বৃহস্পতিবার রাতে পুনেতে ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচটার ফলাফল ততক্ষণে সবারই জানা। ভারতের ইনিংসে চল্লিশ ওভার শেষ, ভারতের জিততে দরকার আর মাত্র আটটা রান!
আবার ক্রিজে থাকা ভিরাট কোহলিরও সেঞ্চুরির জন্য দরকার ওই ঠিক আটটাই রান!
মাঠের প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার দর্শক তখন উত্তেজনায় নখ কামড়াচ্ছেন – কোহলির ৪৮তম ওয়ান-ডে সেঞ্চুরিটা হবে কি হবে না, সেটাই তখন তাদের কাছে একমাত্র প্রশ্ন।
নন-স্ট্রাইকার এন্ডে থাকা কে এল রাহুল ততক্ষণে রান নেওয়ার চেষ্টাই ছেড়ে দিয়েছেন – কোহলিকে স্ট্রাইক দিতে সিঙ্গলস পর্যন্ত নিচ্ছেন না।
এই পটভূমিতে ৪১তম ওভারের দ্বিতীয় বলটা হাসান মাহমুদ ওয়াইড করতেই পুনের মাঠে যে সমবেত দীর্ঘশ্বাস উঠল, সে আওয়াজ বোধহয় মুম্বাই থেকেও শোনা গেছে।
৪২তম ওভারে কোহলি তখন সেঞ্চুরির আরও কাছাকাছি – নাসুম আহমেদের একটা বল অনেকটা লেগের দিক ঘেঁষে গেলেও আম্পায়ার যে কোনও কারণেই হোক ওয়াইড ডাকলেন না।
ভারতের হাজার হাজার সমর্থক ততক্ষণে বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছেন, বাংলাদেশ ওয়াইড করে কোহলিকে সেঞ্চুরি থেকে আটকাতে চাইছে। গ্যালারিতে গালাগালিও শোনা যাচ্ছে কান পাতলেই!
শেষ পর্যন্ত সেই নাসুমের বল-ই ডিপ মিড উইকেটের ওপর তুলে বিশাল ছক্কা হাঁকিয়ে কোহলি সেঞ্চুরি আর দলের জয় একই সঙ্গে নিশ্চিত করলেন ঠিকই – কিন্তু ওয়াইড নিয়ে গুঞ্জনটা থামল না!
ম্যাচের পরে বাংলাদেশের স্ট্যান্ড-ইন ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন শান্তর সাংবাদিক বৈঠকেও আবধারিতভাবে ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রশ্নটা ধেয়ে এল!
“ম্যাচের শেষ দিকে ওয়াইড করার জন্য আপনার বোলারদের প্রতি কি কোনও আলাদা নির্দেশ ছিল?”
শান্তকে রীতিমতো অপ্রস্তুত শোনাল, “না না না – ওরকম কোনও ইনস্ট্রাকশন একেবারেই ছিল না!”
“ওয়াইড যেটা হয়েছে, এমনিতেই হয়ে গেছে”, বেশ জোরালোভাবেই অভিযোগটা অস্বীকার করলেন তিনি।
কিন্তু তার মিনিট কয়েক পরেই একই প্রেস কনফারেন্স রুমে ভারতের শুভমান গিল কিন্তু বিতর্কটা জিইয়েই রাখলেন।
একই প্রশ্নের জবাবে গিলের উত্তর ছিল, “কে জানে, বলতে পারব না ওয়াইডটা ইচ্ছাকৃত ছিল কি না!”
ফলে বিশ্বকাপে ঠিক এক যুগ পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোহলি তার দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পেলেন ঠিকই – কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে আর একটা বিতর্কের উপাদান কিন্তু তৈরি হয়ে গেল!
বাংলাদেশ টিম অভিযোগটা পুরোপুরি অস্বীকার করছে ঠিকই – কিন্তু ভারতের ক্রিকেট মহলের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছে ওয়াইড বল করে কোহলির সেঞ্চুরি আটকাতে চেয়ে বাংলাদেশ আসলে মোটেই স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের পরিচয় দেয়নি!
অন্যভাবে বললে, ২০১৫র বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার চরম বিতর্কিত ডিসমিস্যালের মতোই ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট লোকগাথায় আর একটা দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক ঢুকে পড়ল!
