১৪৪২ হিজরি সন শুরু হতে যাচ্ছে। ইসলামী বছর শুরু ও শেষ হয়েছে ত্যাগের মাধ্যমে। মহান রাব্বুল আলামিন যেদিন আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন সে দিনই মাসের সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে মহররম মাসে অনেক ঘটনা ঘটেছিল।
অথচ আমরা বেশিরভাগ মানুষ কখনও এ মাসটি এলে এবং এ মাসের করণীয় সম্পর্কে উদাসীন। জেনে অবাক হবেন, হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদে মহররম মাসের নাম এসেছে ‘দাহাম’ নামে। তাওরাতে এসেছে ‘সুহরীয়’। জবুরে এসেছে ‘মুহিত’।
ইঞ্জিলে এসেছে ‘মহরারা’ আর আরবিতে ‘মহররম’। মহান আল্লাহ পাক ইজা আরাদা শাইআন আই ইয়াকুলা লাহু কুন ফাইয়াকুন (সূরা ইয়াসিন ৮২ নং আয়াত)। উচ্চারণ করেছিলেন। সেদিন ছিল মহররমের প্রথম দিন। তাই পৃথিবীর জন্মোৎসব পালনের প্রতি অনিহা থাকার কারণ জানা যাচ্ছে না।
বাংলা সনের শুরুর দিন থেকে যেভাবে লাল রঙের হালখাতায় মানুষ নতুন হিসাব লিখতে থাকে। একইভাবে ইসলামী বছরেরও হালখাতা আছে। তবে তা কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। এ খাতা থেকে কেয়ামতের মাঠে পড়ে শোনানো হবে। এ খাতাটি আমাদের হাতেই দেয়া হবে। আমাদের ডান হাতে মহান আল্লাহ পাক এই খাতা দিলে তবেই সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য তারাই যাদের বাম হাতে দেয়া হবে। এটি হাদিস শরিফের কথা খাতাটির নাম আমলনামা।
এ মাসের তাৎপর্য খুবই গভীর। হজরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়েছিল। তাই এ মাস তওবা কবুলের মাস। এ মাসে হুজুর (সা.) কম কথা বলতেন এবং কোরআন তিলাওয়াত ও নফল নামাজে সময় অতিবাহিত করতেন।
এ মহররম মাসে যতগুলো ঘটনা ঘটে গেছে সব রহমতের। হজরত ইউনুস (আ.) কে মাছ যখন গিলে ফেলল তখন ইউনুস (আ.) শুধু আল্লাহকে ডেকেছেন। ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন’ এই দোয়ার বদৌলতে ইউনুস (আ.) নাজাত পেলেন। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সুফি সাধক কারি হাফেজ মাওলানা আওলাদে রাসূল হজরত সৈয়দ রশীদ আহমেদ জৈনপুরী (র.) এজাজত দিয়েছেন কঠিন সময়ে উক্ত দোয়া শোয়ালক্ষ, শোয়ালক্ষ ও শোয়ালক্ষ এই তিনবারে পড়ে শেষ করলে মুক্তি মিলবে। তবে শুদ্ধ উচ্চারণে।
এ মাসের ১০ তারিখে হজরত ইবরাহিম (আ.) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। ফেরেশতার সাহায্যকে উপেক্ষা করে ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল’ আল্লাহ পাকের খুশিতে আগুনের কুণ্ডলি ফুলের বাগানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এটি সূরা আল ইমরানের ১৭৩ নং আয়াত। হজরত গাউসুল আযম শেখ সৈয়দ মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জীলানী (র.) বলেছেন : ‘তোমাদের হাতের তলোয়ার হচ্ছে এ আয়া
তটি। এটা দিয়ে না হওয়া কাজ হয়ে যায়। প্রতিদিন ওই আয়াতটি পড়ার আগে ও পরে ৩১৩ বার বিজোড় সংখ্যক দরুদ শরিফ পড়তে হবে।
