ছবির উৎস, Getty Images
সন্ত্রাস দমন আইনে ধৃত নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ
ভারতের সংবাদ পোর্টাল নিউজক্লিকের সংবাদকর্মী, প্রবন্ধকারদের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চলার কারণে দেশের অনেক সাংবাদিকের মনেই এখন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। প্রতিটা খবর লেখার সময়ে তাদের মাথায় কাজ করছে যে সেটি কোনভাবে সরকারকে চটিয়ে দেবে না তো? তার ওপরে রাজরোষ এসে পড়বে না তো?
সম্পাদকরাও অনেক সময়ে ‘ঝামেলা যাতে না পড়তে হয়’ এই অজুহাতে লিখিত খবরের অংশ বাদ দিচ্ছেন। এমন কথাও বলছেন সাংবাদিকরা।
নারী সাংবাদিকদের আবার ভয় হয় যে তাদের খবর লেখার জন্য যেন বেশি করে ট্রল না হতে হয়, যেগুলো অনেকক্ষেত্রেই যৌন হেনস্থার সামিল।
আতঙ্ক যে একটা তৈরি হয়েছে, তা স্বীকার করছেন প্রবীণ সাংবাদিক ও প্রেস ক্লাব অফ ইণ্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী সহ একাধিক সাংবাদিক।
সাংবাদিকদের নির্ভয়ে কাজ করতে দেওয়ার জন্য বুধবার প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানিয়েছে দেশের ১৫টি সাংবাদিক সংগঠন।
ছবির উৎস, Getty Images
নিউজক্লিক পোর্টালের দপ্তরে যখন তল্লাশি চলছিল মঙ্গলবার
কেন এই আতঙ্ক?
সাংবাদিকদের আতঙ্কের সাম্প্রতিক কারণ হচ্ছে সংবাদ পোর্টাল নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থসহ দুজনকে সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেপ্তার। তার আগে মঙ্গলবার ভোর থেকে পোর্টালের ৪৬ জন কর্মী এবং পোর্টালের জন্য লিখেনে এমন লেখকদের বাড়িতে দিল্লি পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে এবং সবার ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে জেল খাটছেন কাশ্মীরের একাধিক সাংবাদিক। উত্তরপ্রদেশে এক ধর্ষণের ঘটনার খবর নিতে যাওয়ার পথে কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেপ্তার হয়ে দুবছরেরও বেশি সময় জেলে থেকেছেন।
অতি কঠোর সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেপ্তার হলে জামিন পাওয়া একরকম অসম্ভব। সন্ত্রাস দমন আইন ছাড়া আরও নানাভাবে সাংবাদিকদের তাদের লেখার জন্য গ্রেপ্তার হতে হয়েছে অথবা নানা ধরনের হেনস্থার শিকার হতে হয়।
ছবির উৎস, Getty Images
সিনিয়ার সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, তার বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়
কী জিজ্ঞাসাবাদ করা হল?
