আসন্ন বিশ্বকাপের জন্য সাত ব্যাটার, দুই অলরাউন্ডার, দুই স্পিনার আর চার পেসারকে রেখে ১৫ সদস্যের স্কোয়াড ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। বহু আলোচনা-সমালোচনা ও দর্শক-সমর্থকদের তর্কবিতর্কের পর পর বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ফিরেছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।
অভিজ্ঞ অল রাউন্ডার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের পাশাপাশি দলে রয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাপক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান।
এই তিন সিনিয়রের মতো অভিজ্ঞতা না থাকলেও মেহেদি হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, লিটন দাস, মুস্তাফিজুর রহমানদের সবারই অন্তত ৭-৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
আর দলের বাকি আটজনের মধ্যে প্রায় সবাই বয়সে ও অভিজ্ঞতায় অপেক্ষাকৃত তরুণ। এদের প্রত্যেকেই প্রথমবারের মত ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন।
এশিয়া কাপে হতাশাজনক পরফর্ম করে বিদায়ের পর ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের সাথেও বাংলাদেশ দলের পারফরমেন্স খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছিল না।
তবে টুর্নামেন্ট হিসেবে ওয়ানডে বিশ্বকাপের আমেজ সবসময়ই ক্রিকেটের অন্য আসরগুলো থেকে আলাদা থাকে।
আর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরকম বলার মতো সাফল্য না থাকলেও ১৯৯৯ সালের পর থেকে প্রায় প্রতি বিশ্বকাপেই কোনো না কোনো বড় দলকে হারিয়ে টুর্নামেন্টের সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে তারা।
আরো পড়তে পারেন
সাকিব আল হাসান
ওয়ানডেতে আইসিসি র্যাংকিংয়ের শীর্ষ অলরাউন্ডার ও বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান তার পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন এবার।
বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ২৯টি ম্যাচ খেলেছেন সাকিব। এবারের আসরে সব দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলা ক্রিকেটার সাকিব।
বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরমেন্সও রীতিমত ঈর্ষণীয়। তার খেলা ২৯ ম্যাচে ব্যাট হাতে প্রায় ৪৬ গড়ে করেছেন ১০টি হাফসেঞ্চুরি ও ২টি সেঞ্চুরি। বোলিংয়ে ৩৪টি উইকেট নিয়েছেন ৩৫ গড়ে।
সাকিবের সাম্প্রতিক ব্যাটিং পারফরমেন্সও বেশ ভালোই। গত ছয় মাসে খেলা ১৬টি ওয়ানডেতে কোনো সেঞ্চুরি না পেলেও হাফসেঞ্চুরি করেছেন ৫টি, ত্রিশের ওপর ইনিংসও আছে তিনটি।
তবে বল হাতে সাম্প্রতিক সময়ে সাকিবকে কিছুটা হলেও ম্লান পারফর্ম করতে দেখা গেছে।
ক্যারিয়ারের ২৪০ ম্যাচে ৩০৮ উইকেট নেয়া এই বাঁহাতি স্পিনার শেষ নয় ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন মাত্র সাতটা।
মুশফিকুর রহিম
বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ২৮ ম্যাচ খেলে অভিজ্ঞতার হিসেবে বাংলাদেশের উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম রয়েছেন সাকিব আর তামিমের ঠিক পরেই।
সাকিবের পরে বিশ্বকাপে মুশফিকই বাংলাদেশের সেরা পারফর্মার। ৩৮ গড়ে ৮৭৭ রান করা ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ ৬টি হাফসেঞ্চুরি ও একটি সেঞ্চুরিও করেছেন।
গত এক বছরে মুশফিক ব্যাটিং করেছেন ১২ ইনিংসে, যার মধ্যে তিনি ৪টি হাফ সেঞ্চুরি, একটি সেঞ্চুরি সহ তিন বার দ্রুতগতির ৩০+ রানের ইনিংস খেলেছেন।
পরিসংখ্যান ও পারফরমেন্সের হিসেবে এবারের আসরেও মুশফিকের ওপর বাংলাদেশ সমর্থকরা ভরসা রাখতেই পারেন।
আরো পড়তে পারেন
