বাংলাদেশ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সব দলের সাথে আলোচনা করে তারা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেই সরকারের মাধ্যমেই দেশ পরিচালনা করা হবে।
“আমরা আজকে সুন্দর ভাবে কথা বলেছি। প্রধান প্রধান দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আমরা সুন্দর আলোচনা করেছি। এই আলোচনা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করছি। সুন্দর একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এখন একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবো,” বিকেল চারটার দিকে এক ব্রিফিং এ বলছিলেন তিনি।
তিনি জানান তিনি সব দলের নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ করেছিলেন এবং তাদের সাথে তার সুন্দর আলোচনা হয়েছে, যেখানে তারা একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
“একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবো এবং এই সরকারের মাধ্যমে এ দেশের সব কার্যকলাপ চলবে। আমরা এখন রাষ্ট্রপতির কাছে যাবো। ওনার সাথে আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করবো”।
সব হত্যা ও অন্যায়ের বিচারের অঙ্গীকার করে সেনাপ্রধান সবাইকে সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখার অনুরোধ করেন।
“আমি সব দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনাদের জানমাল এবং আমি কথা দিচ্ছি আশাহত হবেন না। আপনাদের যত দাবি আছে সেগুলো পূরণ করবো এবং দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। আপনারা আমার সাথে সহযোগিতা করেন”।
সেনাসদরে ব্রিফিংয়ের আগে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন।
তিনি জানান ওই বৈঠকে জামায়াতের আমির, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ, জুনায়েদ সাকী ও ডঃ আসিফ নজরুল উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠকে আওয়ামী লীগের কেউ ছিলো না বলে জানান তিনি।
ভাঙ্গচুর, হত্যা, মারামারি ও সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন তার কথা মতো চললে ও একসাথে চললে তারা একটি সুন্দর পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন।
“দয়া করে আমাকে সহায়তা করুন। মারামারি করে, সংঘাতের মাধ্যমে আর কিছু পাবো না। সুতরাং দয়া করে সব ধ্বংসযজ্ঞ, অরাজকতা ও সংঘর্ষ থেকে বিরত হন। ইনশাল্লাহ সবাই মিলে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হবো। আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন,আমাদের কিছু সময় দিন। আমরা সবাই মিলে সব সমস্যা সমাধানে সক্ষম হবো”।
সংঘাত বাদ দিয়ে শান্তি শৃঙ্খলার পথে আসার অনুরোধ করে তিনি বলেন দেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে, অর্থ সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে এবং লোকজন মারা যাচ্ছে।
“এগুলো থেকে বিরত হোন এবং আমাদের সহযোগিতা করেন। আমি সব দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনারা আমাকে সহযোগিতা করেন” বলেন সেনাপ্রধান।
সরকারের রূপরেখা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। আমরা যাবো রাষ্ট্রপতির সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে করবো”।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান তার অনুরোধে ডঃ আসিফ নজরুল আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলেছেন।
“আশা করি ওনার এ বার্তা শুনে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চলে আসবে এবং আমরা সুন্দর পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাবো।
ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, এটা বিশেষ পরিস্থিতি এবং আজকেই রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। একই সাথে সেনাবাহিনী শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজ চালিয়ে যাবে।
“আপনাদের সবার দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা। আমাদের সহযোগিতা করেন। আমরা তাহলে সহজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহজেই নিয়ে আসতে পারবো”।
কারফিউ কতদিন থাকবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যদি শান্ত হয়ে যায় তাহলে কারফিউ, জরুরি অবস্থা, গোলাগুলির প্রয়োজন নেই।
সেনাপ্রধান বলেন, “আমি আদেশ দিয়েছি সেনাবাহিনী ও পুলিশ কোন গোলাগুলি হবে না। আশা করি আমার বক্তব্যের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আমরা সুন্দর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি। আজকে রাতের মধ্যে সলিউশনে যাওয়ার চেষ্টা করবো। তবে দু একদিন সময় আমাদের দিতে হবে। রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলে সুন্দর সলিউশনের চেষ্টা করবো। এখন ছাত্রদের কাজ শান্ত হওয়া ও আমাদের সহযোগিতা করা”।
সেনাপ্রধানের ব্রিফিং এর আগেই দুপুরে সরকার থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যেই দুপুর থেকে আন্দোলনকারীরা শহরের বিভিন্ন প্রবেশ পথ দিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করে। তখন আর তাদের পুলিশ ও সেনাসদস্যরা কোন বাধা দেয়নি।
যা যা ঘটেছিলো
এর আগে জুন মাসের শুরু থেকে কোটা নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও চলতি মাসের শুরু থেকে তা জোরালো হতে শুরু করে। ছাত্র বিক্ষোভে এই মাসের মাঝামাঝি ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিবর্ষণ, দুই- শতাধিক মানুষের মৃত্যু, বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন, এবং ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা সারাবিশ্বে তোলপাড় তৈরি করে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯শে জুলাই শুক্রবার দিবাগত রাতে সরকার কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করা হয়। ইন্টারনেট বন্ধ ও নির্বাহী আদেশে টানা তিনদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।
এরপর থেকে ধারাবাহিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের পর শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করে অসহযোগ কর্মসূচি শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পাল্টা কর্মসূচি হিসাবে রবিবার আওয়ামী লীগ সারাদেশে জমায়েতের কর্মসূচি দেয়। ওই দিন দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতায় মারা যায় অন্তত নব্বই জন মানুষ। এই আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় তিনশো ভাষণের। আবারো সাধারণ ছুটি ঘোষণা, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়।
এর প্রেক্ষাপটে রবিবারই সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আবারো অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। তবে এর আগে শনিবারই আন্দোলনকারীরা আজ সোমবারের জন্য মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করে।
দুপুর পর্যন্ত ঢাকার প্রবেশপথ গুলো নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দুপুরের পর থেকে উত্তরাসহ কয়েকটি এলাকা দিয়ে আন্দোলনকারীরা শহরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। চানখারপুল, রামপুরা ও বসুন্ধরা এলাকায় সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
তবে দুপুর নাগাদ ঢাকা পথঘাট আক্ষরিক অর্থেই আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। হাজার হাজার মানুষকে ঢাকার প্রধান সড়কগুলো অবস্থান নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায়।
এর আগে গত পাঁচই জুন হাইকোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে দেয়া একটি পরিপত্র বাতিল করলে দেশে ছাত্র বিক্ষোভের সূচনা হয়।
পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় বাতিল করে কোটা সংস্কারের নির্দেশনা দিলেও পুলিশের গুলি ও সহিংসতায় প্রায় দুশো মানুষের মৃত্যুর প্রতিবাদে ও আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে নয় দফা দাবি জানিয়ে নতুন করে কর্মসূচি দিতে থাকে, যা শনিবার এসে এক দফা অর্থাৎ সরকারের পতনের দাবিতে রূপ নেয়।