ওপেনাররাই কাঠগড়ায়
ম্যাচের প্রসঙ্গে ফিরে আসলে বলতেই হচ্ছে, বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে আরও একবার ডোবাল ব্যাটিং ব্যর্থতা – বিশেষ করে মিডল ওভারগুলোতে।
টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই যে ওপেনিং জুটি বাংলাদেশকে ভোগাচ্ছে, তারা ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচে কিন্তু দারুণ সফল – বস্তুত তানজিদ হোসন আর লিটন দাসের ৯৩ রানের পার্টনারশিপটাই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা।
ম্যাচের একটা পর্যায়ে যখন মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ অনায়াসে তিনশো পেরিয়ে যেতে পারবে, সেখানে আড়াইশোর মতো রানে আটকে যাওয়াটা – তাও আবার পুনের মতো ভাল ব্যাটিং সারফেসে – যথেষ্ঠ ছিল না কোনও মতেই।
ম্যাচের পর নাজমুল হোসেন শান্ত (যিনি নিজেও ব্যর্থ) খোলাখুলি স্বীকার করে নিলেন, মিডল ওভারগুলোতে বাংলাদেশের ব্যাটাররা দায়িত্ব নিয়ে খেলতে পারেননি। ‘অনেকগুলো সফট ডিসমিস্যাল’ও হয়েছে।
তবে সেই সঙ্গেই তিনি জানালেন, “যে ব্যাটসম্যানরা সেট হয়ে গিয়েছিল, সেই টপ অর্ডারের আসলে ইনিংসটা আরও লম্বা করা উচিত ছিল।“
“আসলে ৫০, ৬০ বা ৭০ রানের একটা ইনিংস খেলে কেউই সন্তুষ্ট হতে পারে না, যদি-না সেটা দলের কাজে আসে। বড় টিমগুলোতে এক দু’জন প্লেয়ার নিয়মিতই এই ৫০-৬০ থেকে ১২০ বা দেড়শো রান করে যাচ্ছেন – যেটা আমরা পারিনি”, জানালেন দলের ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন।
একটু পর আবারও আফসোস ঝরে পড়ল তার গলায়, “আমাদের ওপেনাররা কেউ একজন যদি আর একটু বড় ইনিংস খেলতে পারত, তাহলে হয়তো ম্যাচের ধারাটাই বদলে যেত!”
সুতরাং ঝকঝকে হাফ সেঞ্চুরি করেও তানজিদ হোসেন (‘জুনিয়র তামিম’) আর লিটন দাস যেভাবে আউট হয়েছেন – তার জন্য তাদের দলের ব্যর্থতার দায়ভার কিছুটা নিতেই হচ্ছে।
এবং এই মুহুর্তে পর পর তিনটে ম্যাচে হেরে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে যাওয়ার আশা কার্যত শেষই বলা চলে।
কাগজে-কলমে যে সম্ভাবনাটা থাকছে, তা হল রাউন্ড রবিন লীগে বাকি পাঁচটা ম্যাচের মধ্যে অন্তত চারটেয় বাংলাদেশকে জিততেই হবে।
এই ম্যাচগুলো যথাক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে – ফলে কাজটা কতটা কঠিন তা বোঝাই যাচ্ছে!
‘ফারাক কম করে সত্তর-আশির’
ভারতের সাবেক ওপেনিং ব্যাটসম্যান ওয়াসিম জাফর গতকাল মুম্বাই থেকে নিজে ঘন্টাতিনেক ড্রাইভ করে পুনে-তে এসেছিলেন খেলা দেখতে।
ইনিংস ব্রেকে বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি স্পষ্ট বললেন, বড় টিমগুলোর তুলনায় এই বাংলাদেশ দলটার সামর্থে কম করে সত্তর-আশি রানের একটা ‘শর্টফল’ আছে।
“হ্যাঁ, দলটায় অনেক প্রতিভা আছে ঠিকই, আর তারা বেশ কয়েকবার বড় বড় দলকে চমকেও দিয়েছে। কিন্তু টিমটায় ধারাবাহিকতার অভাবটা অত্যন্ত বেশি!”
“আসলে ওয়ান-ডেতে এখন তিনশো সাড়ে তিনশো রানটাই কম্পিটিটিভ টোটাল বলে গণ্য করা হয়, এদেশের উইকেটে তো বটেই। এখানে বাংলাদেশের তো ৩২৫-৩৩০ অন্তত করাই উচিত ছিল, সে সুযোগটা তারা হেলায় হারিয়েছে।“
“আর বড় দলের বিরুদ্ধে সোয়া দুশো বা আড়াইশো করে জেতার আশা না-করাই ভাল!”, সাফ কথা ওয়াসিম জাফরের।
গত মাসেও এশিয়া কাপে যে বাংলাদেশ দল শ্রীলঙ্কার মাটিতে ভারতকে হারিয়েছিল, এক মাস যেতে না-যেতেই পুনের মাঠে কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জের ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ।
তার ওপর দলের মূল স্তম্ভ সাকিব আল হাসান খেলতে না-পারায় বাংলাদেশের মনোবলও যেন তুবড়ে গিযেছিল প্রথম থেকেই।
নাজমুল হোসেন শান্ত অবশ্য জানালেন, “সাকিবভাই খুব ভাল রিকভার করছেন। পরের ম্যাচে খেলতে পারবেন আশা করছি।“
তবে সাকিব খেলতে পারুন বা না-পারুন, দলগতভাবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই ম্যাচে গুণগত পার্থক্যটা যে বিরাট – তা বৃহস্পতিবার কিন্তু দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে।
যে বীরেন্দর সেহওয়াগ বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ দলকে ‘অর্ডিনারি’ বলে বিতর্ক ডেকে এনেছিলেন, তিনি গতকালের ম্যাচের পর কোহলির ‘অসাধারণ সেঞ্চুরি’ আর জাডেজা ও বুমরাহ-র ‘টাইট বোলিং’য়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশ টিম নিয়ে কোনও মন্তব্য না-করলেও সেহওয়াগ লিখেছেন, “ভারতীয় দল এই মুহুর্তে দারুণ ক্যারেক্টার আর বন্ডিং-এর প্রমাণ দিচ্ছে!”
আর বাংলাদেশে টিমে বোধহয় এই মুহুর্তে সেই ‘ক্যারেক্টারে’রই সবচেয়ে বেশি অভাব!