রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে আলওয়ার জেলার একটা গ্রাম সমুচী। গ্রামের সব থেকে বড় পাকা দোতলা বাড়ির সামনে শিশুরা খেলাধুলো করছিল। বাইরে একটা গাছের নিচে রাজস্থানি পোশাক পরে ঘোমটা মাথায় জড়ো হয়েছিলেন।
আর ঘরের ভেতরে গ্রামের আর ওই পরিবারটির কয়েকজন পুরুষ কোনও একটা বিষয়ে আলোচনা করছিলেন।
এই দোতলা বাড়িটি ভরতপুর লোকসভা আসন থেকে সদ্য নির্বাচিত সংসদ সদস্য সঞ্জনা জাটভের। দেশের সবথেকে কম বয়সী সংসদ সদস্য হওয়ায় ফল ঘোষণার পর থেকেই খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন।
সোনালি জরি পাড়ের শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা, হাতে ঘড়ি আর পায়ে চটি পরা একেবারেই সাধারণ গৃহবধূর মতো দেখতে এই নারীই সঞ্জনা জাটভ।
চোখে মুখে খুশির ছাপ স্পষ্ট।
সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখতেন এক সময়ে
সঞ্জনা জাটভ ১৯৯৮ সালের পয়লা মে ভরতপুর জেলার ভুসাওয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া সঞ্জনার বিয়ে হয় ২০১৬ সালে, ভরতপুর সীমান্ত সংলগ্ন আলওয়ার জেলার সমুচী গ্রামে।
বিয়ের আগে থেকেই তাঁর স্বামী কাপ্তান সিং রাজস্থান পুলিশে কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন।
স্বামীর উৎসাহে বিয়ের পরে স্নাতক হন মিজ জাটভ। তার ইচ্ছা ছিল সরকারি চাকরিতে ঢুকবেন।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিজ জাটভ বলছিলেন, “শ্বশুরবাড়িতে কখনও আমাকে পুত্রবধূ বলে মনে করা হয় নি, পরিবারের মেয়ে হিসাবেই দেখা হয়েছে। আমাকে পড়াশোনা করতে দিয়েছেন এরা। স্বামী সরকারি চাকরিতে ছিলেন বলে, আমিও সরকারি চাকরি করব, এমনটাই ভাবতাম। তবে ভাগ্য যা ঠিক করে রেখেছে, বাস্তবে তো সেটাই হওয়ার, তাই না?”
তাঁর স্বামী, পুলিশ কনস্টেবল কাপ্তান সিংয়ের কথায়, “বিয়ের পরেও আমি ওকে স্নাতক-স্তরের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলি। নারীদের সম্পর্কে আমাদের পরিবারে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা রয়েছে। সঞ্জনা রাজনীতিতে সময় দিতে চাননি, কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম যে ও সঞ্জনা রাজনীতিতে যাক, পরিবার আর গ্রামের নাম উজ্জ্বল করুক।“
সঞ্জনা জাটভ যে শুধু স্নাতক ডিগ্রি পেয়েছেন, তা নয়। এরপরে তিনি আইন পড়েছেন, এলএলবি ডিগ্রিও পেয়েছেন।
তার কথায়, এসবই সম্ভব হয়েছে আমার স্বামী সবসময়ে পাশে থেকেছেন বলে।
দুই সন্তানের মা
সঞ্জনা জাটভের শ্বশুরবাড়িটা যৌথ পরিবার। সেখানে তাকে স্ত্রী, পুত্রবধূ আবার দুই সন্তানের মায়ের দায়িত্বও পালন করতে হয়।
গ্রামে তাদের দোতলা বাড়িটির কাছেই আরেকটি বাড়ি রয়েছে।
সেই বাড়িতেই রান্নাঘরে বাসন মাজতে মাজতেই কথা তিনি কথা বলছিলেন।
“বিয়ের দুবছর পর আমার ছেলে হয়। এখন ওর বয়স ছয় বছর আর মেয়ে চার বছরের,” জানালেন মিজ জাটভ।
তার কথায়, “আমি যখন রাজনীতির কাজে যাই, তখন শাশুড়িই সন্তানদের দেখাশোনা করেন। তবে আমি কিন্তু ঘরের কাজও করি আবার রাজনীতিও করি।“
তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, যে এখন তো তাকে দিল্লি যেতে হবে, আবার ভরতপুরেও যেতে হবে। সন্তানদের বা পরিবারকে কী করে সময় দেবেন?
