বছর দশেক আগে পাওয়া বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের চেক ফেরত পাঠিয়েছেন বাংলাদেশি সাহিত্যিক জাকির তালুকদার। এরপর থেকে এ ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা ডালপালা মেলেছে সামাজিক মাধ্যমে। সাহিত্য পুরস্কার এবং একাডেমির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও আরও অন্তত নয়টি পুরস্কার দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। এসব পুরস্কারের উদ্দেশ্য, প্রদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা।
তবে, সাহিত্যিকদের কেউ কেউ মনে করেন সাহিত্য পুরস্কারের মনোনয়ন অগণতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক।
নীতিমালা থেকে যা জানা যাচ্ছে
১৯৫৫ সালে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও প্রকাশনার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হয় একাডেমির। ১৯৬০ সাল থেকে প্রবর্তন করা হয় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।
এ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রকাশিত নীতিমালায় এর উদ্দেশ্যকে এক বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে।
“বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমসাময়িক জীবিত লেখকদের মৌলিক এবং সামগ্রিক অবদান চিহ্নিত করে তাদের সৃজনী প্রতিভার স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করাই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের উদ্দেশ্য।”
কবিতা, কথাসাহিত্য, গবেষণা, নাটকসহ সাহিত্যের ১১টি শাখায় এ পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রতি শাখায় সাধারণত একজন করে নির্বাচন করা হয়।
এর আগে অর্থমূল্য এক লাখ টাকা থাকলেও বর্তমানে পদকপ্রাপ্তরা তিন লাখ টাকা করে পেয়ে থাকেন।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা
নীতিমালার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের এই পুরস্কার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যোগ্যতা হিসেবে কী কী বিবেচিত হবে তা উল্লেখ করা আছে।
প্রথমেই বলা হয়েছে, “শুধু বাংলাদেশের নাগরিক এই পুরস্কারের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।”
এরপর উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা, সার্বভৌমত্ব, প্রচলিত আইন ও শুদ্ধাচার পরিপন্থি কোনো সাহিত্যিক এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।
এটি কেবল ব্যক্তিকে দেয়া হবে উল্লেখ করে তৃতীয় দফাটিতে আরও বলা হয়েছে কোনো প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা দলকে পুরস্কার করা প্রদান করা যাবে না।
কোনো সাহিত্যিককে কেবল একবারই এই পুরস্কার প্রদান করা হবে।
এর জন্য কোনো ব্যক্তিগত আবেদন গ্রাহ্য করা হবে না।
বাংলা একাডেমির সভাপতি, নির্বাহী পরিষদের সভাপতি ও সদস্যবৃন্দ এবং সাহিত্য পুরস্কার কমিটির কোনো সদস্য এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন না।
মূলত এগুলোকেই প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য এই বিশেষ স্বীকৃতি তুলে দেয়া হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনালগ্নে।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের অর্থমূল্যের চেক, সম্মাননাপত্র ও সম্মাননা প্রতীক প্রদান করা হয়।
জাকির তালুকদার কেন ফিরিয়ে দিলেন
রোববার ফেসবুক পোস্টে চেক ফিরিয়ে দেয়ার কথা জানান সাহিত্যিক জাকির তালুকদার।
পরদিন সোমবার বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো চিঠি ও সংযুক্তিও তিনি তার ফেসবুকে তুলে দেন।
এর আগে বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলেন মি. তালুকদার।
বই নির্বাচনে একাডেমির কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ জানান এই সাহিত্যিক।
বলেন, “দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপিগুলো আসে। সেগুলো তারা ফেলে রাখে। দেখেই না।”
সারা বছর যে সভা সেমিনার হয় সেখানে ইচ্ছেমত অযোগ্য লোকদের ডাকে বলেও অভিযোগ তার।
