তাইওয়ানের চারদিকের আকাশে ও সমুদ্রে চীনের সামরিক মহড়া দেওয়ার আজ (শুক্রবার) ছিল দ্বিতীয় দিন এবং সর্বশেষ এই মহড়াগুলো থেকে বোঝা গেছে যে কীভাবে চীনের পিপল’স লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) জাহাজ ও বিমান দিয়ে দ্বীপটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখতে চাইছে।
বেইজিং কীভাবে এই দ্বীপটির দখল নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, এটি তার একটি অনুশীলন মাত্র। কারণ তারা বহুবারই এটিকে বাস্তবায়ন করার হুমকি দিয়েছে।
তাইওয়ান প্রণালীতে চীন ইতোমধ্যে একটি ‘নিউ নর্মাল’ বা ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ স্থাপন করেছে। স্ব-শাসিত এই দ্বীপটিতে চীন ক্রমাগত খুব ধীরে ধীরে সামরিক চাপ বাড়াচ্ছে।
তাহলে তাদের এবারের সামরিক মহড়া আলাদা কোথায় এবং এটি আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে?
‘প্রোপাগান্ডা’ বনাম ‘বাস্তবতা’
এটি বলা খুব কঠিন যে ঠিক কী ঘটছে। কিন্তু বেইজিং যা দেখাচ্ছে, তা থেকে এটি স্পষ্ট যে এর আগে তারা কখনও তাইওয়ানের এত বিশাল এলাকা জুড়ে সামরিক মহড়া চালায়নি।
এবার তারা যে সব এলাকা জুড়ে মহড়া চালাচ্ছে, তার মাঝে তাইওয়ান প্রণালীর বেশির ভাগ অংশ, তাইওয়ানকে ফিলিপাইন থেকে আলাদা করা বাশি চ্যানেল এবং তাইওয়ানের পূর্ব উপকূল বরাবর প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল অংশ রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দ্বীপটিকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলার মহড়াই দেয়া হয়েছে। সেনাদের এখানে অবতরণ ছাড়া, পূর্ণমাত্রার আক্রমণের সবই করা হয়েছে – বলছিলেন তাইওয়ানের সামরিক বিশেষজ্ঞ চিহ চুং।
তিনি মনে করেন, তাইওয়ানের মূল ভূখণ্ড তো বটেই, দেশটির দ্বীপগুলোকেও মহড়ার আওতায় আনা হয়েছে। এতে করে একটি বার্তা পাওয়া যাচ্ছে যে দ্বীপগুলো থেকে কোনও প্রকার প্রতিরোধ বা পাল্টা আক্রমণ করতে দেওয়ার সুযোগ দিতে চায় না চীনের পিএলএ।
তিনি আরও মনে করেন, এই দুই দিনের মহড়াই শেষ না। চলতি বছর তাইওয়ানকে আরও কয়েকবার এই ধরনের মহড়ার মুখোমুখি হতে হবে।
সে জন্যই তারা এই মহড়ার নাম দিয়েছে ‘জয়েন্ট সোর্ড-২০২৪এ’। শুক্রবারের বিভিন্ন ফুটেজ থেকে দেখা গেছে যে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) তাইওয়ানের প্রধান শহর ও বন্দরে হামলার মহড়াও চালাচ্ছে।
পিএলএ’র ইস্টার্ন কমান্ড একটি নাটকীয় ভিডিও প্রকাশ করেছে। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে একটি জাহাজের বহর তাইওয়ানের দিকে এগিয়ে আসছে। সেখানে এরকম কিছু শব্দ শোনা গেছে যে “পুশ ইন!” (আক্রমণ) “এনসার্কেল!” (ঘিরে ফেলো), কিংবা “লক!” (আটকে দাও)।
তারপরে পুরো তাইওয়ানকে কমলা রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এটি সম্ভবত পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নির্দেশ করে।
চীন একজন পিএলএ কর্নেলের ভিডিও-ও প্রকাশ করেছে, যেখানে রাজনৈতিক উস্কানিমূলক ভাষায় মহড়ার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে দ্বীপের পূর্ব অংশের নিকটবর্তী সমুদ্র এবং আকাশপথে দু’টি অনুশীলন এলাকা নির্ধারণ করেছি। মূলত তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর পলায়ন রোধ ও তাদের কমফোর্ট জোন নষ্ট করার করার জন্য এই মহড়ার আয়োজন।”
দ্বীপের পূর্ব উপকূলে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অবকাঠামো রয়েছে এবং জাপানের দক্ষিণ প্রান্তের দ্বীপগুলোর নিকটবর্তী হওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ তাইওয়ানের মিত্রদের জন্য এটি একটি নির্ভরযোগ্য রিসাপ্লাই রুট বা পুনঃসরবরাহের পথ।
কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতি বেশ নাটকীয় মনে হলেও বাস্তবতা বেশ কঠিন। যেমন, তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণে থাকা উ-কুইউ নামক একটি দ্বীপের তিন নটিক্যাল মাইলের মাঝে কোস্ট গার্ড জাহাজের একটি বহর এগিয়ে আসছে, এমন একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে চীন।
এই দ্বীপটি হল ফুইজান উপকূলের কাছে একটি ক্ষুদ্র পাথুরে এলাকা। এটি মূলত সামুদ্রিক পাখির উপনিবেশ। সেই সাথে, এখানে তাইওয়ানের সৈন্যদের একটি ছোট দলও বসবাস করে।
বৃহস্পতিবার তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাইওয়ানের আঞ্চলিক জলসীমার কাছে ৪৯টি চীনা বিমান, ১৯টি নৌ জাহাজ এবং সাতটি কোস্ট গার্ড জাহাজ থাকার হিসাব দিয়েছে। ওগুলো মূলত ফ্রিগেট এবং কর্ভেট জাহাজ, যা আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং হালকা অস্ত্র বহন করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
বহরে উভচর বা বিমানবাহী জাহাজের মতো কোনও ভারী চীনা জাহাজ অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি। সত্যিকারের আক্রমণ করতে হলে অবশ্য অনেক বড় ও অনেকগুলো জাহাজ প্রয়োজন হবে।
সর্বশেষ ১৯৪৪ সালে জাপানের ওকিনাওয়াতে মার্কিন আগ্রাসনের সময় তাইওয়ানের কাছাকাছি অঞ্চলে একটি বড় উভচর জাহাজ ব্যবহার করা হয়েছিল। সে সময় মার্কিন বহরে প্রায় ৩০০জন নৌ যোদ্ধা ছিল, যার পাশাপাশি ১১টি ‘ফ্লিট ক্যারিয়ার’ এবং শত শত সৈন্য ও সরবরাহ জাহাজও ছিল।
তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্টকে সত্যিই অপছন্দ করে বেইজিং
বেইজিং-এর দাবি অনুযায়ী বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া সামরিক মহড়া দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি উইলিয়াম লাইকে তিরষ্কার করার জন্য করা হয়েছে, কারণ তাদের মতে ‘সব কিছু শুরুর মূলে রয়েছেন তিনিই’।
চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকা ইতোমধ্যে তাকে “অহংকারী” ও “বেপরোয়া” হিসাবে বর্ণনা করেছে। এবং চীনের সিসিটিভি লিখেছে যে তিনি “অবশ্যই ইতিহাসের লজ্জাজনক ব্যক্তি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”
“দ্বি-জাতি তত্ত্ব বিক্রি” করার জন্যও তার নিন্দা করেছে সিসিটিভি।
প্রেসিডেন্ট লাই-এর কথিত অপরাধ হল যে সোমবার তার প্রথম ভাষণে তিনি চীনকে বর্ণনা করতে চীন শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বেইজিং বলছে যে এটি করার মাধ্যমে মি. লাই তার সত্যিকারের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন যে তাইওয়ান চীন নয় এবং তারা দু’টি ভিন্ন দেশ। চীনের দৃষ্টিতে এটি তার “বিচ্ছিন্নতাবাদী” মতাদর্শের স্বীকৃতি।
বহিরাগতদের কাছে এগুলো অযৌক্তিক শোনাতে পারে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে বেইজিং ও তাইপেই উভয়পক্ষই তাদের কাছে চীনের সংজ্ঞা কী এবং তাইওয়ান চীনের অংশ কি না, সে বিষয়টি অস্পষ্ট করে রেখেছে।
এমন কী তাইওয়ানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সাই চীনের বিষয়ে কথা বলার সময় সতর্কভাবে শব্দচয়ন করতেন। তিনি “প্রণালীর অপর প্রান্ত” বা “বেইজিং কর্তৃপক্ষ”-র মতো শব্দ উচ্চারণ করতেন।
তাইওয়ানের কিছু বিদ্বান ব্যক্তিরাও আপনাকে বলবেন যে এই ধরনের ভাষা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মি. লাই সেই বিপজ্জনক সীমারেখা অতিক্রম করেছেন।
অন্যরা বলছেন যে তার জন্য বেইজিংয়ের ঘৃণা ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং তার ভাষণটি কেবলমাত্র সেই ঘৃণাকে আরও দৃঢ় করেছে।
অধিকাংশ পর্যবেক্ষকই অবশ্য এ বিষয়ে একমত যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চাচ্ছেন যে চীন তাইওয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করুক এবং তাইওয়ানের জনগণ সেটি মেনে নেবে না – এই মৌলিক সত্যিটার তাতে কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না।
