নরসিংদীর রায়পুরায় একই সাথে ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত পাঁচ জনের কারও পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। যে কারণে ওই পাঁচ জনের লাশ দাফন করা হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে।
কিন্তু কীভাবে তারা একই সাথে একই জায়গায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেল, এখনও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে পুলিশ।
ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে নিহত ওই যুবকদের পরিচয় নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই।
কিন্তু তাদের কারও আঙ্গুলের ছাপে কোনও জাতীয় পরিচয়পত্র খুঁজে পাওয়া যায় নি।
পুলিশ বলছে, আঙ্গুলের ছাপে পরিচয় না মেলায় এবং তাদেরকে কেউ শনাক্ত করতে না পারায় লাশগুলোকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মো. শহিদুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত হওয়ার কারণে লাশগুলো থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। পরে বাধ্য হয়েই লাশগুলো রেলস্টেশনের কাছের কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।”
সোমবার সকাল সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেথিকান্দার রেলগেইট এলাকায় দুই কিলোমিটার অদূরে পলাশতলী ইউনিয়নের খাকচর কমলপুর এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে।
পুলিশের ধারণা যারা মারা গেছে তাদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। লাশগুলোর সাথে মোবাইল ফোন, পরিচয়পত্র কিংবা শনাক্ত করার কোন ক্লু খুঁজে পায় নি পুলিশ।
তবে এটি কি শুধুই দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও পুলিশের কাছেও তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
পুলিশ বলছে, নিহতরা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার কি না, ফরেনসিক রিপোর্ট আসার আগে পর্যন্ত তা নিয়ে কোনও কিছু নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
নরসিংদীর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের উপপরিদর্শক মোহাম্মদ জামির বলেন, “ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে তা জানতে পুলিশের প্রায় সবগুলো ইউনিট কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। তদন্তে হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হলে এটি হত্যা মামলায় স্থানান্তর করা হবে।”
দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড?
স্থানীয় লোকজন, পুলিশ ও রেল কর্তৃপক্ষ কেউই এই পাঁচজনের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা দিতে পারছেন না।
পুলিশের ধারণা, ভোরে চট্টগ্রাম থেকে তূর্ণা নিশীতা এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা যাচ্ছিলো। নরসিংদীর রায়পুরার খাকচক এলাকায় পৌঁছালে পাঁচ যাত্রী ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যান। এতে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়।
সর্বশেষ স্টেশনে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায় ভোরে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীতা ট্রেনটি মেতিকান্দা স্টেশন অতিক্রম করার সময় ট্রেনটির ছাদে কয়েকজন যাত্রী ছিল। তবে এই যাত্রীরাই মারা গেছেন কি না সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় সাংবাদিক আশিকুর রহমান পিয়াল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কেউ যদি ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মারা যায় তাহলে সবার লাশ এক জায়গায় থাকার কথা না। তাছাড়া ট্রেনের ছাদ থেকে পড়লে সবাই চলন্ত ট্রেনের চাকার নিচে কাটা পড়বে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
তাহলে কি এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?
এমন প্রশ্নে পুলিশ বলছে, প্রাথমিকভাবে এটি দুর্ঘটনা হিসেবেই তারা মনে করছেন। তাই এটি নিয়ে অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।
আবার কেউ হত্যার পর লাশ রেললাইনে ফেলে গেছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
নরসিংদীর পিবিআই কর্মকর্তা মি. জমির বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একই জায়গায় পাঁচটি লাশ। লাশগুলো আবার লাইনের মধ্যেই ছিল। এমন না যে লাশগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। এসব বিষয়কে মাথায় রেখেই আমরা তদন্ত করব”।
এই ঘটনায় পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ, সিআইডি, পিবিআই, ডিবি পুলিশসহ সবাই আলাদা আলাদা করে তদন্ত এরই মধ্যে শুরু করেছে বলেও রেলওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
পাঁচজন এক জায়গায় মারা যাওয়ার ঘটনা কি স্বাভাবিক হতে পারে? এমন প্রশ্ন ছিল রেলওয়ে পুলিশের কাছে।