মঙ্গলবার ভোর ছয়টা নাগাদ দিল্লি পুলিশের দল নিউজক্লিকের সাংবাদিক ও নিয়মিত লেখকদের বাড়িতে হানা দিতে শুরু করে। এর থেকে ছাড় পাননি কেউ। দিল্লির সাংবাদিক মহল বলছে পূর্ণ সময়ের সাংবাদিক থেকে শুরু করে পার্টটাইম কাজ করেন সব কর্মীদের বাড়িতেই পুলিশ হানা দিয়েছিল ভোরবেলা।
প্রথমেই তাদের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়। অনেককেই নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের দপ্তরে।
সেখানে চলে টানা জিজ্ঞাসাবাদ। বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হলেও সম্পাদক ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারকে পরে গ্রেপ্তার করা হয়।
হিন্দি টিভি সাংবাদিকতার পরিচিত মুখ অভিসার শর্মা বুধবার সকালে এক্স (আগেকার টুইটার)-এ একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তিনি বিস্তারিতভাবে বলেছেন যে কী কী জানতে চাওয়া হয়েছিল তার কাছে।
“সকাল সাড়ে ছয়টায় দিল্লি পুলিশের দল আমার বাড়িতে আসে। ওই দলে কেন্দ্রীয় শিল্প নিরাপত্তা বাহিনী আর উত্তরপ্রদেশ পুলিশও ছিল, একজন নারী পুলিশও ছিলেন। তাদের একজনের হাতে লাঠি ছিল, বন্দুকও ছিল। তারা এসে বলে তারা সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত করছে। এর পরে শুরু হয় প্রশ্নের পালা।
“তারা জানতে চায় যে আমি এনআরসি-সিএএ ইস্যুতে শাহিনবাগে গিয়েছিলাম কী না, দিল্লিতে যে দাঙ্গা হয়েছিল তার গ্রাউন্ড রিপোর্টিং করেছিলাম কী না, কৃষক আন্দোলনের কভারেজ করেছি কী না”
“এখানেই শেষ নয়। আমার কাছে জানতে চাওয়া হয় যে পোল্যান্ডে কারও সঙ্গে আমি কথা বলি কী না। ব্রিটেন আর অস্ট্রেলিয়া থেকে কোনও ফোন আসে কী না, সেখানে কারও সঙ্গে কথা বলি কী না,” জানিয়েছেন অভিসার শর্মা।
“আমার বাড়িতে এসব প্রশ্নের জবাব জানার পরে লোদী কলোনীতে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, একই প্রশ্ন একটু এদিক ওদিক করে চারজন কর্মকর্তা আলাদা আলাদা ভাবে একই প্রশ্ন করেন আমাকে”
“আমি শাহিনবাগ হোক বা কৃষক আন্দোলন অথবা দিল্লি দাঙ্গা – গ্রাউণ্ড রিপোর্টিং করি না কিছু বাস্তবিক পারিবারিক কারণে। কিন্তু এই সব ইস্যু বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন – সব ইস্যুতেই আমি সংবাদ পর্যালোচনা করি স্টুডিওতে বসে,” জানিয়েছেন মি. শর্মা।
পোল্যান্ডে তিনি কাউকে চেনেন না কিন্তু ব্রিটেন আর অস্ট্রেলিয়াতে তার বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই কথা হয় তার।
তিনি বলেন, “আমার একটা অনুষ্ঠান দেখান যেখানে আমি চীনের পক্ষ নিয়ে প্রচার চালিয়েছি। একটাও পাবেন না। তবে হ্যাঁ আমি চীন নিয়েও অনুষ্ঠান করেছি। আমি চীন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছি। আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম যে জায়গায় ২০২২ এর আগে ভারতীয় সেনারা যেতে পারত, সেই অঞ্চল কী করে বাফার জোন হয়ে গেল? এই প্রশ্নও তুলেছিলাম যে কী করে ৩১ জন সেনা শহীদ হয়ে গেলেন? আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম যে ৩১ জন সৈনিক শহীদ হওয়ার ব্যাপারে আমার প্রধানমন্ত্রী কেন নিশ্চুপ?”
“আমি যদি দেশের সঙ্গে গাদ্দারি করে থাকি, তাহলে প্রমাণ দিন। সরকারকে প্রশ্ন করার অর্থ দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা নয়,” স্পষ্টই বলেছেন মি. শর্মা।
ছবির উৎস, Getty Images
দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের দপ্তর যেখানে নিউজক্লিকের সাংবাদিকদের দীর্ঘক্ষণ জেরা করা হয়েছে
ব্যক্তিগত তথ্য কেন নেবে পুলিশ?