এটিই ‘নতুন বাস্তবতা’
তবে এই সামরিক মহড়ায় তাইওয়ানের কেউই অবাক হননি। তাদের কাছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কার্যকলাপ বেশ অনুমানযোগ্য।
জানুয়ারির শুরুতে যখন মি. লাই’র ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) টানা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করে, তখন অনেকেই ভাবছিলেন যে বেইজিং কীভাবে এবং কখন এর প্রতিক্রিয়া জানাবে।
সুস্পষ্ট অনুমান ছিল যে মি. লাই’র রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম ভাষণের পরেই এটি হবে। হয়েছেও তাই। দেখা যাচ্ছে যে রাষ্ট্রপতি লাই’র অভিষেকের চার দিন পরেই বেইজিং তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
তবে এর কোনওটিই যে হুট করে হয়নি, তা তাদের প্রস্তুতির মধ্যেই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কারণ কোনও সামরিক বাহিনী, এমনকি পিএলএ-ও মাত্র কয়েক দিনের মাঝে এত বড় মাপের একটি মহড়া আয়োজন করতে পারে না।
এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে এখনও পর্যন্ত চীন এতে বারবার ‘মিডিয়ান লাইন’ অতিক্রম করেছে। এটি একটি অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত, যা উভয় পক্ষের উপকূল থেকে প্রায় ৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে।
তবে এই মহড়া এখনও তাইওয়ানের উপকূল থেকে প্রায় ২৪ মাইল দূরের প্রকৃত সীমান্তটি অতিক্রম করেনি। এটিকে একটি বড় জয় হিসাবে দেখা যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে আক্রমণাত্মক বক্তৃতা সত্ত্বেও, বেইজিং এখনও সতর্ক রয়েছে।
তাইপেই-র রাস্তায় মহড়ার প্রতিক্রিয়ায় অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। অনেকেই বলছেন যে তারা চিন্তিত নন। কিন্তু সে বিষয়টি পুরোপুরি সত্য নয়।
চীনের পাশে বসবাস করার অর্থ অনেকটা একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বসবাস করার মতো। সেখানে সব সময় হুমকি আছে এবং দিনকে দিন মহড়াগুলো আরও বড় ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
তাই একদিকে আপনাকে এর জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। অপর দিকে আপনাকে আপনার দৈনন্দিন জীবন যাপনও চালিয়ে যেতে হবে।
তাইওয়ানের ক্ষমতাসীন দল ডিপিপি এবং বিরোধী দলগুলোর মাঝে এক ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্ক আছে। তারা পরস্পরের সাথে সংসদে বসে বিবাদ করে। কিন্তু চীনের এই সামরিক মহড়া তাইওয়ানের সব দলকে কাছাকাছি এনেছে।
বিরোধী দল কেএমটি, যাদের ঐতিহ্যগতভাবে চীনপন্থী হিসাবে দেখা হয়; তারা বেইজিংকে সংযম দেখানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে যে এটা বেইজিংয়ের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেখানোর সময় নয়।।
এখানে একটি বিচিত্র পরিহাসও রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে চীনের কমিউনিস্ট নেতারা তাইওয়ান এবং দেশটির জনগণকে কতটা কম বোঝে।
তারা ঘোষণা করেছে যে সামরিক মহড়াতে কেবল তাইওয়ানের “স্বাধীনতাপন্থী বাহিনীকে ভীতি প্রদর্শন ও পরাজিত করার” প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাস্তবে যতবারই চীন সামরিক ভীতি দেখায়, ততবারই কিন্তু ডিপিপি-র সমর্থন বাড়তে থাকে এবং “চীন-বান্ধব” কেএমটি’র পতন ঘটে।
একটি সাম্প্রতিক ঘটনা: জানুয়ারির নির্বাচনের আগ পর্যন্ত কয়েক মাস ধরে চলা চীনের সামরিক আগ্রাসনই কিন্তু মি. লাইকে শীর্ষ পদে নিয়ে গেছে।
তাইওয়ানের জনগণকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে বেইজিংকে চ্যালেঞ্জ-করা দলগুলো এবং নেতাদের থেকে মানুষকে দূরে সরানোই যদি চীনের মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে যে তার ঠিক উল্টোটাই ঘটছে।