ছবির উৎস, Getty Images
ভারত সফররত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ তার দেশকে বিপুল আর্থিক সহায়তা করার জন্য ভারতকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সোমবার দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার বৈঠকের পর করা এই মন্তব্যকে মুইজ সরকারের তীব্র ভারত-বিরোধিতার নীতি থেকে প্রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে এদিনের বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও জানান, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সংযোগ, কানেক্টিভিটি, সাংস্কৃতিক কানেক্ট-সহ আরও বহু খাতে সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে তাদের দু’জনের মধ্যে বিশদে আলোচনা হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, ভারত-মালদ্বীপ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৬০ বছর বা হীরক জয়ন্তী বর্ষ উদযাপনে আগামী বছর মালদ্বীপ সফর করার জন্য প্রেসিডেন্ট মুইজ যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী তা গ্রহণ করেছেন।
বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট মুইজ বলেন, “আমাদের দুই দেশে তথা গোটা অঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়নের প্রতি অভিন্ন অঙ্গীকারে মালদ্বীপ ও ভারতের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে।”
গত বছর মালদ্বীপে নির্বাচনি প্রচারণার সময় তীব্র ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন চালিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছিল, সেই মোহামেদ মুইজ-এর সরকারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘বাঁক বদলের পদক্ষেপ’ বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট মুইজকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএনআই আরও জানিয়েছে, “ভারত সরকার যে আমাদের ৩০০০ কোটি রুপি (৩৬ কোটি ডলার) আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে এবং তার পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক স্তরে ৪০ কোটি ডলারের ‘কারেন্সি সোয়াপ’ (মুদ্রা বিনিময়) সমঝোতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার জন্য আমি ভারতের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
ছবির উৎস, Getty Images
মালদ্বীপ এই মুহূর্তে যে বৈদেশিক মুদ্রা বা ফরেন রিজার্ভ সংকটের সম্মুখীন, তার মোকাবেলায় এই সিদ্ধান্ত সহায়ক হবে বলেও প্রেসিডেন্ট মুইজ মন্তব্য করেছেন।
রবিবার (৬ অক্টোবর) ভারতে এসে পৌঁছানোর আগে বিবিসিকে দেওয়া এক ই-মেইল সাক্ষাৎকারেও প্রেসিডেন্ট মুইজ বলেছিলেন, তার দেশের আর্থিক পরিস্থিতির ব্যাপারে ভারত অবহিত এবং সেই সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টায় ভারত তাদের নিশ্চিতভাবেই সহায়তা করবে।
আজ (সোমবার) ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে তার সফর শুরু হওয়ার পর এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে তার বৈঠকের পর দেখা গেল, সেই ধারণাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রবল আর্থিক সংকটের মুখে পড়া মালদ্বীপকে ভারত নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভারতে মুইজের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর
গত বছর মালদ্বীপের ক্ষমতায় আসার পর এটাই ভারতে প্রেসিডেন্ট মুইজের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। তবে মাস চারেক আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় দফার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি দিল্লি এসেছিলেন।
চলতি সফরে রবিবার সন্ধ্যায় দিল্লি এসে পৌঁছানোর পর এদিন (সোমবার) সকালে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রেসিডেন্ট মুইজকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।
তাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও।
এরপর প্রথা অনুযায়ী ভারতের জাতীয় জনকের সমাধিস্থল রাজঘাটে শ্রদ্ধার্পণ করে তিনি দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।
ছবির উৎস, Getty Images
বৈঠকের পর দু’দেশের পক্ষ থেকে জারি করা হয় একটি যৌথ বিবৃতি। হায়দ্রাবাদ হাউসে দুই নেতার যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদী ভারতকে ওই দ্বীপরাষ্ট্রের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, তার সরকারের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতির কারণেই মালে-র যে কোনও বিপদে আপদে ভারত ‘ফার্স্ট রেসপন্ডারে’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে– অর্থাৎ অন্য সবার আগে তাদের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
“নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগানোই হোক, কোভিড মহামারির সময় ভ্যাক্সিন পাঠানো কিংবা পানীয় জলের ব্যবস্থা করা– ভারত সব সময় ভালো প্রতিবেশীর মতো আচরণ করেছে,” মনে করিয়ে দেন তিনি।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালদ্বীপের যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সে কথাও উল্লেখ করেন নরেন্দ্র মোদী।
৩০০০ কোটি রুপির ‘কারেন্সি সোয়াপ’
দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট মুইজ ভারতকে যে সব কারণে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তার মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ৩০০০ কোটি রুপির (যা প্রায় ৪০ বিলিয়ান ডলারের সমতুল্য) একটি কারেন্সি সোয়াপ এগ্রিমেন্ট।
বিগত কয়েক মাসের মধ্যে মালদ্বীপের ‘ফরেন রিজার্ভ’ বা বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় হু হু করে কমেছে – শেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তাদের রিজার্ভ এখন মাত্র ৪৪ কোটি ডলারে এসে ঠেকেছে।
এই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে মালদ্বীপ বড়জোর পরবর্তী দেড় মাসের আমদানি খরচ মেটাতে পারবে।
যে দেশটিকে জ্বালানি তেল থেকে চাল-গম প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, তাদের জন্য এটি একটি বিরাট সংকট নিঃসন্দেহে।
ছবির উৎস, Getty Images
গত মাসে বৈশ্বিক সংস্থা মুডি’জ-ও তাদের মূল্যায়নে মালদ্বীপের ক্রেডিট রেটিংয়ে অবনমন ঘটিয়ে জানিয়েছিল, সে দেশের ‘ডিফল্ট রিস্ক’– অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণ মেটাতে ব্যর্থ হওয়া বা ঋণখেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা– মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে।
আজ দিল্লিতে দুই দেশের মধ্যে যে আর্থিক সমঝোতা হলো, তার ফলে দু’পক্ষ তাদের মধ্যকার ঋণের ‘সুদ’ ও ‘আসল’ – উভয়ই ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রায় পরিশোধ করতে পারবে, আর সেটা হতে হবে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে।
এর ফলে মালদ্বীপের ডলার রিজার্ভের ওপর এই মুহূর্তে যে প্রবল চাপ, সেটা অনেকটা প্রশমিত হবে। প্রেসিডেন্ট মুইজ নিজেও সে কথা আজ স্বীকার করেছেন।
এছাড়া ভারতের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কনসর্টিয়াম ‘ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া’ মাস্টারকার্ড ও ভিসা-র বিকল্প হিসেবে যে ‘রূপে’ পেমেন্ট কার্ড চালু করেছে– সেটাও অচিরেই মালদ্বীপে ব্যবহারযোগ্য হবে বলে এদিন সমঝোতা হয়েছে।
মালদ্বীপের রাজধানী বৃহত্তর মালে এলাকায় বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পর উন্নয়নেও ভারত তাদের সহযোগিতা করবে বলে কথা দিয়েছে।
‘ভারত আমাদের সমস্যার কথা জানে’
দিল্লির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগেই অবশ্য প্রেসিডেন্ট মুইজ বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, ভারত যে তাদের অর্থনৈতিক সংকটে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত।
পাঁচ দিনের এই দীর্ঘ ভারত সফরে রওনা হওয়ার আগে দেওয়া এক ইমেইল সাক্ষাৎকারে তিনি এই আত্মবিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেন।
ছবির উৎস, Getty Images
বিবিসির আনবারাসান এথিরাজনকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমাদের আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারত সম্পূর্ণরূপে অবহিত।”
“মালদ্বীপের বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম ভারত- আর আমাদের বোঝা লাঘব করতে, উন্নততর বিকল্প এবং আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান খুঁজে পেতে তারা সব সময় প্রস্তুত,” মন্তব্য করেন তিনি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তীব্র ভারত-বিরোধী যে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনে ভর করে মোহামেদ মুইজ গত বছর ক্ষমতায় এসেছিলেন তার তুলনায় দিল্লির প্রতি তার এই সুর নরম করার ইঙ্গিত ‘সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী’।
তথাকথিত ভারত-বিরোধী মনোভাব নিয়ে বিবিসির কাছে প্রেসিডেন্ট মুইজ অবশ্য খোলাখুলি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
তবে তিনি এটুকু শুধু বলেছেন, “আমাদের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলে খোলাখুলি আলোচনা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে তা মিটিয়ে নেওয়া যাবে বলে আমরা নিশ্চিত।”
ছবির উৎস, Getty Images
মালদ্বীপ যে তাদের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) দ্বারস্থ হওয়ার কথা বিবেচনা করছে না, সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট মুইজ সে কথাও স্পষ্ট করে দেন।
“(সংকট মোকাবেলায়) আমাদের নিজস্ব ও দেশজ এজেন্ডাই আছে,” মন্তব্য করেন তিনি।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পথে?
