“সারাবছর আমি ঠান্ডার দেশে থাকি। কিন্তু সেই ঠান্ডা আমার অতটা গায়ে লাগে না, যতটা এবার ঢাকায় আসার পর লাগছে”, বলছিলেন দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের দেশ ফ্রান্সে বসবাস করা আদনান রহমান।
প্রায় দু’বছর বাদে দুই মাসের ছুটি নিয়ে গত ডিসেম্বরে পরিবারের সাথে সময় কাটাতে দেশে এসেছেন তিনি। কিন্তু দেশে ফেরার পর শীতের তীব্রতা দেখে কিছুটা অবাক ঢাকার ইস্কাটনের বাসিন্দা আদনান।
তিনি বলেন, “দেশে আসলে আমি শীতের সময়টাতেই আসি। কারণ এই সময়ের ঢাকা মানেই– না গরম, না শীত। কিন্তু এবার আমার সেই ধারণা পাল্টে গেছে। বিশেষ করে, আজকে।”
সোমবার এই মৌসুমে ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সকাল ছয়টার দিকে ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দেশের ২১ জেলায় শৈত্যপ্রবাহ
গত কয়েকদিন ধরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের কিছুটা দেখা পাওয়া গেলেও সোমবার ফের কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে রাজধানী ঢাকা। সেইসঙ্গে রয়েছে কনকনে ঠান্ডা বাতাস।
কিন্তু, এই অবস্থা শুধুমাত্র ঢাকায় নয়; এদিন দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলাতেই শীতের আধিক্য ছিল।
আবহাওয়া অফিস বলছে, সোমবার দেশের মোট ২১ জেলার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে।
এই তালিকায় আছে ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও মাদারীপুর; খুলনার যশোর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা; রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের প্রায় সব জেলা।
এইসব জেলার বেশিরভাগ স্থানেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাওয়ার পরও সূর্য কিরণ দেখা যায়নি।
উল্লেখ্য, সোমবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে নওগাঁর বদলগাছী ও রংপুরের দিনাজপুরে, ৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শৈত্যপ্রবাহ কতদিন থাকবে?
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মঙ্গলবারও দেশের অনেক জেলার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাবে।
“আজকে তাপমাত্রা সারাদেশেই কম। গতকালের চেয়ে দুই-তিন ডিগ্রির মতো তাপমাত্রা কমেছে। সব জায়গায় কমেছে, এমন না। বেশিরভাগ জায়গায় কমেছে”, বলছিলেন আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক।
মঙ্গলবারও শৈত্যপ্রবাহ চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, “পরশুদিন থেকে তাপমাত্রা বাড়তির দিকে যাবে। কিন্তু পুরোপুরি শৈত্যপ্রবাহ কাটবে, এমন না।”
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আরেক আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবদুল মান্নানও জানান যে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই শৈত্যপ্রবাহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আরও দুই থেকে তিনদিন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এটাই কি মৌসুমের শেষ শৈত্যপ্রবাহ?
আবহাওয়াবিদদের মতে, এটা মৌসুমের শেষ শৈত্যপ্রবাহ না। আরও একটা শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে।
কিন্তু তার আগে, অর্থাৎ আগামী ২৪ই জানুযারি দেশের মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানান মি. ফারুক।
পরবর্তী শৈত্যপ্রবাহটি এর পরে আসবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বৃষ্টির পর তাপমাত্রা আবার কমতির দিকে যাবে এবং ২৭ তারিখের দিকে আবার শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে।”
“তবে সেটা বেশি দিন স্থায়ী হবে না। ২৯-৩০ তারিখের দিকে তাপমাত্রা আবার বাড়তির দিকে যাবে।”
আবহাওয়াবিদ মি. মান্নানও জানান, “এটাই শেষ শৈত্যপ্রবাহ, এমনটা বলা যাবে না। কারণ গাণিতিকভাবে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শৈত্যপ্রবাহ হতে দেখা যায়।”
“আজ তো কেবল ২২ তারিখ। তাই, ২২ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারির মাঝে যদি শৈত্যপ্রবাহ হয়েও যায়, তারপরও শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা থাকবে”, যোগ করেন তিনি।
এবারে কি বেশি শীত পড়েছে?
সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ভিত্তিতে অন্তত তিন দিন স্থায়িত্বকাল অনুযায়ী শৈত্যপ্রবাহকে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়।
তাপমাত্রা যখন আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝে থাকে, তখন তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে।
এছাড়া, ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটিকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ, চার থেকে ছয় ডিগ্রির মাঝে হলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ এবং চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে হলে তাকে অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
কিন্তু এই শীত মৌসুমে দেশের কোথাও এখন পর্যন্ত তাপমাত্রা আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে নামেনি।
“স্ট্রং কোল্ড ওয়েভ কিন্তু এ বছর এখনও হয় নাই। তাপমাত্রা চার ডিগ্রিতে বা এর নীচে নেমে গেলে সেটাকে ‘সিভিয়ার কোল্ড ওয়েভ’ বলি আমরা। কিন্তু আমাদের তাপমাত্রা চার না কেবল, আট ডিগ্রির নীচেও এখনও পর্যন্ত নামে নাই,” বলছিলেন মি. মান্নান।
অধিদপ্তরের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছে ২০১৮ সালে।
ঐ বছরের আটই জানুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমেছিল দুই দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড।
সে বছর সারাদেশে দফায় দফায় তীব্র শৈত্যপ্রবাহও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেই তুলনায় এ বছর এখন পর্যন্ত কোনও জেলাতেই তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়নি বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
তবে কাগজে কলমে শীত না কমলেও এবার মানুষ বেশি শীত অনুভব করছে বলে জানান মি. মান্নান।
“২০১৮ সালের আগে ২০১৪ সালেও শৈত্যপ্রবাহ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের স্টাডি বলছে, এ বছর শৈত্যপ্রবাহ যতটা না স্ট্রং, তার চেয়ে বেশি স্ট্রং কোল্ড ফিলিংটা।”
কেন এত শীত লাগছে?
