বাংলাদেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশুনার আগ্রহ কম নয় এবং এতে পড়াশুনার সুযোগ পেতে প্রতিবছরই হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে থাকেন।
চলতি বছর ৯ই ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা।
সরকারের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৮টি এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৭৪টি।
সরকারি ডেন্টাল কলেজ রয়েছে একটি এবং বেসরকারি ডেন্টাল কলেজের সংখ্যা আটটি।
এছাড়া সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে ১২টি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিটের সংখ্যা ১৪টি।
এই সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারি মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা ৪৫২৫টি এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা ৬৮০৮টি।
সরকারি ডেন্টাল কলেজ এবং ইউনিটে আসন সংখ্যা ৫৬৫টি এবং বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ ও ইউনিটে আসন সংখ্যা ১৪০৫টি।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংসদে এক ভাষণে জানিয়েছিলেন, আইন ও নীতিমালা অনুসারে মানসম্পন্ন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা না করায় ৫টি মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। সেই সাথে একটি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ডা. এনামুর রহমান বলেন, যদি কোনো মেডিকেল কলেজ বন্ধ করার নির্দেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়, তখন সেটি আর রোধ করা যায় না। তবে এমন পরিস্থিতিতে সরকারই ওই শিক্ষার্থীদের অন্যসব মেডিকেল কলেজে ভাগ করে দেয়।
দুই বছর হাসপাতাল পরিচালনা সফলভাবে করতে পারলে তারপর মেডিকেল কলেজ পরিচালনার জন্য আবেদন করা যায়।
তিনি বলেন, “চাইলেই এখন কেউ ছাত্র ভর্তি করতে পারবে না। ছাত্র ভর্তি করাটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে। কে কোন মেডিকেলে ভর্তি হবে সেটার তালিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তৈরি করে রেসপেক্টিভ কলেজে পাঠিয়ে দেয়।”
“পাবলিক মেডিকেল কলেজে যেমন সরকার ঠিক করে কে কোন মেডিকেলে ভর্তি হবে, প্রাইভেট সেক্টরেও তাই। আইনে এটা বলা নাই। নীতিমালায় এটা আছে। গতবছর থেকে ছাত্র ভর্তি হচ্ছে সরকারের ইচ্ছায়। সরকারের নির্দেশনায়।”
কোন কলেজে পড়বেন?
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে হলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইন আবেদনপত্র জমা দিতে হয়।
এই আবেদনপত্রে দেশে থাকা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের তালিকা পছন্দ অনুযায়ী ক্রমানুসারে সাজাতে হয়। সেখান থেকে পরে পছন্দের মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।
মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর মেধাক্রম এবং পরে তার ব্যক্তিগত পছন্দই কাজ করে।
তবে কোন বেসরকারি মেডিকেল কলেজটি বেছে নিলে ভালো হবে তা বুঝতে হলে কিছু বিষয় খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
এর জন্য মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপনের জন্য যে সমস্ত শর্তাবলী রয়েছে তা ঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কিনা এবং অনুমোদন হালনাগাদ কিনা তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. এনামুর রহমান বলেন, অনুমোদিত মেডিকেল কলেজগুলো সম্পর্কে সরকারের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
এছাড়া কোন মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা কত বছর আগে হয়েছে এবং তাদের আগের রেকর্ড কেমন-সেটিয়েও খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের শর্ত কী?
বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ডা. এনামুর রহমান বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা বিষয়ক একটি আইন ২০২৩ সালে পাস করা হয়েছে। এই আইনের আওতায় নতুন মেডিকেল কলেজগুলোকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে এবং পুরনোগুলোকেও এই আইনের শর্তগুলো পূরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির আগে সেটি কতটা আইন ও নীতিমালা মেনে চলছে সেটি খেয়াল রাখা যেতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য নীতিমালাগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন অনুযায়ী, অনুমোদন প্রাপ্ত প্রতিটি মেডিকেল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজকে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার নিয়ম রয়েছে।
কোনো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজ স্থাপনের জন্য বিভিন্ন ধরনের শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে এই আইনে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু শর্ত হচ্ছে, অনুমোদন পেতে হলে মেডিকেল বা ডেন্টাল কলেজে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থীর আসন থাকতে হবে।
মেডিকেল কলেজটি যদি মেট্রোপলিটন এলাকায় হয় তাহলে সেটির নামে অন্তত দুই একর জমি থাকতে হবে। আর ডেন্টাল কলেজ হলে সেটির নামে এক একর জমি থাকার নিয়ম আছে। তবে কলেজগুলো যদি এরইমধ্যে একাডেমিক স্বীকৃতি পেয়ে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে এক একর জমি থাকলেও হবে।
মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে মেডিকেল কলেজের জন্য চার একর এবং ডেন্টাল কলেজের জন্য দুই একর জমি থাকা বাধ্যতামূলক। এসব জমি অবশ্যই নিষ্কণ্টক হতে হবে।
এসব মেডিকেল বা ডেন্টাল কলেজ এবং তাদের সাথে থাকা হাসপাতাল কোনোভাবেই ইজারা পাওয়া বা ভাড়া জমিতে স্থাপন করা যাবে না।
যে মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০টি আসন থাকবে তাদেরকে তিন কোটি টাকা যেকোনো তফসিলি ব্যাংকে সংরক্ষিত তহবিল হিসেবে জমা করে রাখতে হবে। ডেন্টাল কলেজের ক্ষেত্রে এই টাকার পরিমাণ দুই কোটি।
৫০টির বেশি আসন হলে প্রতি আসনের জন্য মেডিকেল কলেজকে ৩ লাখ টাকা এবং ডেন্টাল কলেজকে দুই লাখ টাকা সংরক্ষিত করে রাখতে হবে।
৫০ জন শিক্ষার্থীর আসন যে কলেজের রয়েছে তাদের একাডেমিক কাজের জন্য এক লক্ষ বর্গফুট এবং হাসপাতালের জন্য এক লক্ষ বর্গফুটের ফ্লোর স্পেস রয়েছে এমন ভবন থাকতে হবে। ডেন্টাল কলেজের ক্ষেত্রে এই আয়তন ৫০ হাজার বর্গফুট।
মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য আলাদা ভবন থাকতে হবে।
বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের প্রতি বিভাগে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হবে ১:১০ অর্থাৎ প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকতে হবে।
কলেজের পাঁচ শতাংশ আসন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকতে হবে।
এছাড়া শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি, মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, অফিস কক্ষ, শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কমনরুম, ফ্লোর স্পেস, শিক্ষক ও টেকনিক্যাল স্টাফ, শিক্ষা উপকরণ ও যন্ত্রপাতি, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত পাঠাগার, ল্যাব, খেলাধুলা, বিনোদন ও শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আবাসন ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য কক্ষের জন্য পর্যাপ্ত স্থান ও অবকাঠামো থাকতে হবে।
একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজের হাসপাতালে দরিদ্রদের জন্য বিনা ভাড়ায় ১০ শতাংশ শয্যা স্থায়ীভাবে বরাদ্দ থাকতে হবে। এছাড়া এদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ সার্বক্ষণিক জরুরি চিকিৎসা সেবার সুযোগ থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের বেসরকারি মেডিকেল স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১ অনুযায়ী, বেসরকারি মেডিকেল কলেজও সরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি নীতিমালা অনুসরণ করে সংশ্লিষ্ট কলেজে ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা তালিকা থেকেই ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করাবে।
প্রথমবার শিক্ষার্থী ভর্তিসহ শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করার আগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে।
পরে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ আসন সংখ্যা বাড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে।
অনুমতি ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তি বা আসন সংখ্যা বাড়ানো হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ অনুমোদন বাতিল করা হতে পারে।
তবে শর্ত মেনে অনুমোদন পাওয়াটাই শেষ নয় বরং, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে অনুমোদন নবায়ন করতে হয়।
খরচ কত?
মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের সব শিক্ষার্থীর ভর্তি ও মাসিক পড়াশুনার খরচ সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন অনুযায়ী নির্ধারণ করে থাকে।
তবে এর নির্ধারিত প্রক্রিয়া রয়েছে। এর আওতায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পরিচালনা পর্ষদ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের মাসিক পড়াশুনার খরচ ও অন্যান্য ফি নির্ধারণ করে সেটি মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলকে জানায়। তারা এটা মূল্যায়ন করে সেটি অনুমোদন করে। এই অনুমোদিত ও নির্ধারিত ফি এর বাইরে অতিরিক্ত ফি আদায় না করার নিয়ম রয়েছে।
বাংলাদেশের কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায় ৫ বছর মেয়াদী এমবিবিএস ডিগ্রির জন্য দেশের একজন শিক্ষার্থীকে এককালীন ২১ লাখ টাকার বেশি প্রদান করতে হয়। সব মিলিয়ে টিউশন ফিসহ ডিগ্রি অর্জন পর্যন্ত এই খরচ ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এই খরচ গড়ে ৪০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে বলে জানা গেছে।