বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আর এক মাসও বাকি নেই অথচ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ কোন দলই এখনো নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেনি।
নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলোর মধ্যে দুই প্রধান দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি জানিয়েছে ইশতেহার চূড়ান্ত করার কাজ করছে তারা এবং আগামী দু সপ্তাহের মধ্যেই তারা এই ইশতেহার প্রকাশ করবেন।
এই ইশতেহারে সাধারণত দলগুলো কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে যার ভিত্তিতে দলটি নির্বাচনে জিতলে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করার কথা।
কিন্তু একেবারে শেষ সময়ে এসে ইশতেহার দেয়ার কারণ কী এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বলছেন ইশতেহার নির্বাচনী প্রচারের অংশ এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক প্রচারের সময় এখনো আসেনি।
“আমাদের কাজ চলছে। সময় এলেই ঘোষণা করা হবে। তাছাড়া প্রতিটি দলের এ বিষয়ে নিজস্ব কৌশল আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাসরুর মাওলা বলছেন দলগুলোর শেষ সময়ে ইশতেহার দেয়ার বড় কারণ হলো সব দলই চায় তার ইশতেহার যেন অন্যরা নকল করতে না পরে।
“সবাই নতুন কিছু দিতে চায়, এটাও একটা কৌশল,” বলছিলেন তিনি।
নির্বাচনব্যবস্থা রয়েছে এমন দেশগুলোতে সাধারণত ভোটের বেশ আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার ঘোষণার চল রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক্ষেত্রে ধীরগতি দেখা যায়।
তবে নির্বাচন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলছেন বাংলাদেশের দলগুলোর কাছে ইশতেহার একটি রুটিন ওয়ার্ক এবং তারা তাদের মতো করে এটি তৈরি করেন, যার অনেক কিছুই বাস্তবায়নযোগ্যই হয় না।
“ইশতেহার নিয়ে ভোটারদেরও খুব একটা আগ্রহ থাকে না বাংলাদেশে। গবেষকদের শুধু কাজে লাগে রেফারেন্স হিসেবে কাজের জন্য।এজন্য শেষ সময়ে একটা কিছু তারা প্রকাশ করে, যাতে সার্বিক দর্শনের কোন ছোঁয়া থাকে না। আর সরকারি দল হয়তো চায় যে এমন কিছু থাকুক যাতে সে পরে বলতে পারে ইশতেহার অনুযায়ী এটা করেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, আগামী ৭ই জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের তারিখ। তার আগে একুশ দিন নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারে প্রার্থী। এবার বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো এ নির্বাচন বর্জন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে।
আরেকটি বড় দল জামায়াতের নিবন্ধনই নেই, তারাও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নেই।
ইশতেহার শেষ সময়ে কেন
কয়েকটি দলের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে দেরি হওয়ার মূল কারণ হলো ইশতেহারের দায়িত্বে থাকা নেতারা নিজেরাও রাজনীতি ও নির্বাচন করা নিয়ে ব্যস্ত থাকা।
এছাড়া দলগুলো মনে করে তাদের ইশতেহার যেন অন্যদের চেয়ে ভিন্ন কিছু হয়, যা অন্তত গণমাধ্যমের দৃষ্টি কাড়তে পারে। সেজন্য বিলম্ব করে ঘোষণর একটি প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আছে।
“সব শেষ করে এটাকে সামনে আনা হয় মানুষের দৃষ্টি কাড়ার জন্য। তারা মনে করে এ নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা হবে, লোকে প্রশংসা করবে। এভাবে একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা হবে,” বলছিলেন প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।
ড: বজলুল হক খন্দকার বলছেন তার ধারণা অন্যরা যেন আগে থেকে না জানতে পারে-এই কৌশল সব দলই অবলম্বন করে ইশতেহারের ক্ষেত্রে।
আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ইশতেহার তৈরি পর তাতে দলীয় প্রধান কিছু সংযোজন-বিয়োজন করেন, যাতে কিছুটা সময়ের দরকার হয়ে পড়ে।
তবে এবার যেহেতু নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে না সে কারণেই এমনিতেও ইশতেহারসহ নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে আলোচনাই কম হচ্ছে।