গত বছরের নভেম্বরে ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট মুইজ তার প্রথম দু’টি বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন যথাক্রমে তুরস্ক ও চীনকে।
জানুয়ারিতে তার সেই চীন সফর ভারতের প্রতি এক ধরনের ‘অবজ্ঞা’ হিসেবেই দেখা হয়েছিল – কারণ অতীতে মালদ্বীপের সব নেতাই নির্বাচিত হয়ে সবার আগে ভারতে সফর করেছেন।
প্রায় একই সময়ে মালদ্বীপের একাধিক সরকারি কর্মকর্তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করলে সেটি কেন্দ্র করেও তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
ভারতের উপহার দেওয়া দুটি সামরিক হেলিকপ্টার ও একটি ডর্নিয়ার এয়ারক্র্যাফটের ‘রক্ষণাবেক্ষণে’র জন্য যে প্রায় ৮০ জনের মতো ভারতীয় সেনা সদস্য মালদ্বীপে ছিলেন, মুইজ সরকার তাদেরও অবিলম্বে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়।
ছবির উৎস, Getty Images
পরে অবশ্য ‘সেনা সদস্য’দের পরিবর্তে ভারতের ‘বেসামরিক টেকনিক্যাল কর্মী’দের মালদ্বীপে পাঠিয়ে সেই ইস্যুটির একটি নিষ্পত্তি করা হয়েছিল।
ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের একটি ‘রিসার্চ ভেসেল’ বা ‘গবেষণাধর্মী জাহাজ’কে মালদ্বীপ তাদের বন্দরে ভিড়ার অনুমতি দেওয়ার পর সেই সিদ্ধান্তও দিল্লিকে অসন্তুষ্ট করেছিল।
ভারতের ধারণা ছিল সেটি আসলে চীনের একটি গোয়েন্দা জাহাজ এবং তাদের সংগৃহীত ডেটা চীনের সেনাবাহিনীর সাবমেরিন অপারেশনে ব্যবহার করা হবে।
প্রেসিডেন্ট মুইজ অবশ্য বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন যে তিনি ‘চীন-পন্থী’!
বিবিসিকেও তিনি বলেছেন, “যে দিন দায়িত্ব নিয়েছি সে দিনই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি আমি স্পষ্ট করে দিয়েছি– যে এটা হলো একটা ‘মলডিভস ফার্স্ট’ পলিসি, অর্থাৎ মালদ্বীপের স্বার্থ সবার আগে।”
“অন্য যে কোনও দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নির্ধারিত হয় পারস্পরিক মর্যাদা ও আস্থা, একে অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনার নীতি দিয়ে,” সাক্ষাৎকারে জানান তিনি।
ছবির উৎস, Getty Images
তবে প্রেসিডেন্ট মুইজ মালে-কে বেজিংয়ের ঘনিষ্ঠ বলয়ে নিয়ে যেতে অনেক চেষ্টাই করেছেন বলে মনে করলেও বিশ্লেষকরা বলছেন চীনের কাছ থেকে মালদ্বীপ তেমন একটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা পায়নি।
আর সে কারণে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েই প্রেসিডেন্ট মুইজকে এখন দিল্লির সাহায্যপ্রার্থী হতে হচ্ছে।
মালে-ভিত্তিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক আজিম জাহিরের কথায়, “মালদ্বীপ যে ভারতের ওপর আসলে কত বেশি নির্ভরশীল, মুইজ-এর এই দিল্লি সফর তারই প্রমাণ।”
“আর ভারতের ওপর এই নির্ভরশীলতা অন্য কোনও দেশকে দিয়ে পূরণ করাটা মোটেও সহজ হবে না,” বলছিলেন মি. জাহির।