জবাবে মি. শহীদুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের কাছেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। এমন হতে পারে তারা নেশাপানি করতে পারে। হতে পারে তারা ট্রেন লাইনের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।”
পুলিশ বলছে, যে পাঁচজন মারা গেছে তাদের মধ্যে একজনের বয়স ১৮ বছর, দুই জনের বয়স ১৯, একজনের ২২ এবং অপরজনের বয়স ২৫ বছর হতে পারে।
অর্থাৎ সবাই কিশোর কিংবা তরুণ। কেন তারা এক সাথে একই জায়গায় মারা গেছে সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই তদন্ত কাজ শুরু করার কথাই বলা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে।
ফিঙ্গার প্রিন্টেও মিললো না পরিচয়
সোমবার নরসিংদীর রায়পুরায় ট্রেনে কাটা পড়ে ওই পাঁচ জনের মৃত্যুর পর এটি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। শুরুতেই তাদের পরিচয় জানতে চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা-সহ কেউই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি।
সাধারণত বিভিন্ন দুর্ঘটনা কিংবা হত্যাকাণ্ডে মৃত কারও পরিচয় পাওয়া না গেলে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় শনাক্ত করে থাকে পুলিশ।
এরপর রেলওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে লাশ শনাক্ত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়।
প্রাথমিকভাবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই ওই পাঁচজনের মরদেহ শনাক্ত করতে উদ্যোগ নেয়। এজন্য ঢাকার হেডকোয়ার্টারের মাধ্যমে সার্ভার থেকে এনআইডি যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়।
পিবিআই জানায়, ওই পাঁচজনের আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হলেও সার্ভার থেকে থেকে তাদের ফিঙ্গারের বিপরীতে কোনও এনআইডি পাওয়া যায়নি।
নরসিংদীর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের এসআই মো. জমির বিবিসি বাংলাকে বলেন, “তাদের সবার ফিঙ্গার থেকে নো ম্যাচ ফাউন্ড লেখা আসছে। আমাদের ধারণা পাঁচজনের কারোরই এনআইডি নাই। যদি কারো থাকতো একজনের হলেও এনআইডি আসত।”
এরপর রেলওয়ে পুলিশ লাশ শনাক্তে সহযোগিতা নেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির। ঢাকা থেকে একটি টিম প্রযুক্তির সাহায্যে চেষ্টা করেও তাদের পরিচয় বের করতে পারেনি।
নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মি. শহিদুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের বিভিন্ন ইউনিট এটা নিয়ে চেষ্টা করছি পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। এমন কী তাদের সাথে মোবাইল, কার্ড কিংবা কোনও ধরনের পরিচয় শনাক্তের কিছুই ছিল না।”
দাফন হল বেওয়ারিশ হিসেবে
সোমবার রাত ১২টার মধ্যে নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে ওই পাঁচজনের মরদেহের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়।
ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর কারণে প্রতিটি মরদেহই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কারো মাথা হাত পা আলাদা হয়ে গেছে বলেও বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে পুলিশ।
রাতে ময়না তদন্ত শেষে পরে মরদেহগুলো নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়।
রেলওয়ে পুলিশ বলছে, প্রত্যেকটা মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার পর লাশের ময়নাতদন্ত শেষে সেগুলো আনার পর সেগুলো থেকে খুব দুর্গন্ধ আসছিলো।
নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মি. শহিদুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একটা লাশ রাখারও কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তাই আমাদেরও কিছু করার ছিল না। বাধ্য হয়েই আমাদের বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করতে হয়েছে।”
তবে পুলিশ বলছে, মরদেহগুলোর পরিচয় শনাক্তে এখনই হাল ছাড়বে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ জন্য ডিএনএ পরীক্ষার কথাও বলছে পুলিশ।
রেলওয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মি. ইসলাম বলেন, “ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা সিআইডির কাছে পাঠানো হবে। এ জন্য আদালতের অনুমতি দরকার হবে। সে জন্য বুধবার আমরা আদালতে পাঠাব কাগজপত্র।”
নরসিংদীর রেলওয়ের করবস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে তাদের দাফন করা হলেও প্রতিটি কবরের আলাদা করে সিরিয়াল নম্বর দিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রতিটি সিরিয়াল নম্বরের সাথে তাদের পরনের টুকরো টুকরো কাপড় আলাদা করে রাখা হয়েছে।
মি. শহীদুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কোনটা কার কাপড় সেগুলো আমরা সিরিয়াল করে রেখেছি। যদি কোন আত্মীয় স্বজন দেখে শনাক্ত করতে পারে, তখন যেন তারা সেই সুযোগ পায় সে কারণে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।”