“আমি যদি মঙ্গলবার দিল্লিতে থাকতাম তাহলে আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারতাম না। আমার এই ফোনটাও বাজেয়াপ্ত করে নিত পুলিশ,” বলছিলেন নিউজক্লিকের এক সাংবাদিক। তিনি অন্য রাজ্যে নিজের বাড়িতে গিয়েছিলেন, তাই তার দিল্লির বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালায় নি।
তিনি নিরাপত্তার কারণে নিজের নাম প্রকাশ করতে দিতে চান না।
“আমার কোনও সহকর্মীর সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারি না। সবার মোবাইল ফোনই তো নিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি দিল্লি ফিরে ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করলে জানতে পারব কী কী হয়েছে অভিযানের সময়ে,” বলছিলেন নিউজক্লিকের ওই সাংবাদিক।
তার কথায়, “এই যে তল্লাশির নামে আমার সহকর্মীদের সবার ব্যক্তিগত ফোন, ল্যাপটপ সব বাজেয়াপ্ত করা হল, সেখানে তো অনেক ব্যক্তিগত তথ্যও আছে! আমি আমার বান্ধবীর সঙ্গে কী কথা বলেছি চ্যাটে বা মায়ের সঙ্গে কী কথা হচ্ছে, সেসব কেন পুলিশ জেনে নেবে? আবার আমার খবরের সূত্রদের নম্বরও তো ফোনেই থাকে, তারা যে আমাকে খবর দেয়, সেটাও তো পুলিশ জেনে ফেলবে।
“এরপরে সাংবাদিক হিসাবে কি আমাকে কেউ বিশ্বাস করবে? তারা তো বলবে তোমাকে কোনও খবর দেব, তারপরে তোমার অফিসে তল্লাশি হবে আর আমার পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যাবে পুলিশের কাছে। এরপরে কাজ করব কী করে?” প্রশ্ন ওই সাংবাদিকের।
ছবির উৎস, Getty Images
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবীতে সরব সাংবাদিক সংগঠনগুলো
প্রশ্ন করতে চিন্তা করতে হয়
একজন সম্পাদকের গ্রেপ্তারি এবং সাংবাদিকদের বাড়িতে তল্লাশির ঘটনায় তরুণ সাংবাদিকদের মনেও ভয় ঢুকেছে।
মাত্র কিছুদিন হল মুম্বাইয়ের একটি পত্রিকায় চাকরি করছেন, এমন এক তরুণী সাংবাদিক বলছিলেন, “এই ঘটনাটা অত্যন্ত উদ্বেগের তবে এটাই তো প্রথম ঘটনা নয় যেখানে সাংবাদিকদের হেনস্থা করা হল। আজকাল এটাই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে।”
তিনিও নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। তার সমবয়সী সাংবাদিকদের মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে।
“এটা তো শুধু গ্রেপ্তারি, তবে হত্যার হুমকি বা নারী সাংবাদিকদের ধর্ষণের হুমকিও তো দেওয়া হয় নিয়মিতই। মেরেও তো ফেলা হয়েছে সাংবাদিকদের। আমরা তো আলোচনা করি যে এরকম একটা পেশায় থেকে কী জীবনের ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে?” বলছিলেন ওই সাংবাদিক।
তার কথায়, “সাংবাদিক হিসাবে প্রশ্ন করাটাই তো আমাদের কাজ। কিন্তু প্রশ্ন করতেই আজকাল ভয় হয়। আমার সমবয়সী সবারই মনে এই চিন্তাটা ঘুরপাক খায়।“
কিছু সাংবাদিকের মনে যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সেটা মানছেন প্রেস ক্লাব অফ ইণ্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ীও।
