আবারো ‘ডাক্তারের অবহেলায়’ রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার ঢাকার কল্যাণপুরে ইবনে সিনা হাসপাতালে মারা যাওয়া নারীর পরিবারের অভিযোগ, কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বাঁচানো যায়নি পলি সাহা নামে ওই প্রসূতি নারীকে।
তবে, ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
যদিও একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি কর্তব্যরত চিকিৎসকের সঙ্গে।
এদিকে, মারা যাওয়া নারীর স্বামী জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিএমডিসিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানাবেন।
বাংলাদেশে চিকিৎসক এবং হাসপাতালের ভুলে ও অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ নতুন নয়।
চলতি বছরই জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এমন তিনটি ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে খৎনা করাতে গিয়ে দুটি শিশুর মৃত্যু এবং এন্ডোস্কোপি করাতে গিয়ে একজন যুবকের মৃত্যুর পর তা নিয়ে ব্যাপক শোরগোল পড়ে যায়।
‘সিজার করতে গিয়ে ইউটেরাস কেটে মৃত্যু’র অভিযোগ
বুধবার পলি সাহার মরদেহ সৎকারের জন্য গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে ঢাকায় ফিরে বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিএমডিসিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানাবেন বলে জানিয়েছেন তার স্বামী আশীষ রায় মুন্না।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, ১৮ই মার্চ দুপুরে কল্যাণপুরের ইবনে সিনা হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে পলি-মুন্না দম্পতির একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।
কিন্তু অপারেশনের কয়েক ঘণ্টা পর তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে।
টানা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং রক্তচাপ কমতে থাকলে এক পর্যায়ে চিকিৎসকরা রোগীর জরায়ু কেটে ফেলার প্রস্তাব দেন।
স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য মি. মুন্না ‘ডাক্তারদের দায়িত্বে অবহেলা, শারীরিক জটিলতার মাঝেই দ্বিতীয় অপারেশন এবং ভুল চিকিৎসা’কে দায়ী করেছেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, “আমি একটা সুস্থ পেশেন্টকে নিয়ে আসছি (হাসপাতালে)। সে হাসতে হাসতে হসপিটালে আসছে যে সার্জারি করবে। কিন্তু তাদের (ডাক্তারের) দায়িত্বের অবহেলার জন্য আমার সুস্থ পেশেন্ট আজকে মারা গেল।”
মি মুন্না জানান, সোমবার সিজারিয়ান অপারেশনের এক ঘণ্টা পর পোস্ট অপারেটিভের ডাক্তার তাদেরকে জানিয়েছিলেন যে ‘পেশেন্ট ঠিক আছে, কিন্তু ব্লিডিং হচ্ছে।’
ওইদিন রাতে তাদেরকে ডাক্তার বলেন, “সাধারণত সিজার করতে গেলে ব্লিডিং হয়, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওর ব্লিডিংটা বেশি হচ্ছে। আমরা দেখতেছি যে কী করা যায়।”
সন্ধ্যা সাতটার দিকে রোগীকে রক্ত দেওয়া হয় এবং তারপর হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল, ‘আপাতত কোনও সমস্যা নাই। ওকে প্যাথেডিন (ব্যথা উপশমকারী ওষুধ) দিছি…চিন্তার কিছু নাই।’
রাত আটটার দিকে জানানো হয়, রোগীর রক্তক্ষরণ কমেছে, কিন্তু রক্তচাপ ওঠানামা করছে।
মি. মুন্না বলছেন, “রোগীর তখনও রক্তপাত হচ্ছিলো, কিন্তু ডাক্তাররা সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি।”
তিনি অভিযোগ করেন, “রাত সাড়ে চারটার দিকে ডা. শারমিন আমার ফোনে কল দিয়ে বলতেছে যে আপনার পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ। তাকে ইমিডিয়েটলি আইসিইউ-তে শিফট করা লাগবে। ব্লাড জোগাড় করেন।”
ভোর ছয়টার দিকে রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হয়।
“আইসিউতে যখন শিফট করায়, তখনই দেখি রোগীর অবস্থা খারাপ। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম, আমি তাকে ডাকতেছি, কিন্তু সে আমার সাথে কথা বলতে পারতেছে না”
“ডাক্তার তখন আমায় বলে যে পেশেন্টের আরেকটা অপারেশন করতে হবে। আমি বলি যে ঠিক আছে, কিন্তু ও যেন সার্ভাইভ করে, ওর যেন কিছু না হয়।”
মি. মুন্না বলেন, “সি সেকশনের সময় যে জায়গায় অপারেশন করেছিলো, সার্জারি করে সেটা খুলে তারা জরায়ুটা আবার ওপেন করে তখন।”
“তারপর আমাদেরকে বলে যে জরায়ুতে সমস্যার কারণে ব্লিডিং হচ্ছে। এক্ষুণি এটা কেটে ফালায়ে দিতে হবে, তাহলে পেশেন্ট বাঁচবে। নয়তো বাঁচানো খুব টাফ। আমি বলি যে ঠিক আছে, কিন্তু আমার পেশেন্টকে বাঁচান।”
এরপর সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রোগীকে আবার আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ডাক্তাররা তাকে আবারো জানান যে রোগীর অবস্থা ভালো না।
তিন ঘণ্টা পর একজন কার্ডিওলজিস্ট মি. মুন্নাকে জানান যে রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
“কিছুক্ষণ পর আইসিইউ ইনচার্জ এসে বলে যে আপনাদের যদি দেখার ইচ্ছা হয়, দেখতে পারেন। গিয়ে দেখি কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে। তখন বুঝে গেছি, যা হওয়ার হয়ে গেছে,” বলছিলেন মি. মুন্না।
হাসপাতাল কী বলছে?
ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিবিসি বাংলাকে বলেছে, বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
হাসপাতালের একজন পরিচালক (অব.) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. পারভেজ কবীর জানান, “কালকে (মঙ্গলবার) রাতে রোগীর আত্মীয়রা এসেছিলেন। আমরা তাদের সাথে বসি এবং এক ঘণ্টা ধরে তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেই।”
তিনি বলেন, “আমরা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি করেছি। তাদের তদন্তের রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো যে প্রকৃত ঘটনা কী। রিপোর্ট পেলে আমরা সঠিক তথ্য দিতে পারবো।”
“ভুল চিকিৎসা নাকি, চিকিৎসায় অবহেলা, সেটা তদন্ত রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যাবে,” তিনি বলেন।
এদিকে, অভিযোগের ব্যাপারে ডা. শারমিন মাহমুদের সঙ্গে মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
ভুল চিকিৎসা এবং অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ নতুন নয়
ভুল চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়।
চলতি বছরের তিন মাসও এখনও শেষ হয়নি, কিন্তু এরই মাঝে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অনেক খবর ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে।
এর মাঝে জানুয়ারির শুরুতে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকাবস্থায় মৃত্যু হয়েছিলো পাঁচ বছর বয়সী শিশু আয়ান আহমেদের।
তাকে ৩১শে ডিসেম্বর খৎনা করানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো পরিবার। কিন্তু অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর তার আর জ্ঞান ফেরেনি।
এই ঘটনা দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
এরপর ফেব্রুয়ারিতে খৎনা করাতে গিয়ে মৃত্যু হয় আরেক শিশু আহনাফ তাহমিদের। ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে দশ বছর বয়সী ওই শিশুর মৃত্যু হয়েছিলো।
এই দুইটি শিশুর পরিবারেই অভিযোগ ছিল, তাদেরকে ‘ফুল অ্যানেসথেসিয়া’ দেওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকার ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোস্কোপি করাতে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে রাহিব রেজা নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়।
তার স্বজনদের অভিযোগ, ল্যাবএইড হাসপাতালে পরীক্ষার রিপোর্ট না দেখেই রাহিব রেজাকে অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করা হয়।
“এবং শারীরিক জটিলতার মধ্যেই তার এন্ডোস্কোপি করা হয়। যে কারণে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় এবং একপর্যায়ে শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।”
এই ঘটনাগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ায় সেগুলো নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।
কিন্তু এর বাইরেও ভুল চিকিৎসা এবং অবহেলায় রোগীর মৃত্যু বা নানা সমস্যার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।
এর আইনি প্রতিকার কী আছে?
বাংলাদেশে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৮০ এবং ৮৮ ধারাতে ‘সরল বিশ্বাসে পরিচালিত চিকিৎসাকার্যে’ সংঘটিত দুর্ঘটনার দায় থেকে চিকিৎসককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে অভিযোগ করার একমাত্র জায়গা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।
বিএমডিসির নিয়মানুযায়ী, কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তা অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে জবাব দেয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির উত্তর অভিযোগকারীকে জানানো হবে।
তিনি তা গ্রহণ না করলে তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত চিকিৎসকের লাইসেন্স স্থগিত করার বিধান রয়েছে।
যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা বিএমডিসির এই প্রক্রিয়া জানেন না বা এর মধ্য দিয়ে যান না। আইনে চিকিৎসকদের দায় নিয়েও স্পষ্টভাবে কোনও কিছু বলা হয়নি।
সুপ্রিম কোর্ট ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড ট্রাস্টের আইনজীবী অনিক আর হক চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এ ধরনের ক্ষেত্রে খুব বেশি হলে বিএমডিসিতে অভিযোগ করা যায়। তদন্ত কমিটিতে চিকিৎসকরাই থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণ হয় না।”
“ভুক্তভোগী তখন বাধ্য হয়ে হাইকোর্টে রিট করে। তবে, অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু হলে ফৌজদারি মামলা করার সুযোগ আছে,” বলেন মি. হক।
ভুল চিকিৎসা বা অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগে ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা এ রকম বেশ কয়েকটি রিট হাইকোর্টে বিচারাধীন বলে জানান তিনি।
এছাড়া ‘স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৩’ নামে একটি আইনের খসড়া করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে, সেটি এখনো আইনে পরিণত করা হয়নি।
এর খসড়াতেও চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে ফৌজদারি আইনে বিচার এবং আদালত কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলা হয়েছে।
এতে, হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানের এবং চিকিৎসা প্রদানকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে লাইসেন্স বাতিল ও চিকিৎসকের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশের কথা উল্লেখ আছে খসড়ায়।
সেইসাথে, এ সকল অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনজীবী আরও বলছেন, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৩৮ ধারাটি ডাক্তারি অবহেলা সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিকারের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ ধারায় উল্লেখ আছে, যে কোনও ধরনের বেপরোয়া কাজ বা অবহেলার কারণে আঘাত দিলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা একসঙ্গে দুটি দণ্ডই দেওয়া যাবে।