শীতের তীব্রতার অন্যতম কারণ হলো কুয়াশা। শীতকালে কুয়াশা পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় মধ্যরাত থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘন থেকে অতিঘন কুয়াশা থাকছে।
এর ফলে দিনের বেলা অতি ঘন কুয়াশার স্তর ভেদ করে সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করতে পারে না।
আবহাওয়াবিদ মান্নান বলেন, “উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও প্রকট। সেখানের অনেক স্থানে আজকে হয়তো সূর্য দেখাই যাবে না। এই পরিস্থিতিতে এলাকাগুলোতে দিনের তাপমাত্রা প্রায় ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভেতর চলে আসবে এবং শীতের তীব্র অনুভূতি হবে।”
“আগের বছরগুলোতেও কুয়াশা হয়েছে। কিন্তু দিনব্যাপী একবারে সূর্যের আলো না দেখা, এরকম অবস্থা কিন্তু আসে নাই”, যোগ করেন তিনি।
তার মতে, এ বছর যে ক’দিন শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে, সে ক’দিন দেখা গেছে যে রাতের তাপমাত্রার তুলনায় দিনের তাপমাত্রা অনেক বেশি কমেছে। এতে করে ঠান্ডার অনুভূতিটা বেড়ে গেছে।
“এই ফগি কন্ডিশনের সমস্যা হলো, এটি দিনের বেলা তাপমাত্রা বাড়তে সহায়তা করে না। বরং কমাতে সহায়তা করে। অপরদিকে, রাতের তাপমাত্রা কমাতে এটি কোনও সহায়তা করে না।”
তাপমাত্রার এই তারতম্যের কারণ হিসেবে ‘অ্যাডভেকশন ফগ’কে দায়ী করেন তিনি।
‘অ্যাডভেকশন ফগ’ কী?
কুয়াশা কয়েক প্রকারের হয়। এর মাঝে অন্যতম হলো ‘অ্যাডভেকশন ফগ’ বা প্রবহমান কুয়াশা।
দূরবর্তী কোনও স্থানে উৎপন্ন হওয়া কুয়াশা যখন ভেসে ভেসে অন্য কোনও স্থানে আসে এবং সেখানে সূর্যের আলোকে বাধাগ্রস্ত করে, তখন সেটিকে অ্যাডভেকশন ফগ বলা হয়।
বাংলাদেশে এখন যে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে, তার উৎপত্তিস্থল নেপালের দক্ষিণাঞ্চলের উঁচু সমভূমিতে।
এই প্রবহমান বা ভাসমান কুয়াশার কারণে সূর্য কিরণ পাওয়া যায় না। সেইসাথে, এটি যখন বাতাসে ভেসে ভেসে চারিদিকে ছড়িয়ে যায়, তখন মানুষের গায়ে ঠান্ডা লাগার অনুভূতি জাগায়।
“এই কুয়াশাটা যখন চলাচল করে, তখন মানুষের মুখে, উন্মুক্ত স্থানে, গায়ে উপনীত হয়। তখন মানুষের কাছে শীতের অনুভূতিটা অনেক তীব্র হয় এবং তারা ঠান্ডায় কষ্ট পায়”, বলেন মি. মান্নান।
প্রখর সূর্য কিরণ ছাড়া এই ধরনের কুয়াশা দূর হয় না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শৈত্যপ্রবাহে করণীয়
শীতের এই সময়ে, বিশেষ করে শৈত্যপ্রবাহের সময় নানা ধরনের রোগ ব্যাধি দেখা দেয়।
এই সময়ে ঠান্ডাজনিত ও শ্বাসতন্ত্রের নানান অসুখে বেশি দুর্ভোগ পোহায় শিশু ও বৃদ্ধরা। এসময় শীতের কারণে কিছু কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
দেশের হাসপাতালগুলোতে ইতোমধ্যে শীতজনিত বিভিন্ন রোগ নিয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
তাই ঠান্ডার হাত থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। অনেক সময় শীতের হাত থেকে বাঁচতে আগুন পোহানোর সময়ও দুর্ঘটনা ঘটে। সেক্ষেত্রে আগুন পোহালেও বিশেষ সতর্কতা নেয়া জরুরি।
এছাড়াও গরু, ছাগলের মতো গবাদি পশু এসময় ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। সেক্ষেত্রে অসুস্থতার হাত থেকে বাঁচাতে চট দিয়ে তাদের গা মুড়িয়ে রাখা যেতে পারে।
শীতের সময় সবজির উৎপাদন ভালো হলেও শৈত্যপ্রবাহের ফলে ফলনে প্রভাব পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে কৃষিকাজের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা নেয়া প্রয়োজন।
এছাড়াও এসময়ে ঘন কুয়াশার কারণে পরিবহন চলাচলে প্রভাব পড়ে এবং অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে। তাই চলাচলের সময় কিছুটা বাড়তি সতর্কতা নেয়া দরকার।