দুই দিনের সফরে মঙ্গলবার ঢাকায় পৌঁছেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) বলছে, এই সফরে মি. লু বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি-সহ আরও অনেকের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করবেন।
তবে এই সফরে কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে তার বৈঠকের কোনও কর্মসূচি নেই। কিন্তু তারপরও ডোনাল্ড লু-র এই সফরকে ঘিরে রাজনৈতিক আলোচনা চলছে গত কয়েকদিন ধরেই।
মি. লু-র এই সফর নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও দিচ্ছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “লু আসছে, তাই বিএনপি নেতারা আবার চাঙ্গা হয়ে গেছে। আবার ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেছে।”
পরদিন এর পাল্টা জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “ডোনাল্ড লু-র বাংলাদেশে আগমন নিয়ে আমরা কেউ ইন্টারেস্টেড নই। আমাদের ভরসা জনগণের ওপর।”
প্রকাশ্যে প্রধান দুই দলের বক্তব্য এমন হলেও আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই এই সফরকে খাটো করে দেখছে না।
দুটি দলের নেতারাই বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, নির্বাচন শেষ হয়ে গেলেও নানা দিক বিবেচনায় মার্কিন এই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম যেমন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ডোনাল্ড লু-র আগমন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বিএনপি। তবে এর সাথে ষড়যন্ত্রের গন্ধ আছে কি না সেটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না।”
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন আবার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শগুলো মানেনি সরকার। এ কারণে এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি আড়ালে কোনও কিছু করে সেটি সরকারের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।”
যদিও দুই দলের এই সন্দেহ কিংবা শঙ্কার কোনও কারণ আছে বলে মনে করেন না কূটনীতিক বিশ্লেষকরা।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই সফরে মি. লু বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাবনার জায়গাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। রাজনৈতিক যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র নজর নাও দিতে পারে।”
শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে লু
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান মি. লু। তাকে সেখানে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা অনুবিভাগের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলম।
তাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস-সহ দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
গত ১০ মে থেকে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে সফর শুরু করেন মার্কিন এই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভারত সফর শেষে সেখান থেকে যান শ্রীলঙ্কায়।
গত ১০ মে এই সফর শুরুর আগে এক বিজ্ঞপ্তিতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়, ঢাকা সফরের সময় ডোনাল্ড লু সরকারি কর্তাব্যক্তি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।
এই সফরে তিনি জলবায়ু সংকট মোকাবেলা, বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক ও সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করবেন বলেও জানানো হয় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক মি. কবীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ডোনাল্ড লু দক্ষিণ এশিয়ার দায়িত্বে আছেন। তিনি তার আওতাভুক্ত এলাকার দেশগুলোর সম্পর্কে তার ধারণাটাকে আপডেট করার জন্য তার এই সফর করছেন বলে আমার বিশ্বাস।”
ডোনাল্ড লু-কে নিয়ে এত আলোচনার কারণ
মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু তার দেশের হয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক দায়িত্ব পালন করছেন।
মি. লু-কে নিয়ে জোরেশোরে আলোচনার শুরু পাকিস্তানে ইমরান খানের পতনের সময়।
ডোনাল্ড লু ২০২২ সালের শুরুর দিকে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আসাদ মজীদকে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন।
পরে সেই বিষয়টি একটি তারবার্তায় (সাইফার) আসাদ মজীদ ইসলামাবাদে ইমরান খানের সরকারকে অবহিত করেন।
সেই তারবার্তার সূত্র ধরে ইমরান খান দাবি করেন, ২০২২ সালে তার সরকার পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে। এই বিষয়ে ইমরান খানের বিরুদ্ধে একটি মামলাও আছে।
তবে, ইমরান খানকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার অভিযোগ পরে অস্বীকার করেছেন ডোনাল্ড লু।
গত বছর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে মি. লু দুই দফায় সফর করেন বাংলাদেশে। তখনও তার সফর ছিল বেশ আলোচনায়।
নির্বাচনের আগে ওই সফরে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকটা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার গঠিত হয়। সেই ভোট হয়ে যাওয়ার চার মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের এই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবার ঢাকায় আসছেন।
গত রোববার এক সংবাদ এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে আলমগীরকে প্রশ্ন করেছিলেন মি. লু-র বাংলাদেশ সফর নিয়ে।
জবাবে মি. আলমগীর বলেছিলেন, “তার আগমন নিয়ে আমরা কেউ ইন্টারেস্ট না। আমাদের ভরসা জনগণের ওপর, সেই আস্থার ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি।”
তবে বিএনপির কাছে এই সফর নিয়ে আগ্রহ আছে কি নেই, সেটা নিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে এখনও কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে।
কারণ ক্ষমতাসীন এই দলটি বলছে, বিএনপি ‘ষড়যন্ত্র করছে কি না’ তা নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মি. নাসিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিএনপির অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হয় বিদেশি কোনও শক্তিধর রাষ্ট্র এসে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে। এর ভেতর ষড়যন্ত্র থাকতেই পারে, যেটা এখনো দৃশ্যমান না।”
বৈঠক নেই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে
সোমবার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গণমাধ্যমকে জানান, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার।”
ডোনাল্ড লু-র ঢাকা সফরে র্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি তুলে নেওয়ার বিষয়েও সরকার আলোচনা করবে বলে তিনি জানান।
এর আগে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গত বছর মি. লু-র সফরে গুরুত্ব পেয়েছিল বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক ইস্যু।
তবে এবার এই ইস্যুতে কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে তার বৈঠকের পূর্ব নির্ধারিত শিডিউল নেই।
বিশ্লেষক মি. কবীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমার ধারণা, দেশের মধ্যকার এই বিষয়গুলো নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে, সেই বিষয়গুলো নিয়েই তিনি আলাপ আলোচনা করবেন। এবং সেই দিকেই মনোযোগী থাকবেন। কিন্তু এটা নিয়ে আমরা যে আলোচনা করি সেটা আমাদের আলোচনা।”
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ডোনাল্ড লু গতবার তার সফরে মিটিং করেননি বিএনপির সাথে।। এইবারও কোনও এজেন্ডা রাখেননি বিএনপির সাথে। এজেন্ডা রাখলে বরং আওয়ামী লীগ বিচলিত হত না। ষড়যন্ত্র কোনদিন প্রকাশ্যে হয় না।”
এই সফর নিয়ে মঙ্গলবার সচিবালয়ে গণমাধ্যমের কাছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “ডোনাল্ড লু এসেছেন তার প্রয়োজনে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা থাকে। সেটা তারা করতে আসছেন। আমরা দাওয়াত করে কাউকে আনছি না।”
দুই দিনের সফরে মার্কিন এই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সাথে নৈশভোজে যোগ দেবেন। এদিন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময়ের কথা রয়েছে তার।
সফরের দ্বিতীয় দিনে ডোনাল্ড লু প্রথমে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে এবং পরে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করবেন।
এরপর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
ডোনাল্ড লু-র এই সফরে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্তাব্যক্তি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তার বৈঠকের কথা রয়েছে।