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের দলে থাকা উচিত কিনা, সেই জল্পনায় বেশ সরগরম ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গন।
মাহমুদুল্লাহর সমর্থকরা তার অভিজ্ঞতা আর পুরনো পারফরমেন্সের ভিত্তিতে তাকে দলে বিবেচনা করার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছিলেন।
আর তাকে দলে না রাখার পক্ষে যুক্তি ছিল তার ধীর গতির ব্যাটিং।
বিশ্বকাপে সাকিব বাদে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদই একমাত্র বাংলাদেশি ক্রিকেটার যার দুইটি সেঞ্চুরি আছে।
তবে তার সাম্প্রতিক পারফরমেন্সের হিসেব করে সমর্থকরা কিছুটা আতঙ্কিত হতেই পারেন।
এ বছরের মার্চ মাস থেকে দলে ছিলেন না। নিউজিল্যান্ড সিরিজে দুই ইনিংস ব্যাট করে এক ম্যাচে করেছেন ৪৯ রান।
আর গত দুই বছরে ১৬ ইনিংসে হাফসেঞ্চুরি পেয়েছেন দুটি। ৩০+ ইনিংস চারটি, যার মধ্যে সবকটিতেই স্ট্রাইক রেট ছিল ৭০ এর নিচে।
তবে বয়সে ও অভিজ্ঞতায় তরুণ আফিফ, শামীম, মোসাদ্দেকের চেয়ে মাহমুদুল্লাহর ওপর ভরসা রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন নির্বাচকরা।
মেহেদি হাসান মিরাজ
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে ধারাবাহিক পারফর্মারদের একজন মেহেদি হাসান মিরাজ।
মূলত অফ স্পিন বল করা এই বোলিং অলরাউন্ডার ব্যাট হাতেও একাধিকবার দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে দলকে খাদের কিনার থেকে টেনে তুলেছেন।
প্রয়োজনে যে কোনো ব্যাটিং পজিশনে খেলার সক্ষমতা রাখেন এই ডানহাতি অলরাউন্ডার। সবশেষ এশিয়া কাপেও তার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি।
ওয়ানডেতে ৪.৭ ইকোনমি রেট আর ৩৩ গড়ের এই বোলারের ভারতের স্পিন উইকেটে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
লিটন দাস
ওপেনিং ব্যাটসমান লিটন টেকনিকের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাটসম্যানদের একজন। কিন্তু লিটনের গত এক বছরের ফর্ম গড়পড়তারও নিচে।
এ বছরে খেলা ১৬ ইনিংসে মাত্র তিনবার ৫০ পার করতে পেরেছেন তিনি। অধিকাংশ ম্যাচেই ইনিংসের শুরুটা দারুণভাবে করলেও বাজেভাবে আউট হয়ে ফিরে গেছেন তিনি।
এশিয়া কাপের আগে বাংলাদেশের কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহেও এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
তবে সে সময় তিনি বলেছিলেন যে লিটন নিজেও তার এই সমস্যার বিষয়ে জানে এবং সে এটি সমাধানের জন্য কাজ করছে।
তাসকিন আহমেদ
বাংলাদেশের ফাস্ট বোলিং ডিপার্টমেন্টের অন্যতম প্রধান শক্তি তাসকিন আহমেদ গত কয়েকমাস ধরেই দারুণ ফর্মে আছেন।
সদ্য শেষ হয়ে যাওয়া এশিয়া কাপে পেয়েছেন চার ম্যাচে নয় উইকেট।
এর আগে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজেও বেশ ভালো পারফর্ম করেছেন এই ডানহাতি পেসার।
মুস্তাফিজুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ দুই ম্যাচে বেশ ভালো বোলিং পারফরমেন্স দেখালেও মুস্তাফিজুর রহমানের সাম্প্রতিক ফর্ম খুব একটা ভালো নয়।
শেষ দুই ম্যাচের আগে গত এক বছরে ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন ১২টি। এই ১২ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন ঠিক ১২টি, আর অনেকগুলো ম্যাচেই বেশ খরুচে ছিলেন রান দেয়ার হিসেবে।
এছাড়া বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বাইরে মুস্তাফিজের পারফরমেন্সেও বেশ পার্থক্য রয়েছে।
দেশের বাইরে খেলা ৫২ ম্যাচে তার বোলিং গড় ২৭ আর ইকোনমি রেট ৫.৭১। যেখানে দেশের ভেতরে তার গড় ২০ আর ইকোনমি রেট ৪.২৬।
নাজমুল হোসেন শান্ত
