দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা হয়েছিলো বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ”একতরফা এই নির্বাচনে বিএনপির কিছু নেতাকে লোভ দেখিয়ে দল ভাঙার ষড়যন্ত্রও করেছিলো আওয়ামী লীগ। তাতে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে।”
গত ২৮ অক্টোবরের বিএনপি পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় আটকের সাড়ে তিনমাস পর গত বৃহস্পতিবার জেল থেকে মুক্তি পান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
মুক্তির পর শনিবার বিবিসি বাংলার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে মি. চৌধুরী দাবি করেছেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের আটকে রেখে নির্বাচন সফল করার যে উদ্যোগ তা সফল হয় নি।
বিএনপির এই নেতা বলেছেন, “বিএনপিকে ভোটে আনতে আওয়ামী লীগের সব কূটকৌশল ব্যর্থ হয়েছে”।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয় নি বলেও তিনি মনে করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দলটির আন্তর্জাতিক কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের পর দেশব্যাপী গ্রেফতার অভিযান শুরু হয় পুলিশের।
ঐ ঘটনার চারদিন পর ২ নভেম্বর রাতে আটক হন মি. চৌধুরী। সাড়ে তিন মাসের বন্দি জীবনের অভিজ্ঞতার কথাও বলছিলেন তিনি।
সাড়ে তিন মাসের জেল জীবনে বই পড়া ও শরীর চর্চার মাধ্যমে কাটানোর কথাও জানান এই নেতা। তিনি বলছিলেন, “বই পড়লে জেল জীবনের কষ্ট কিছুটা হলেও ভুলে থাকা যায়”।
তিনি মনে করেন, জেলের সবচেয়ে বড় সংকট অসুস্থতা। কেননা, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা না পেয়েও অনেকে মারা গেছেন, যেটি তিনি নিজেও জেলে বসে দেখেছেন। সেই শঙ্কা তারও কাজ করছিলো।
কারাগারে বৈঠক হয়েছিল?
২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি মহাসচিব, শীর্ষ নেতাসহ কয়েক হাজার কর্মীকে আটকের কয়েকদিনের মাথায় ঘোষণা করা হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। এই নির্বাচনে অংশ নেয় নি বিএনপি।
আটক বিএনপি নেতাদের মুক্তির শর্ত হিসেবে ভোটে অংশ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিলো বলে তখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে।
এই প্রস্তাব কী বিএনপির র্শীষ নেতাদের সবাই পেয়েছিলেন? বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিলেন মি. চৌধুরীর কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “লুকোচুরি করে বিএনপি কম্প্রোমাইজ করবে এটা আওয়ামী লীগ কিভাবে সেটা ভাবলো? এটা আবার তারা পাবলিকলি বলছে, অথচ বিব্রত হচ্ছে না তারা। আওয়ামী লীগ নীতি নৈতিকতা হারিয়ে ক্ষমতা দখল করবে, আর বিএনপির মতো দল তাদের সাথে নেগোশিয়েট করবে এটা ভাবাও তো বোকামি”।
কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগমীর বাংলাদেশের দৈনিক সমকালকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিএনপিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে কারাগারে সরকারের কোনো ‘প্রতিনিধি’র সঙ্গে বৈঠক হয়নি।
তিনি বলেছেন, ”কারাগারে আমার সঙ্গে নির্বাচন বা রাজনৈতিক ইস্যুতে কারও কোনো বৈঠক হয়নি। কেউ সাক্ষাৎও করেননি।”
বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মনে করেন ২৮ অক্টোবরের সংঘর্ষের ঘটনা ছিলো সরকারের পূর্ব পরিকল্পিত।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার যখন দেখলও বিএনপির জনসমাবেশে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি। তখন তারা মানসিকভাবে চাপের মধ্যে চলে গিয়েছিলো”।
“সরকারের পরিকল্পনা ছিলো বিশাল জনসভায় এমন কিছু ঘটনা ঘটানো হবে, এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা ও সাড়াশি অভিযান চালানো হবে। তারা সেটি করেছে। এবং এমন কায়দায় নির্বাচনও করে ফেলেছে সরকার”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. চৌধুরী।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “দেশের মানুষ এই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকার আর নির্বাচন কমিশন যে ফলাফলই দেখাক বাস্তবে ভোটার উপস্থিতি ছিলো তিন থেকে চার শতাংশ”।
“অবৈধ একটি নির্বাচন বয়কট করার জন্য বিএনপি সারাদেশের মানুষের কাছে আবেদন করেছিলো। দেশের মানুষ সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছে। এটা হলো বিএনপির ফাইনাল বিজয়। আন্দোলনে বিজয়ের চেয়ে এই বিজয় আরও অনেক বড়”, বলছিলেন মি. চৌধুরী।
আওয়ামী লীগের কৌশল ব্যর্থ দাবি বিএনপির
গত সাতই জানুয়ারির নির্বাচনকে পাতানো দাবি করে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছে বিএনপি। এই নির্বাচন বাতিলের দাবিতে তারা বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মূল্যায়ন, “একটা দল নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে নিজেদের বিরুদ্ধেই নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে। ভোট চুরি করেছে। ক্ষমতা দখল করেছে। যা করেছে সবই করেছে নির্লজ্জভাবে”।
“একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে বিএনপি নেতাকর্মীদের ভোটে আনার পরিকল্পনা করেছিলো। নির্বাচনের বৈধতা দেখাতে তারা চেয়েছিলো। তারা টোটালি ফেইল করেছে। তারা সেটি পারেনি” জানান মি. চৌধুরী।
২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর দেশে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গত ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করছে বিএনপি। এ সময় দল ভাঙতে সরকার চেষ্টা করছে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
“টাকা পয়সা দিয়ে চেষ্টা করছে। সংসদ সদস্য বানানোর লোভ দেখানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ভোটে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে। তবু বিএনপি ভাঙেনি বরং আরও পোক্ত দলে পরিণত দলে পরিণত হয়েছে”, বলছিলেন মি. চৌধুরী।
তার মতে, বিএনপি ভাঙার এই চেষ্টার ব্যর্থতাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় পরাজয়।
এই নির্বাচনের আগেই তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম নামে দুটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বিএনপি বরাবরই অভিযোগ করে আসছে এই দল দুটি সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে নিবন্ধন পেয়েছে। এই দুটি দলে বিএনপির সাবেক কয়েকজন নেতাও যোগ দিয়েছেন।
বিএনপি মনে করছে, নতুন দল বানানো, তাতে বিএনপির কিছু নেতাকে যোগদান করানো সবই হয়েছে সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে। এবং সেগুলো সবই ছিলো বিএনপিকে ভাঙ্গার চেষ্টা। সরকারের এই চেষ্টা সফল হয় নি বলে মনে করে বিএনপি।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, “নিজেরা ভোটে জিততে তারা বিএনপিকে কৌশলে ভোটে আনার চেষ্টা করলো। সেটি না পেরে তারা বিএনপি ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে। না পেরে বিকল্প দল তৈরি করলো। সেই দলগুলোও ফিরলো খালি হাতে”।
নির্বাচনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন বিএনপির
সাতই জানুয়ারির নির্বাচনের পর ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিশ্বের আরও বেশ কিছু দেশ সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। সরকারের সাথে কাজ করার কথা বলেছে বিএনপি। এই বিষয়টিকে বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ।
তবে আওয়ামী লীগের এই চিন্তাকে অযৌক্তিক মনে করছে বিএনপি।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। দলটির সরকার বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিদেশি কূটনীতিকদের সাথে বৈঠকে তাকে দেখা গেছে। কারামুক্তির পর তার কাছে আন্দোলনের কূটনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন করা হয়েছিলো।
তিনি মনে করেন, কোন দেশের সাথে অন্য দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থাকা আর সমর্থন এক জিনিস না।
মি. চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পশ্চিমা বিশ্ব যে সরকার আসবে তাদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঠিকই রাখবে। তাতে যে নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থানের পরির্বতন হয়েছে সেটি মনে করলে সেটা ভুল হবে। বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র বা ভোটাধিকারের ব্যাপারে এগুলো থেকে কারো অবস্থানের পরিবর্তন হয় নি”।
“আন্তর্জাতিক বিশ্বের মনোভাব আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। এটা থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ সরকারের নেই যতদিন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না হয়”, বলছিলেন মি. চৌধুরী।
এখন কী করবে বিএনপি?
সাতই জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পর আটককৃত বিএনপির শীর্ষ নেতাসহ অনেকেই মুক্তি পেয়েছে। নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি ছোটখাটো কর্মসূচি দেয়ে এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন রয়েছে, সরকার পতনে বিএনপির এই আন্দোলন কী আরও চলবে? আগামী দিনে বিএনপির রাজনৈতিক এজেন্ডাই বা কী হবে? এ নিয়ে খোলামেলা উত্তর দিয়েছেন কারামুক্ত বিএনপির এই নেতা।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিএনপির আন্দোলন ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়ার আন্দোলন না। এটা বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির আন্দোলন। যে আন্দোলনে দেশের জনগণ বিএনপির পক্ষে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে সরে যাওয়ার কোন উপায় নাই”।
বিএনপির এই আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নানা ধরনের নেতিবাচক বক্তব্য দিতে দেখা গেছে ভোটের পরও। বিএনপিকে ব্যর্থ ও নেতৃত্বহীন দল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের এমন মন্তব্যে মি. চৌধুরী বলেন, “নেতৃত্ব-ছাড়া বিএনপির এত লোকের বিরুদ্ধে যদি মামলা দিতে হয়। এত লোককে প্রাণ দিতে হয়। গুম করতে হয়। তাহলে নেতৃত্ব থাকলে সরকার কী করতো?