তার কথায়, “আমাকে অনেক সাংবাদিকই বলছেন গত দুদিন ধরে যে বাড়িতে তল্লাশির ঘটনায় তারা এবং তাদের পরিবারগুলো ভয় পাচ্ছে। যারা মনে করেন যে সরকারের নানা পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা করেন, সেগুলো আর করা যাবে কী না, এই প্রশ্নও উঠছে। তবে এই তো প্রথম নয়”
“ভারতীয় সাংবাদিকদের ওপরে এরকম কঠিন সময় আগেও এসেছে। সাময়িকভাবে ক্ষমতাসীন সরকার হয়তো ভয় দেখাতে পেরেছে, কিন্তু আমরা সবগুলোই পার করেছি সাহস নিয়ে,” বলেন মি. লাহিড়ী।
বিজেপি অবশ্য বলছে তারা মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী, কিন্তু কোনও সাংবাদিক যদি কোনও অ্যাজেণ্ডা নিয়ে অন্যায় কাজ করে, তাহলে তো আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়াই হবে।
বিজেপি নেতা জগন্নাথ চ্যাটার্জী বলছিলেন, “যদি সত্যিই অপরাধমূলক কাজ থেকে পাওয়া অর্থ, এক্ষেত্রে চীনের অর্থ নিয়ে, চীনের হয়ে প্রচারণা চালানোর কাজ করা হয়ে থাকে তাহলে আইনি পথেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই অর্থ নিয়ে যদি কেউ পালিত-পোষিত হয়, তাহলে তো সেও অপরাধী। কিন্তু কোনও অ্যাজেণ্ডা না নিয়ে যেসব সাংবাদিক কাজ করেন, তাদের ভয় পাওয়ার তো কোনও কারণ দেখি না আমি।“
ছবির উৎস, Getty Images
নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় নিউজ ক্লিকে চীনা অর্থায়ন হয়েছে
ভিত্তিহীন অভিযোগ
ওই পোর্টালে চীনা অর্থায়ন হয়েছে, এই অভিযোগ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ছাপা হয় অগাস্ট মাসে। ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বামপন্থী ধনকুবেরের মাধ্যমে চীন সরকার তাদের হয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালানোর জন্য অর্থায়ন করেন। এর পরেই ভারত সরকার এবং বিজেপি এই বিষয়টি নিয়ে সরব হয়।
তল্লাশির একদিন পরে, বুধবার নিউজক্লিক এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে তারা কোনওভাবেই চীনা সরকারের প্রচারণা চালায় না এবং নেভিল রয় সিংঘম নামের ওই ধনকুবেরের কাছ থেকে সম্পাদকীয় কোনও ধরণের পরামর্শ গ্রহণ করে না। তারা এটাও বলেছে তিন বছর ধরে বারে বারে আয়কর দপ্তর, অর্থ মন্ত্রকের তদন্ত শাখা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এবং দিল্লি পুলিশ নানা অভিযোগে তাদের দপ্তরে তল্লাশি চালিয়েছে, প্রতিটি নথি খতিয়ে দেখেছে, কিন্তু এখনও কোনও চার্জশিট জমা দিতে পারে নি তদন্তকারী সংস্থাগুলি।
ছবির উৎস, Getty Images
সম্পাদকের গ্রেপ্তারী ও সাংবাদিকদের বাড়িতে তল্লাশি বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখেছে বেশ কয়েকটি সাংবাদিক সংগঠন
সরব সাংবাদিক সংগঠনগুলো
ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে লেখা এক চিঠিতে প্রেস ক্লাব অফ ইণ্ডিয়া, ইণ্ডিয়ান উইমেন’স প্রেস কোর, ডিজিপাব নিউজ ইণ্ডিয়া ফাউণ্ডেশন সহ ১৫টি সাংবাদিক সংগঠন বলেছে, “ভারতের স্বাধীনতা তখনই নিরাপদে থাকবে যতক্ষণ সাংবাদিকরা প্রতিহিংসার হুমকি ছাড়াই কথা বলতে পারবেন।“
ওই চিঠিতে আবেদন করা হয়েছে যাতে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের কাছ থেকে কিছু বাজেয়াপ্ত করার ব্যাপারে একটা গাইডলাইন প্রকাশ করা হয়।