নাজমুল হোসেন শান্ত বছরখানেক ধরে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের অন্যতম সেরা পারফর্মার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সাম্প্রতিক পারফরমেন্সের হিসেবে তিনিই বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে ধারাবাহিক পারফর্মার।
গত এক বছরে ব্যাট করা ১৬ ম্যাচে ৪টি হাফ সেঞ্চুরি ও ২টি সেঞ্চুরি করেছেন শান্ত।
এশিয়া কাপের সবগুলো ম্যাচ খেলতে পারেননি ইনজুরিতে পড়ায়। তবে ইনজুরি থেকে ফিরে আবারও সাম্প্রতিক ফর্ম ধরে রাখতে পারবেন বলেই বিশ্বাস নির্বাচকদের।
তওহীদ হৃদয়
তওহীদ হৃদয়ের সাম্প্রতিক পারফর্মেন্সও বেশ আশাজাগানিয়া। এ বছরেই ওয়ানডে অভিষেক হওয়া এই ক্রিকেটার ১৬ ম্যাচ খেলে এরই মধ্যে ৫টি হাফসেঞ্চুরি করেছেন।
ব্যাটিং অর্ডারে নিচের দিকে নামা তওহীদ হৃদয়ের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তার স্ট্রাইক রেট।
বাংলাদেশের বর্তমান দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে একমাত্র ৮৫ স্ট্রাইক রেটের ব্যাটসম্যান তিনিই।
নাসুম আহমেদ
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের যে কয়েকজন বোলার নজর কেড়েছেন, নাসুম আহমেদ তাদের মধ্যে অন্যতম।
মাত্র ১১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেললেও গত তিন বছরে টি টোয়েন্টিতে বেশ ভালো পারফর্মেন্স দেখিয়েছেন নাসুম।
ওয়ানডেতেও এবারের এশিয়া কাপ ও নিউজিল্যান্ড সিরিজে বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও বেশ ভালো পারফর্ম করেছেন তিনি।
শেখ মাহেদি
নাসুমের মত শেখ মাহেদি হাসানের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতাও মূলত টি-টোয়েন্টি কেন্দ্রিক।
টি-টোয়েন্টিতে তার সবচেয়ে নজরকাড়া পারফরমেন্স ছিল ২০২১’এ বাংলাদেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিপক্ষে।
পাশাপাশি, ব্যাট হাতেও বেশ ভালো পারফর্ম করার সক্ষমতা রয়েছে এই ডানহাতি অফ স্পিনারের।
হাসান মাহমুদ
ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার হাসান মাহমুদ তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই পারফরমেন্সের হিসেবে ছিলেন ধারাবাহিক।
সাম্প্রতিক পারফরমেন্সের হিসেব করলেও তিনি ভালো ফর্মে আছেন – এমনটা বলাই যায়।
এ বছরে খেলা ১০ ম্যাচে ১৭টি উইকেট নেয়া হাসান মাহমুদের গড় প্রায় ২৯ আর ইকোনমি রেট ৫.৬৬।
শরিফুল ইসলাম
পেস বোলিংয়ে গত বছরখানেক ধরে হাসান মাহমুদের মত ধারাবাহিক পারফরমেন্স দেখিয়েছেন বাঁহাতি শরিফুল ইসলামও।
এ বছরের মে থেকে গত চার মাসে আট ম্যাচ খেলেছেন শরিফুল। এই আট ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ১৬টি। এই সময়ের মধ্যে তার গড় ১৮ আর ইকোনমি রেট ৪.৯।
শরিফুল ইসলামের ২১ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারেও গড় ও ইকোনমি রেট বেশ ভালোই বলতে হয়।
এই ২১ ম্যাচে ৩৩ উইকেট পাওয়া এই বোলারের গড় প্রায় ২৫ আর ইকোনমি রেট প্রায় ৫.৪।
তানজিদ তামিম
এশিয়া কাপের স্কোয়াডে থাকা তানজিদ হাসান তামিম আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেকে দেখানোর খুব একটা বেশি সুযোগ পাননি।
লিস্ট এ ওয়ানডে ক্রিকেটে ৪৭ ইনিংসে ২৭ গড়ে তার রান ১২৪৯, হাফ সেঞ্চুরি ৬টি ও সেঞ্চুরি আছে তিনটি।
তানজিম হাসান সাকিব
ডানহাতি ফাস্ট বোলার তানজিদ হাসান সাকিব এখন পর্যন্ত একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন মাত্র তিনটি।
তবে নিজের প্রথম ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে তার পারফরমেন্স নজর কাড়ে সমর্থক ও নির্বাচকদের।
লিস্ট এ ক্রিকেটে গত চার বছরে ম্যাচ খেলেছেন ৩৯টি আর প্রায় ২৯ গড়ে উইকেট পেয়েছেন ৫৯টি।