওই সাঁওতাল কিশোরী’র কথা। লেখা হয়েছিল যে তিনিই ভারতের প্রথম শ্রমিক, ‘যিনি একটি বাঁধ উদ্বোধন করলেন’।
এই সময় থেকেই ‘নেহরুর আদিবাসী স্ত্রী’ তকমা লাগল বুধনি মেঝানের গায়ে, জানাচ্ছিলেন মিজ যোসেফ।
বুধনি মেঝান অবশ্য এসবের কিছুই জানতেন না। তিনি তখন সমাজচ্যুত আর গ্রামছাড়া হয়ে লড়াই করছেন বেঁচে থাকার জন্য।
মিজ যোসেফের কথায়, “সবাই তার সম্বন্ধে কাগজে পড়ছিল, কিন্তু কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি।“
বছর তিনেক পরে, ১৯৬২ সালে বুধনি মেঝান করে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেয় দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন। কোনও কারণও দেখানো হয় নি।
দিন মজুরির কাজ নিয়েছিলেন বুধনি মেঝান।
ঘটনাচক্রে, মি. নেহরুর কানে কিন্তু এসব কিছুই পৌঁছয় নি। এটাও অদ্ভুত যে জওহরলাল নেহরুর নামটা ভারতে প্রগতিশীলতা আর আধুনিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তাকে জড়িয়েই এরকম একটা ঘটনা ঘটে চলেছিল।
অনেক বছর পরে, বুধনি মেঝানের জীবনে একটা আলোর রেখা হিসাবে উদয় হয়েছিলের একজন মানুষ – সুধীর দত্ত।
তিনি পশ্চিমবঙ্গের একটা কয়লা খাদানে কাজ করতেন। সেখানেই তখন থাকতেন বুধনি মেঝান।
দুজনের মধ্যে প্রথমে প্রেম আর তারপরে পরিণয় হয়।
যেভাবে চাকরি ফিরে পেলেন বুধনি মেঝান
দত্ত দম্পতির জীবন চলছিল দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেই। বুধনি মেঝান মাঝে মাঝে ব্যর্থ চেষ্টা চালাতেন যদি চাকরিটা ফিরে পাওয়া যায়।
তার কাহিনী নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ১৯৮৫ সালে দুজন সাংবাদিক খুঁজে পান বুধনি মেঝানকে।
সারা যোসেফ বলছেন, এই সাংবাদিকরাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, জওহরলাল নেহরুর নাতি, রাজীব গান্ধীর কাছে বিষয়টি জানান।
পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় পত্র পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল যে আসানসোলের সেই সময়ে কংগ্রেস থেকে যিনি সংসদ সদস্য ছিলেন, তিনি রাজীব গান্ধীর কাছে নিয়েও গিয়েছিলেন বুধনি মেঝানকে।
প্রায় দুই দশক পরে নিজের চাকরি ফিরে পান বুধনি মেঝান। অবসর নেওয়া অবধি ডিভিসিতেই কাজ করেছেন তিনি।
থাকতেনও পাঞ্চেতে ডিভিসির আবাসনেই। সেখানে, গত ১৭ই নভেম্বর মারা যান বুধনি মেঝান।
‘তার কী দোষ ছিল?’
মিজ যোসেফের প্রশ্ন, “তার কী দোষ ছিল? সেই প্রশ্নটার কোনও উত্তর নেই।”
বুধনি মেঝান অবশ্য পুরনো কথা মনে রাখেন নি। শান্তিতে জীবন কাটাতে ভয়ঙ্কর সেই অতীতকে ভুলতেই চেয়েছেন বুধনি মেঝান।
“আমার ঠাকুমার সঙ্গে যা হয়েছিল, সেটা তো অন্যায়। কিন্তু ঠাকুমা কোনও অনুযোগ করে নি, শান্তিতেই জীবন কাটিয়েছে,” বুধনি মেঝানের মৃত্যুর পরে তার নাতি বলেছিলেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজকে।
তিনি মারা যাওয়ার পরে ঝাড়খণ্ডের কেউ কেউ দাবী তুলছেন যেখানে জওহরলাল নেহরুর মূর্তি আছে, তার পাশে বুধনি মেঝানের একটা মূর্তিও বসানো হোক।
সারা যোসেফের মতে, মূর্তি বসালে অতীতের সেই ঘটনাটা বদলাবে না, কিন্তু তার কাহিনীটা জানা যাবে।
যে লড়াইটা তাকে করতে হয়েছে আরও হাজার হাজার ভারতীয় নারীদের মতোই, যাদের স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় সমাজের চাপ আর পিতৃতান্ত্রিক রীতি নীতির তলায়।
আবার উন্নয়ন আর দেশ গড়ার জন্য যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে উচ্ছেদ হতে হয়, আবার যাদের সবাই ভুলেও যায়, তাদেরও প্রতিনিধি বুধনি মেঝান।
মিজ যোসেফের কথায়, “উন্নয়নের শিকার হওয়া মানুষের প্রতীক ছিলেন তিনি। তাই রাজনৈতিক আর ঐতিহাসিক কারণেই তার কথা ফিরে মনে করা প্রয়োজন।“