“অনেকে হয়তো ভাবতে পারে যে শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচনের মাঠেই না থাকতে পারি তাহলে ইশতেহার করে লাভ কী। আর ইশতেহার তৈরি হয় ভোটারদের বিবেচনা জন্য। কিন্তু এবার তো ভোটটাই একতরফা হয়ে যাচ্ছে। সেখানে ইশতেহারের গুরুত্বই বা কী থাকতে পারে দলগুলোর কাছে,” বলছিলেন মি. কলিমউল্লাহ।
তার মতে ইশতেহার যারা তৈরি করেন তারাও যেমন এতে কোন গুরুত্ব দেন না, তেমনি যাদের জন্য বানানো হয় সেই ভোটারদের কাছেও এর গুরুত্ব থাকে না।
যদিও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বলছেন আওয়ামী লীগ ইশতেহারে বিশেষ গুরুত্ব দেয় কারণ এই ইশতেহারের ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করে।
“বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের যে প্রতিশ্রুতি ২০০৮ সাল থেকে দেয়া হয়েছে লক্ষ্য করলে দেখবেন আওয়ামী লীগ সরকার ধাপে ধাপে সেভাবেই এসব খাতের উন্নয়ন করেছে। তাই অন্যরা কি করে জানিনা, আমাদের কাছে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ইশতেহার কী, কীভাবে তৈরি হয়
বিশ্লেষকরা বলছেন ইশতেহার হলো বাস্তবতার আলোকে একটি দলের দেশ পরিচালনার দর্শন, যার ভিত্তিতে দলটি ক্ষমতায় গেলে পরবর্তী পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার কথা।
অর্থাৎ একটি দল নির্বাচনে জয়লাভ করার পর কী করবে তার একটি পরিকল্পনা হলো ইশতেহার। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি হয় কমই।
সাধারণত উন্নত দেশগুলোতে নির্বাচনের সময় দলগুলোর ইশতেহারকে যে গুরুত্ব দেয়া হয়, বাংলাদেশে সেই প্রবণতা নেই বললেই চলে।
মূলত এই ইশতেহারের বিভিন্ন ইস্যুকে ঘিরেই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতারা মুখোমুখি হয়ে তর্ক-বিতর্ক করে থাকেন, যা দেখে ভোটাররা কাকে ভোট দিবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা পেয়ে থাকেন।
এসব আলোচনা ও তর্ক বিতর্কে বিস্তারিতভাবে উঠে আসে তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, বিভিন্ন নীতিমালার ফলাফল কি হতে পারে, তাদের কোন উদ্যোগ সমাজের কোন স্তরকে কিভাবে প্রভাবিত করবে এমন আরও নানা ইস্যু।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এগুলো অনেকটাই বিরল বিষয়।
যেমন ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ঘোষণা করা ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত এবং নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো মৌলিক প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণী ও পেশাজীবী সংগঠন এবং সুশীল সমাজসহ দলমত নির্বিশেষে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে”।
বাস্তবতা হলো ওই ঘোষণার দশ বছরের মাথায় এবার যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তাতে নির্বাচন কার অধীনে হবে সেই বিরোধের জের ধরেই নির্বাচনের বছর আন্দোলন করছে বিরোধী দল বিএনপিসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল।
এ সংকট নিরসনে সংলাপের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুরোধও আমলে নেয়নি সরকারি দল আওয়ামী লীগ।
বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল না এলেও আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ ত্রিশটির মতো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবারের এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
এসব দলগুলোর নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের ইশতেহার ঘোষণার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের ইশতেহার কমিটির সদস্য ড: বজলুল হক খন্দকার বলছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মতামতের সঙ্গে দলের নীতি, আদর্শ ও পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটিয়ে তারা দলের ইশতেহার তৈরি করে থাকেন।
“প্রতিটি খাতের মানুষের সঙ্গে কথা বলি আমরা। এবার ওয়েবসাইটে মতামত আহবান করা হয়েছে যাতে সবাই মতামত দিতে পারেন। চূড়ান্তভাবে দলীয় সভানেত্রীর মতামতের আলোকে এটি চূড়ান্ত হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছেন তিনি।
প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন জাতীয় পার্টির নেতারাও।