সঞ্জনা জাটভের উত্তর ছিল, “দিল্লিতে থাকলে সেখানকার কাজ করব, আবার ভরতপুরে থাকলে সেখানকার কাজ করতে হবে। কিন্তু যখন বাড়িতে থাকব, তখন পুরো সময়টাই সন্তানদের আর পরিবারের।“
ভোটের ফল ঘোষণার পরে মিজ. জাটভের একটি ভিডিও খুব ভাইরাল হয়েছে। ওই ভিডিওতে তাকে নাচ করতে দেখা গেছে। সেই প্রসঙ্গ তুলতেই মিজ. জাটভ হেসে ফেললেন।
“এত আনন্দ হয়েছিল যে আমি নাচতে শুরু করেছিলাম।“
জেলা পরিষদ সদস্য থেকে এমপি
সঞ্জনা জাটভ বলছিলেন, “আমার বাবা ট্রাক্টর চালাতেন। বাপের বাড়ির দিকে কেউ কখনও রাজনীতি করেন নি। তবে, বিয়ের পর যখন তিনি শ্বশুরবাড়িতে আসেন, তখন তাঁর মামা শ্বশুর ছিলেন গ্রামের ‘সর-পঞ্চ’ (গ্রামের প্রধান)। সেই থেকেই আমার প্রথম রাজনীতির প্রথম পাঠ শুরু হয়।“
তিনি আলওয়ার জেলা পরিষদের সদস্য ছিলেন আর সেটাই ছিল রাজনীতিতে তার প্রথম সিঁড়ি।
তিনি রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ‘লড়কি হুঁ লড় সক্তি হুঁ’ (আমি নারী, কিন্তু লড়াই করতে জানি) অভিযানেও যোগ দিয়েছিলেন।
গত বিধানসভা নির্বাচনে আলওয়ারের কাঠুমার আসন থেকে চারবারের বিধায়ক বাবুলাল বৈরওয়ার টিকিট কেটে দিয়ে সঞ্জনা জাটভকে প্রার্থী করেছিল কংগ্রেস দল। কিন্তু নির্বাচনে তিনি মাত্র ৪০৯ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান।
তাঁর কথায়, “বিধানসভায় পরাজয়ের ধাক্কায় আমার বাবা মারা যান।“
বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর লোকসভায় তিনি জিততে পারবেন, এমন আশা কীভাবে করেছিলেন, এই প্রশ্নের জবাবে মিজ জাটভ বলেন, “জনগণ আমাকে অনেক ভালবাসা আর সাহস জুগিয়েছে। বিধানসভা ভোটে হেরে গেছি বলে মনেই হয়নি। দলও মনে করে নি যে আমি একজন পরাজিত প্রার্থী ছিলাম। তাই আমাকে এমপি টিকিট দিয়েছে। দলের বিশ্বাসের কারণেই আমি আজ এই জায়গায় আসতে পেরেছি।“
মুখ্যমন্ত্রীর নিজের জেলায় পরাজিত বিজেপি
সঞ্জনা জাটভের জয়ের পরে সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে তার কম বয়স নিয়ে। তবে রাজস্থানের সবথেকে বেশি আলোচিত বিষয় হল যে তিনি বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ভজন লাল শর্মার জেলায় তার দলের প্রার্থী তথা প্রাক্তন সংসদ সদস্য রামস্বরূপ কোলিকে হারিয়েছেন।
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভজন লাল শর্মার নিজের জেলা ভরতপুরে বিজেপির প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়া কত বড় জয় তার কাছে?
সঞ্জনা জাটভের কথায়, “আমি তো তাকে পরাজিত করি নি, জনগণ হারিয়েছে তাকে। তবে শুধু তার নিজের জেলায় নয়, তার নিজের গ্রাম আটারি গ্রামের তিনি পরাজিত হয়েছেন। সেখান থেকেও আমি বেশি ভোট পেয়েছি।“
অভিজ্ঞতার অভাব বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
তার তরুণ বয়স এবং রাজনীতিতে তেমন একটা অভিজ্ঞতা না থাকায় ভরতপুরের উন্নয়নও বাধার সম্মুখীন হতে পারে, এরকম একটা আশঙ্কা নিয়ে আলোচনা চলছে।
তবে সঞ্জনা জাটভ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন, “আমি ভরতপুরকে উন্নয়নের নতুন দিশা দেখাব।
ভরতপুর আনন্দনগর কলোনির রমেশ চাঁদ সমুচী গ্রামে এসেছিলেন সেখানে তাঁর এক পরিচিতের বাড়িতে। গ্রামের একটি দোকানে বসে তিনি বলছিলেন, “উনি তো আগেই রাজনীতিতে এসে গেছেন। তিনি জেলা পরিষদের সদস্যও ছিলেন আবার বিধানসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছেন। তাই তার রাজনৈতিক জ্ঞান ভালই আছে। আবার জনসমর্থনও রয়েছে তাই আমাদের আশা যে উন্নয়নের কাজ ভালই হবে।“
তবে ভরতপুরের প্রাক্তন বিজেপি এমপি ও এবারের পরাজিত প্রার্থী রামস্বরূপ কোলি সঞ্জনা জাটভের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বলেছেন, “অভিজ্ঞতা তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হবে। তবে যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো তাদের উত্থাপন করতে হবে। বিরোধী দলে থেকে উন্নয়নের কাজ করা যাবে না। আমি ভরতপুরের এমপি ছিলাম। কেন্দ্রে যখন ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তখন কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার ছিল, আমার কোনও কাজই করতে দেওয়া হয় নি তখন।“
শচীন পাইলটের রেকর্ড ভাঙ্গলেন সঞ্জনা
লোকসভা নির্বাচনের তিন দিন আগে ২৬ বছরে পা দিয়েছেন সঞ্জনা জাটভ। এর আগে রাজস্থানের কংগ্রেস নেতা শচীন পাইলট ২৬ বছর বয়সেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সবথেকে কম বয়সী এমপি হওয়ার রেকর্ডটি এতদিন তারই দখলে ছিল।
সঞ্জনা জাটভ বলছিলেন, দুটি রেকর্ডেই নিজের জায়গায় থাকবে।
সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে শচীন পাইলট বলেন, “আমিও ২৬ বছর বয়সে সংসদ সদস্য হয়েছিলাম। এখন সঞ্জনা আমার থেকেও কম বয়সে এমপি হয়েছেন। এইসব রেকর্ড তো গড়েই ওঠে অন্য কেউ তা ভাঙ্গবে, তার জন্যই। আমি খুশি যে দলিত, দরিদ্র পরিবারের এক নারী সংসদ সদস্য হয়েছেন।“