বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর নতুন করে আরো তিনদিনের জন্য ‘হিট অ্যালার্ম’ জারি করেছে। সংস্থাটি বলেছে আজ থেকে শুরু হওয়া এই তিনদিনেও জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে মানুষের মধ্যে অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে।
আবহাওয়া বিভাগ এ নিয়ে দেশে পঞ্চম বারের মতো ‘হিট অ্যালার্ম’ জারি করলো এবং সবমিলিয়ে টানা আটাশ দিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি এলাকায় তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ডও হয়েছে।
যদিও গরমের কারণে বেশ কয়েকদিন বন্ধ রাখার পর আজ রবিবার থেকে স্কুলগুলো খুলে দেয়া হয়েছে, তবে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ক্লাস শুরুর আগের অ্যাসেম্বলি বাতিলসহ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ ডঃ আবুল কালাম মল্লিক বিবিসি বাংলাকে বলছেন আবহাওয়ার বিভিন্ন মডেল পর্যালোচনা ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে দেশের ওপর চলমান দাবদাহ বা হিট ওয়েভ আরও বায়াত্তর ঘণ্টা বিলম্বিত হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত পঁয়তাল্লিশটির বেশি জেলার উপর দিয়ে গত প্রায় এক মাস ধরেই নানা মাত্রার এই তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। একইসাথে, দিনের গড় তাপমাত্রাও কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফলে তীব্র গরম অনুভূত হওয়ায় সারা দেশেই গত কিছুদিন ধরে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
তবে পূর্বাভাস অনুযায়ী শনিবার থেকেই সিলেটসহ কিছু এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী মে মাসের শুরুতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে সাধারণত কোনও স্থানের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে সেখানে সতর্কবার্তা জারি করা হয়।
কেমন যেতে পারে এই তিন দিন
আবহাওয়া বিভাগ বলছেন আজ থেকে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু এক জায়গায় ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে। এর সাথে কোন কোন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে শিলা বৃষ্টিও হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্য জায়গার আবহাওয়া শুষ্কই থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আর তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে।
এছাড়া আরও অনেকগুলো জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের যে তাপপ্রবাহ বইছে তা অব্যাহত থাকতে পারে।
একই সাথে আগামীকাল সোমবারও পরশু মঙ্গলবারও বিরাজমান এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। তবে এরপর বৃষ্টিপাত ভালো করে হলে তাপমাত্রা কিছুটা কমতেও পারে।
এদিকে গত চব্বিশ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। এর বাইরে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়ার কুমারখালি ও যশোরে তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রির বেশী ছিলো।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে এপ্রিল হচ্ছে সর্বোচ্চ গরম মাস। এই সময়ে পৃথিবী সূর্য থেকে রশ্মি বা কিরণ পায় সেটি লম্বালম্বিভাবে পায়। অর্থাৎ এপ্রিল মাসে সূর্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। যার কারণে সূর্যের তাপ বেশিই পরে এই অঞ্চলে।
বৃষ্টির প্রবণতা শুরু, তাও সতর্কবার্তা কেন
নতুন করে তিন দিনের হিল অ্যালার্ট জারি হলেও আবহাওয়া বিভাগ আশা করছে, চলতি সপ্তাহের শেষ থেকেই উত্তর পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে।
“আবহাওয়ার বিভিন্ন মডেল পর্যালোচনা ও তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে দোসরা মে বা তার পর থেকে বৃষ্টিপাত হবে বিভিন্ন জায়গা। স্থান ও সময়ের হেরফের হতে পারে সামান্য তবে এটিই হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. মল্লিক।
এর আগে চতুর্থ দফার হিট অ্যালার্ম জারির পর আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদও বিবিসি বাংলাকে একই ধরণের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন।
তিনি তখন বলেছিলেন ২৯শে এপ্রিলের দিক থেকেই সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। “তবে এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে আগামী মাসের শুরুতে মোটামুটি ভালোই বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে,” বলছিলেন তিনি।
শনিবার সিলেট এলাকায় ঝড়ো বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে। সে কারণে সিলেটের তাপমাত্রা কমেও এসেছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় সেখানে ১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত ও সর্বনিন্ম ২২ দশমিক ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে সেখানে। আজ ও কাল আরও কিছু এলাকাতেও বৃষ্টি হতে পারে।
কিন্তু তারপরেও তিনদিনের হিট অ্যালার্মের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে ডঃ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছেন, “দেখা যাচ্ছে টুকটাক বৃষ্টি হলেও তাপপ্রবাহ চলতি মাস জুড়েই থাকছে। সে কারণেই হিট অ্যালার্ম দেয়া হয়েছে। ১/২ তারিখ থেকে বৃষ্টি হলেও তার আগের তিনদিন তাপপ্রবাহ একই থেকে যাচ্ছে”।
উষ্ণতম বছর দেখছে বাংলাদেশ
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত দুই-তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং এক থেকে দু’টি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।
কিন্তু এবছর তীব্র তাপপ্রবাহ অনুভূত হওয়ায় ইতোমধ্যেই তিনটি হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও নতুন হিট এলার্ট জারি করতে হতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা।
তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে গড়ে তাপমাত্রা থাকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এ বছর সেটি বৃদ্ধি পেয়ে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া এ বছরের তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।
এর আগে, ২০২৩ সালকে বাংলাদেশের উষ্ণতম বছর হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন আবহাওয়াবিদরা। ওই বছর একটানা একটানা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত তাপপ্রবাহ চলার রেকর্ড হয়েছিলো।
আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন “বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কম হচ্ছে। ফলে গরম থেকেই যাচ্ছে”।
গরম কাটাতে জুনে মাসে ভারী বৃষ্টিপাত পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন হতে পারে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদদের অনেকে।
তবে আবুল কালাম মল্লিক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন মে মাসের শুরুতেই তারা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা দেখছেন। যদিও সেটি কয়দিন স্থায়ী হয় তা এখনি বলা কঠিন।
এবার এত তাপমাত্রা কেন
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে এখন বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে।
এর কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা জানান, বাংলাদেশের ঐ অঞ্চলের দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোর অবস্থান।
এইসব প্রদেশের তাপমাত্রা অনেক বেশি। এসব জায়গায় বছরের এই সময়ে তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝে ওঠানামা করে।
“যেহেতু ওগুলো উত্তপ্ত অঞ্চল, তাই ওখানকার গরম বাতাস চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তা আমাদের তাপমাত্রাকে গরম করে দেয়,” বিবিসি বাংলাকে সম্প্রতি বলেছেন আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি এই আন্তঃমহাদেশীয় বাতাসের চলাচল ও স্থানীয় পর্যায়েও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দেশব্যাপী এবছর তাপপ্রবাহ তুলনামূলক বেশি থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
“বিগত বছরের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে ২০২৪ সাল উত্তপ্ত বছর হিসেবে যাবে। আমরা এ বছর তাপপ্রবাহের দিন এবং হার বেশি পেতে যাচ্ছি,” বলছিলেন মি. মল্লিক।