এর আগে প্রতিষ্ঠানটির অব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনজন মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলার দাবি করেছেন তিনি।
“সবাই সমস্যাটা স্বীকার করলেও সমাধানের উদ্যোগ কেউ নেননি”, মন্তব্য জাকির তালুকদারের।
তিনি বলেন, “বলেছিলাম কার্যনির্বাহী পরিষদের অন্তত নির্বাচনটা দেন। তাহলে ছয়জন নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকবেন পরিষদে। অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদ করতে পারবেন।”
এ মাসের ২৪ তারিখ ঘোষণা করা হয় এ বছরের সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম। বিগত কয়েক বছরের পুরস্কারের তালিকা নিয়েই জোরালো অভিযোগ তার।
“এখন তো পুরস্কারের কোটা তারা ঠিক করে দিয়েছেন যে আমলা এই কয়জন, বাংলা একাডেমিতে কর্মরত এই কয়জন, তারপরে তাদের তাদের বন্ধু স্থানীয় কয়েকজন পাবেন।”
একই বিষয়ে ফেসবুকে তিনি লেখেন, “নিশ্চয়ই যে কোনো পেশার লেখক পুরস্কার পেতে পারেন। কিন্তু যখন অধিকতর যোগ্য লেখককে বাদ দিয়ে তাকে পুরস্কারটা দেওয়া হয়, তখন সমালোচনা হবেই।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কোনো ব্যবহারকারী জাকির তালুকদারের পদক্ষেপের প্রশংসা যেমন করেছেন তেমনি প্রশ্নও তুলতে দেখা গেছে অনেককে।
একে “মনোযোগ আকর্ষণ” কিংবা “আলোচনায় থাকার ইচ্ছা” বলেও ভাবছেন কেউ কেউ।
আবার কেউ এই প্রচেষ্টাকে “আধা বিপ্লব, আধা আপোষ” মন্তব্য করে সময়ের ব্যবধানটাকে সামনে এনেছে দেখা গেছে।
সোমবারের ফেসবুক পোস্টে দশ বছরে তিনি কী করেছেন তার বর্ণনা যুক্ত করেছেন মি. তালুকদার।
লিখেছেন, “আলোচনা করেছি, সভা-সমাবেশে এসব কথা বলেছি, পত্রিকায় লিখেছি, ফেসবুকে লিখেছি অনবরত। প্রতিবাদের সর্বশেষ ধাপ পুরস্কার ফেরত দেওয়া। আমার মতো একজন লেখকের এরচেয়ে বেশি আর কোনো সামর্থ্য নেই।”
পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে কী বিধান
সাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের পুরস্কার প্রাপ্তদের সাম্প্রতিক তালিকার প্রতি ইঙ্গিত করে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পুরস্কারটাকেই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বাংলা একাডেমির পুরস্কার নিয়ে যা হচ্ছে এটা আমাদের বিব্রত এবং বিরক্ত করছে।”
এর কারণ হিসেবে তিনি রাজনীতির দোষ যেমন দেখছেন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, স্বজনপ্রীতি এবং একাডেমির কর্মকর্তাদের নিজ দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল না হওয়াটাকেও উল্লেখ করছেন।
মি. সাবের এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে।
“সেই সময়ের তুলনায় এখনকার অধঃপতন পুরস্কারের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে”, যুক্ত করেন তিনি।
বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে একাডেমি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিলো। একাধিকবার মহাপরিচাল মুহম্মদ নূরুল হুদার ফোনে কল করলেও পরিচয় দেয়ার পর কেটে দেন তিনি।
এই বিষয়ে চেষ্টা করেও বাংলা একাডেমির দায়িত্বশীল অন্য কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে, নীতিমালা ও ওয়েবসাইট ঘেঁটে পুরস্কার ফেরত দেয়ার ব্যাপারে কোনো প্রক্রিয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারে জাকির তালুকদার নিজেই একরকম পথ বাতলে দেয়া চেষ্টা করছিলেন।
“যতদূর জানি, ফেরত নেয়ার এমন কোনো বিধি নেই। এখন তাদের হয়তো মিটিংয়ে বসে এমন বিধি তৈরি করতে হবে।”
একাডেমি আরও যে পুরস্কার দিয়ে থাকে
সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার
সমকালীন বাংলা সাহিত্যে অবদান ও সৃষ্টিশীল প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯০ সাল থেকে বাংলা একডেমি এ পুরস্কারটি প্রদান করছে। এতে লেখককে ৫০ হাজার টাকার চেক, সম্মাননা পত্র ও সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।
মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার
২০১০ সাল থেকে মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার প্রদান করে আসছে বাংলা একাডেমি। খ্যাতিমান এবং প্রতিভাবান কবিদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এক লক্ষ টাকা মূল্যমানের এই পুরস্কার দেয়া হয়।
কবীর চৌধুরী শিশু সাহিত্য পুরস্কার
শিশু সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখকদের সামগ্রিক অবদান চিহ্নিত করে তাদের সৃজনী প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সাল থেকে দ্বি-বার্ষিক এ পুরস্কারটি প্রদান করা হয়। পুরস্কারের মূল্যমান এক লাখ টাকা।
মেহের কবীর বিজ্ঞানসাহিত্য পুরস্কার
বিজ্ঞানসাহিত্যে জনপ্রিয় লেখকদের সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০০৫ সাল থেকে মেহের কবীর বিজ্ঞানসাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে আসছে বাংলা একাডেমি।
হালীমা শরফুদ্দীন বিজ্ঞান পুরস্কার
জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গ্রন্থাকারদের অবদান ও তাদের সৃষ্টিশীল প্রতিভার সম্মানে এই পুরস্কার প্রদান করে থাকে বাংলা একাডেমি।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায় অনুষ্ঠানিকভাবে আর্থিক চেক, সম্মাননা পত্র ও স্মারক প্রদান করা হয়।
একুশে বইমেলার শেষদিনে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার দেয়া হয়। প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালি লেখক এবং বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে যারা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন তাদের জন্য এই সম্মাননা।
রবীন্দ্র সাহিত্যের গবেষণা ও সমালোচনা এবং রবীন্দ্রসংগীতের আজীবন সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সাল থেকে বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করে আসছে।
এছাড়া আছে সাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ প্রবন্ধ পুরস্কার এবং কবি- জসীমউদদীন সাহিত্য পুরস্কার।
সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে আগেও বিতর্ক হয়েছিলো
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার- স্বাধীনতা পুরস্কার।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতির জন্যও একটি ক্যাটাগরি আছে এখানে। সেই ক্যাটাগরিতে ২০২২ সালের জন্য মরণোত্তর মনোনয়ন পান মো. আমির হামজা।
তালিকায় তার নাম দেখার পর অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন, কারণ মিস্টার হামজার নাম সাহিত্য অঙ্গনে আগে শোনা যায়নি।
জানা যায়, ‘বাঘের থাবা’ ও ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ শিরোনামে তার দুটি বই আছে।
তিনি খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এমন খবর প্রকাশ করে বাংলাদেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিক।
আরও জানা যায়, তার ছেলে একজন সরকারি কর্মকর্তা। মূলত তিনিই আবেদন করেছিলেন তার বাবাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার জন্য।
আর তাতে স্বাক্ষর করে সুপারিশ করেছিলেন একজন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা।
পরে মন্ত্রিসভা বিভাগ কতৃক গঠিত জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত কমিটি সেটি চূড়ান্ত করে নাম প্রকাশ করে।
এসব সমালোচনার প্রেক্ষাপটে পুরস্কারের তালিকা থেকে মো. আমির হামজার নাম বাদ দেয়া হয়।
এর আগে ২০২০ সালেও স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছিলো।
সাহিত্য ক্যাটাগরিতে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ নামে একজনের নাম ঘোষণা করার পর এর তুমুল সমালোচনা হয়।
আরও অনেকের সাথে বাংলা একাডেমির সাবেক একজন মহাপরিচালকও তখন সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করেন, পুরস্কৃত ব্যক্তির সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। এমনকি তার নামও কখনো শোনেননি বলে জানান অনেকে।
বিতর্কের মুখে সপ্তাহ তিনেক পর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি পরিবর্তিত নতুন তালিকা প্রকাশ করে।
দেখা যায়, সেখানে সাহিত্য ক্যাটাগরিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের নাম নেই।