হুজুর জৈনপুরী (র.) মহররম মাসের চাঁদ দেখার পর কিছু আমলের এজাজত দিয়েছেন। প্রথমটি হল চাঁদ দেখার পর মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে ২ রাকাত নফল নামাজ পড়তে হবে।
প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর ৩ বার আয়াতুল কুরসি এবং ৩ বার সূরা ইখলাস দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতেহার পর ১ বার আয়াতুল কুরসি এবং ১ বার সূরা ইখলাস সালাম ফিরানোর পর ২১ বার সূরা মুলক। আগে পরে দরুদ শরিফ।
দ্বিতীয় আমলটি হল : চাঁদ ওঠার রাতে এশার নামাজের পর অর্থাৎ রাত ১০টা, ১১টা ১২টার দিকে ৪০ রাকাত নফল নামাজ পড়তে হবে। ২ রাকাত করে নিয়ত করতে হবে। এ নামাজ হজরত গাউসুল আযম পড়তেন, হজরত মঈনুউদ্দীন চিশতী (র.) হজরত যুনায়েদ বাগদাদী এবং হজরত আলী (রা.) পড়তেন। প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কাফিরুন ও ফালাক, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কাফিরুন ও নাস।
দুই রাকাত পর সালাম ফিরিয়ে বোতলের পানিতে ফুঁ দিয়ে বোতলের মুখ বন্ধ করতে হবে। প্রতি ২ রাকাত নামাজের পর পানিতে ফুঁ দিতে হবে এভাবে ৪০ রাকাত নামাজ পড়তে হবে। ৪০ রাকাত নামাজ পড়াকালীন কোনো কথা কারও সঙ্গে বলা যবে না।
এ নামাজ যারা পড়বে ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকবে। ফুঁ দেয়া পানিটি খুবই বরকতপূর্ণ মহৌষুধ। এ পানিটি বিশেষ করে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার, পাইলস এবং সংক্রামক রোগীকে খাওয়ালে রোগমুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ। বেশি করে পানিগুলো রাখতে হবে যাতে সারা বছর চলে। নিজের এবং অন্যদের দিতে পারা যায়। যে রোগের ওষুধ নাই এ পানি তা কাজ করবে। পানি শেষ হওয়ার আগে পানি মেশানো যাবে। শুদ্ধ উচ্চারণে, বিশ্বাসের সঙ্গে এবং গভীর মনোযোগের সঙ্গে নামাজটি পড়তে হবে।
হুজুর (সা.) মহররমের ৯ এবং ১০ অথবা ১০ এবং ১১ তারিখে রোজা রাখার কথা বলে গেছেন। যারা এ রোজা রাখে তারা যেন পুরো বছরই রোগা রাখার সওয়াব পাবে। আবার অনেকে বেশি সওয়াবের আশায় প্রথম ১০ দিন রোজা রাখে।
তিনি আরও বলেছেন : এ মাসে প্রতিদিন একবার সূরা ইয়াসিন, তিনবার সূরা মুজ্জাম্মিল, একবার সূরা আর-রহমান পড়ে আল্লাহ পাকের কাছে কিছু চাইতে। হজরত সৈয়দ রশীদ আহমেদ জৈনপুরী (র.) বলেছেন : ৬১ হিজরি ১০ মহররম কারবালায় হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত সব আনন্দকে শেষ করে দিয়েছে। এ মাসে যে বর্বরতা ঘটেছিল কারবালার প্রান্তে যা নবীপ্রেমিকদের চোখে অশ্রু ঝরিয়েছিল।
তাই এ মাসে কোরআন খতম কর। ফাতেহা খানি কর। সব ফাতেহার সওয়াব হুজুর রাসূল (সা.)-এর দরবারে হাদিয়া করে দিয়ে তার উসিলায় সব নাবীঈন, সিদ্দিকীন এবং খাস করে হজরত হোসাইন (রা.)-এর প্রতি সওয়াব রেসানি করবে। তাদের উসিলায় আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করবেন এবং জবানটা নুরানি করে দেবেন, অভাব-অনটন দূর করে দেবেন। আল্লাহ আমাদের আমলগুলো করার তৌফিক দিন।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
সূত্র: যুগান্তর