শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে এক মাসেরও বেশি হয়েছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পুলিশ কাজে ফিরলেও তাদের তৎপরতা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে রাজধানীসহ সারাদেশে অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক হামলা, মাজার ভাঙা কিংবা বিভিন্ন সংঘাতেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সর্বশেষ শুক্রবার রাতে গোপালগঞ্জে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা মারা গেছে।
একই রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে দায়িত্বরত এক ট্রাফিক পুলিশকে চোরাগোপ্তা হামলা করে আহত করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
গত এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন কোন্দলে আহত কিংবা ছিনতাইকারীদের হাতে আহতের সংখ্যাও কয়েকগুণ বেড়েছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো জানাচ্ছে।
কেন বা কি কারণে এই ধরনের হামলা বাড়ছে সেটি নিয়ে কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না সরকারের পক্ষ থেকেও।
এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, পুলিশ মহাপরিদর্শক কিংবা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাথেও কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে। তবে এসব বিষয়ে তাদের কেউ কোন ধরনের কথা বলেন নি।
বুধবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দিনরাত পরিশ্রম করছে।
এসব ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের বেশ সরব প্রতিক্রিয়াও দেখা যাচ্ছে।
অনিরাপদ রাতের ঢাকা
বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবরে গত কয়েকদিন রাতের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা তুলে ধরা হয়। এসব ঘটনায় আহত ও নিহতদের অনেকেই নেয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর মুগদা এলাকায় কিছু যুবকদের মধ্যে সংঘর্ষে গুরুতর আহত কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে আনার পর মো. শাকিল নামে এক যুবককে মৃত ঘোষণা করে চিকিৎসকরা।
চলতি মাসে ঢাকায় এমন বেশ কিছু জায়গায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত ও নিহত হওয়ার খবরও মিলেছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে শুক্রবার রাত ৮টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত ৫৮ জন আহত হয়ে ভর্তি হয়েছে বলে মেডিকেল কলেজ সুত্র জানিয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মি. ফারুখ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বেশিরভাগই আহতরা রাতের বেলায় কিংবা শেষ রাতের দিকে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় আহত, কেউ ছিনতাইকারীদের হাতে যখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে”।
তিনি বলছিলেন, গত কয়েকদিনে এই পরিমাণ অনেকটা বেড়ে গেছে। তবে কেন বেড়েছে বা রাতের বেলায়ই কেন এত আহত হচ্ছেন সেটি নিয়ে কোন ধারণা দিতে পারেন নি। তবে বেশিরভাগ ঘটনা পরিকল্পিত বলে পুলিশের সদস্যরা ধারণা করছেন।
বাড়ছে রাজনৈতিক হামলাও
শুক্রবার সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জে বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এসএম জিলানীর গাড়িবহরে হামলায় একই কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক শওকত আলী দিদার নিহত হন।
ওই ঘটনায় অন্তত অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
বিএনপির অভিযোগ গোপালগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই হামলা চালিয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক সপ্তাহ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক হামলা, কিংবা পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটলেও মাঝে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু হঠাৎ করে রাজনৈতিক হামলা সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। এমনকি বিএনপির নিজেদের মধ্যেও কোথাও কোথাও কোন্দল ও সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু নিয়মিত এসব ঘটনা ঘটলেও পুলিশকে খুব একটা সরব ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না কেন সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মি. সাগর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে প্রত্যেকটি ইউনিটকে খুব কড়াভাবে নির্দেশনা দেয়া আছে। যেন কোন ধরনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘটনা না ঘটে। পুলিশ পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কাজ করছে”।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, গত দেড় দশকে পুলিশকে এতটা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে যে পুলিশের সঠিক দায়িত্ব কি সেটা অনেক পুলিশই ভুলে গেছে। যে কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাত সহিংসতা চাইলেও পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বিবিসি বাংলা বলেন, “যেখানে আইন না মানার চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে এর বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে পুলিশকে। না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগবে”।
পুলিশ কতটা নিরাপদ
শুক্রবার রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার জনপদ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছিলেন কনস্টেবল আশরাফ আলী।
এসময় পেছন থেকে মি. আলীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায় কয়েকজন ব্যক্তি। তবে তাদের পরিচয় পাওয়া যায় নি।
রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ওই পুলিশ সদস্যকে।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দায়িত্ব নিয়েছিল তখন পুরোপুরি কর্মবিরতিতে ছিল পুলিশ। পরে পুলিশের শীর্ষ পদসহ বিভিন্ন পদে রদবদল, বদলি করা হয়।
কাজে ফিরতে পুলিশকে আল্টিমেটাম দেয়ার পর পুলিশের কিছু শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ কিছু চিহ্নিত অপরাধের সাথে জড়িত বাদে অনেকেই কাজে ফিরেছে।
এমন অবস্থায় কোন কারণ ছাড়াই পুলিশ কেন কেন টার্গেট হামলার শিকার হচ্ছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন করেছেন সাবেক পুলিশ প্রধান মোহাম্মদ নুরুল হুদা।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যারা এ ধরনের অপরাধ করছে তাদের পেছনে উস্কানি থাকতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার কাজ হলো সেটি খুঁজে বের করা। পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালানো কোন ভাল লক্ষণ নয়”।
গত পাঁচই অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকাসহ সারাদেশের বেশিরভাগ থানায়ই হামলা হয়। এসময় অস্ত্র লুটপাটসহ পুলিশের সদস্যদের অনেকেও নিহত হয়েছে।
এমন অবস্থায় কর্মবিরতির পর কাজে ফিরে ওই হামলাকে পুলিশ কিভাবে দেখছে?
সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা দেখছি বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে। আমরা এ বিষয়ে সতর্ক আছি। যারা ঘটাচ্ছে প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে”।
তিন হাজারের বেশি লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে চৌঠা সেপ্টেম্বর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। যদিও এখনো সেই অভিযানে এখন পর্যন্ত মাত্র দেড়শোর মতো অস্ত্র উদ্ধার করা গেছে।
মাজার ভাংচুর ও সাম্প্রদায়িক হামলা
গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সুফি মাজার ভাঙার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও কোথাও মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।
এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইভেন্ট খুলেও মাজার ভাঙতে উৎসাহী করে তুলতে দেখা গেছে।
এরই মধ্যে গত সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের দেওয়ানবাগ মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু হঠাৎ করে এমন মাজার ভাঙার ঘটনাগুলো কেন সামনে আসছে বা কারাই বা এগুলো ঘটাচ্ছে সেটি নিয়ে প্রশ্নও উঠছে।
প্রতিবাদ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার ও শনিবার ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও কর্মসূচি পালন করতেও দেখা গেছে।
যদিও বিভিন্ন জায়গায় এসব ঘটনার পর পুলিশের খুব একটা তৎপরতা চোখে পড়েনি।
এমন অবস্থায় শনিবার বিকেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেস উইং থেকে এ নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “আমাদের নজরে এসেছে যে, গত কয়েকদিন ধরে কিছু দুর্বৃত্ত দেশের সুফি মাজারগুলোতে হামলা চালাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা এবং সুফি মাজার সম্পর্কিত যে কোনো বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং হামলার তীব্র নিন্দা জানায়”।
এছাড়াও সম্প্রতি খুলনায় ইসলামের নবী মুহাম্মদকে কটূক্তি করার অভিযোগ তুলে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক কিশোরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনাও তৈরি হয়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় এ ধরনের ঘটলেও বর্তমানে পুলিশ এসব পরিস্থিতি কেন ঠিকভাবে সামাল দিতে পারছে না সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
শনিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতিকে বিঘ্নিত করার যেকোন প্রচেষ্টা সরকার দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করবে। ধর্মীয় উপাসনালয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা রক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থায় ভোগান্তি
রাজধানীর ঢাকার যানজট বহু পুরোনো সমস্যা। অতীতের বিভিন্ন সময় এই সমস্যা সমাধানে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে হিমশিম খেতে হয়েছে।
গত ৫ই অগাস্ট সরকারের পরিবর্তনের পর এক সপ্তাহের বেশি সময় ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছিল। তখন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কিছুটা শৃঙ্খলাও ফিরেছিল।
গত আগস্টের মাঝামাঝি ট্রাফিক পুলিশ কাজে ফেরার সাথে সাথে রাস্তায় বেড়ে যায় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা।
আগে থেকে যে সব প্রধান সড়কে রিকশা ও রাস্তায় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ ছিল সে সব রাস্তায় বিপুল সংখ্যক রিকশা ও অটোরিকশা চলাচলের কারণে রাস্তায় তীব্র যানজট দেখা যাচ্ছে।
এমনকি শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালেও দেখা যাচ্ছে এসব অটোরিকশা।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যদি কেউ মনে করে স্বাধীন হয়েছি মানেই সব কিছু করতে পারবে সেটা ভুল। সবাইকে সবার আগে নিয়ম আর আইন মানতে হবে”।
এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে নতুন সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া উপস্থাপন করা।
এসব দাবি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন গ্রুপ রাস্তা আটকে আন্দোলন করছে। এতে তীব্র ভোগান্তিও তৈরি হচ্ছে।
কিন্তু এসব ঘটনায় পুলিশ নিজে থেকে খুব একটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না।
পুলিশের সাবেক আইজি মি. হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিগত সরকারের পুলিশের কিছু কর্মকর্তার অনৈতিক বল প্রয়োগের কারণে সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশের যে বিরুপ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সে কারণে সংকট রয়ে গেছে। এটা দূর করা না গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো অনেক সময় লাগবে”।