বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান – আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে ২০১১ সালের এক মামলায় একুশ মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
তারা দুজনই বিএনপি আমলে মন্ত্রী ছিলেন। এর মধ্যে বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান মি. চৌধুরী অন্য মামলায় আটক হয়ে আগে থেকেই কারাগারে আছেন।
বিএনপি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত চার মাসে অন্তত একাশিটি মামলায় দলটির নয়জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সিনিয়র নেতা আমান উল্লাহ আমান-সহ দেড় হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে।
যার মধ্যে দশ বছর আগে গুম হওয়া ঢাকার শাহীনবাগের বিএনপি কর্মী সাজেদুল ইসলাম সুমনও রয়েছে। তাকে ২০১৩ সালের এক মামলায় গত মাসেই আড়াই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত।
ওদিকে কারাদণ্ড হওয়ার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন দলটির দুই নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ও মোহাম্মদ শাজাহান।
বিএনপির দাবি গত পনেরই নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত ৪৫হাজার ৫৫৩ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করে ৪২৩টি নতুন মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং এ সময়ে আটক করা হয়েছে অন্তত ১১ হাজার ৭৫৫ জনকে।
দলটির দাবি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ মামলায় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর পঞ্চাশ লাখেরও বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
গত কিছু দিন ধরে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কিছু পুরনো মামলার রায় দিচ্ছে আদালত।
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পদাক কায়সার কামাল বিবিসিকে বলছেন তাদের হিসেবে শুধু গত চার মাসেই ১৫৬১জনকে সাজা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন মামলায়, যারা দলের সাবেক এমপি বা এমপি প্রার্থী ছিলেন কিংবা চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
“এখন দেখছি সিনিয়র নেতাদের সাজা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এসব সাজার ক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়া কিছুই মানা হয়নি। তড়িঘড়ি করে আইনি প্রক্রিয়া না মেনেই সব করা হচ্ছে। যে কারণে গুম হয়েছেন কিংবা মারা গেছেন এমন ব্যক্তিদেরও সাজা দেয়া হচ্ছে”, বলছিলেন মি কামাল।
মি. কামাল পুরো বিষয়টিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ বলে উল্লেখ করে বলেন, “ দেশকে বিরোধী দলমতশুন্য করতেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের এভাবে সাজা দেয়ার কার্যক্রম চলছে। আসলে একদলীয় শাসন যাতে পাকাপোক্ত হয় সেজন্যই সরকার এ প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে নেতৃত্বশুন্য করতে চাইছে।”
যেসব নেতা সাজাপ্রাপ্ত
বিএনপির যেসব নেতাকর্মী সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন বা সাজা ছাড়াই কারাগারে আছেন তাদের পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে স্থায়ী কমিটির সদস্য মীর্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস প্রধান বিচারপতির কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়ে এসব নেতাকর্মীর মুক্তি দাবি করেছেন।
ওই তালিকা অনুযায়ী ৯২জন নেতার নামের একটি তালিকা সংযোজন করা হয়েছে যারা বিভিন্ন মামলায় কারাগারে আছেন এবং এদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে ছিলেন এবং পরে নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ৩৬টি মামলার আসামি মিসেস জিয়া বর্তমানে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
অন্যদিকে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পঞ্চাশটি মামলার তথ্য আছে দলের কাছে। তিনিও একুশে অগাস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা ছাড়াও কয়েকটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত।
মি. রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি মামলায় কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছে আদালতে।
অন্য আরও যেসব নেতার সাজা হয়েছে বিভিন্ন মামলায় তাদের মধ্যে আছেন: স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পিন্টু, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী ও হাবিব উন নবী খান সোহেল, প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সফু, তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, সহ সম্পাদক বেলাল আহমেদ, সহ প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, জাতীয় কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি ও মামুন হাসান, ঢাকা মহানগর নেতা এসএম জাহাঙ্গীর, রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদ, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আকরামুল হাসান, যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান-সহ আরও কয়েকজন।
বিএনপি কিংবা দলটির বিভিন্ন নেতার আইনজীবীদের কাছ থেকে পাওয়া এসব তথ্য অন্য কোনও সূত্র থেকে যাচাই করা যায়নি।
এর বাইরেও আটক যারা
বিএনপি বলছে দলটির যেসব নেতার বিভিন্ন মামলায় সাজা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই কারাগারে আছেন। তবে এসব সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের বাইরেও বহু নেতাকে বিভিন্ন মামলায় আটক করেছে পুলিশ, যাদের অনেকের বিচারও শুরু হয়েছে আদালতে।
এর মধ্যে ঢাকায় গত আটাশে অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় আটক হওয়া দলের মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা একশ’র বেশি।
ওই দিনের সহিংসতার দায়ে হওয়া মামলার আসামি হয়ে পরে আটক হন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মীর্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীও। তবে তাদের কোনও মামলার চূড়ান্ত রায় এখনো হয়নি। মি. আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪৮টি এবং মি. চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাতটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে দলের আইনজীবীদের কাছ থেকে।
দলের একজন ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর বিভিন্ন মামলায় আটক হয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি জামিন পেয়ে বেরিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার সাজা পাওয়া দলের ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী ইতোমধ্যেই আটক হয়ে কারাগারেই আছেন।
এর বাইরেও যারা বিভিন্ন মামলায় আসামী হয়ে কারাগারে আছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন: শামসুজ্জামান দুদু, মুজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, রফিকুল ইসলাম মজনু, আমিনুল হক, জহির উদ্দিন স্বপন, শরিফুল আলম, আব্দুল কাদের ভুইয়া জুয়েল, যুবদল সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না-সহ দলের অনেকগুলো জেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা।
কার বিরুদ্ধে কত মামলা
দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৫০ এবং মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ১০২ টি মামলা থাকার তথ্য দিয়েছে বিএনপি।
দলের প্রবীণ নেতা ও সাবেক স্পীকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধেও চারটি করে মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়া অন্য নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য মীর্জা আব্বাসে বিরুদ্ধে ৪৮টি, আমির খসরু চৌধুরীরর বিরুদ্ধে সাতটি, গয়েশ্বর রায়ের বিরুদ্ধে ৩৬টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে মোট ৯ টি, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রমের বিরুদ্ধে ৬টি, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১১টি, আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ১০৬টি, বরকত উল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে ২০৪টি, রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টি, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ২৫৪টি, হাবিব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ৪৫১টি, মীর নেওয়াজ আলীর বিরুদ্ধে ৮৩টি মামলা আছে।
যদিও এসব তথ্য কোনও স্বাধীন সূত্র থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।