বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে ১লা জুন পর্যন্ত মোট সাতটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী তথা ১৮তম সংসদীয় নির্বাচন। দেশটিতে সবচেয়ে তীব্র গরমের মাস যেগুলো, ঘটনাচক্রে ঠিক তখনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে গণতন্ত্রের এই সবচেয়ে বড় উৎসব।
অথচ এর আগে, মাঝে দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে, গত শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে সাধারণ নির্বাচন কিন্তু শরৎ বা শীতের মনোরম আবহাওয়াতেই হয়ে এসেছে।
কিন্তু দু’দশকের ওপর হলো চরম গ্রীষ্মেই ভারতে লোকসভার ভোট হচ্ছে। যার ফলে ২০০৪ থেকে শুরু করে এই নিয়ে টানা পঞ্চমবার এই অসহ্য গরমে ভারতীয়দের ভোটের লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে।
আর এই যে এত গরমে ভোট হচ্ছে– তার জন্যও বোধহয় দায়ী করা চলে দেশের একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদকে।
না, তিনি বিজেপি বা কংগ্রেস– জাতীয় স্তরের কোনও দলেরই নন, বরং দেশের একটি আঞ্চলিক দলের নেতা!
তার কথায় পরে আসছি– তার আগে জেনে নেওয়া যাক ভারতে এবারের নির্বাচন নিয়ে কিছু সাধারণ তথ্য।
সারা দেশে এই নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৯৬ কোটি, তারাই বেছে নেবেন ৫৪৩টি লোকসভা আসন থেকে কারা পার্লামেন্টে যাবেন।
বিজয়ী দল বা জোটের এমপি-রাই স্থির করবেন নতুন সরকারের নেতৃত্ব কে দেবেন।
ভোটার বা প্রার্থীদের সংখ্যায়, খরচের বহরে এবং আরও নানা মাপকাঠিতে এটিই যে বিশ্বের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড়’ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই।
পাঁচ বছর আগে ২০১৯-এ ভারতে যে সংসদীয় নির্বাচন হয়েছিল, সেটাই ছিল এযাবৎকালের ‘বৃহত্তম’ নির্বাচন– এবারে সেই রেকর্ডও যথারীতি ভাঙতে চলেছে।
এবারে ভারতের লোকসভা নির্বাচনও হতে চলেছে প্রায় দেড় মাস (৪৪ দিন) ধরে– ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম নির্বাচনটি বাদ দিলে এত লম্বা সময় ধরে ভারতে কখনও নির্বাচন হয়নি।
ফলে প্রায় তিয়াত্তর বছরের মধ্যে এটি ভারতের দীর্ঘতম নির্বাচনও হতে যাচ্ছে।
আগামী ১লা জুন (শনিবার) ম্যারাথন ভোটগ্রহণ পর্বের শেষে দু’দিন বিরতি দিয়ে ৪ঠা জুন (মঙ্গলবার) সকালে সারা দেশের ভোট একসঙ্গে গোনা শুরু হবে।
যেহেতু পুরো দেশেই ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্রে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হবে, ভোটের ফলাফল সে দিন বিকেলের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে বলেও ধারণা করা যাচ্ছে।
কিন্তু এত গরমে ভোট কেন!
গ্রীষ্মপ্রধান ও ‘ট্রপিক্যাল’ দেশ ভারতে এপ্রিল-মে-জুনেই তাপমাত্রা থাকে সর্বোচ্চ, দেশের একটা বিস্তীর্ণ অংশে এ সময় দিনের পর দিন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ঘোরাফেরা করে।
রাজস্থানের মরু অঞ্চল, ওড়িশার কালাহান্ডি বা বোলাঙ্গিরের মতো কোনও কোনও জেলায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৬ বা ৪৭ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যায় প্রায়শই। ‘লু’ বা তাপপ্রবাহ এই সময় ভারতের বেশির ভাগ অংশে খুব সাধারণ ঘটনা।
আবার কোথাও কোথাও চল্লিশ ডিগ্রি ছাড়ানো তাপমাত্রার পাশাপাশি বাতাসের ভয়ঙ্কর আর্দ্রতায় পরিস্থিতি হয়ে ওঠে অসহনীয়।
এই অসহ্য গরমে কাহিল হয়ে আর ঘামে ভিজে যে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ভোটের প্রচারে বেরোতে হয়, যে ভোটকর্মীদের নির্বাচনের সব আয়োজন সম্পন্ন করতে হয় বা যে সাংবাদিকদের ভোটের খবর করতে পথে নামতে হয়– তাদের কারও জন্যই যে বছরের এই সময়টা স্বস্তিদায়ক নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না!
আর ভোটের দিন পোলিং বুথে বিশেষ করে বয়স্ক নারী-পুরুষদের এই গরমে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাটাও কম কষ্টকর নয়!
ভারতের বর্ষীয়ান সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই এ কারণেই প্রশ্ন তুলেছেন, “আমার কথাটা হয়তো বিয়েবাড়িতে নানা বাহানা তোলা প্রবীণ চাচাজির মতো শোনাবে, কিন্তু ভারতে কি আর একটু ঠান্ডা সময়ে ভোট হতে পারত না?”
মজার ব্যাপার হলো, ভারতে কিন্তু ১৯৫১-৫২ থেকে শুরু করে ১৯৮৯ পর্যন্ত দেশের প্রথম ন’টি সংসদীয় নির্বাচনই সম্পন্ন হয়েছে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মার্চের মাঝামাঝি– এই সময়কালের মধ্যে, অর্থাৎ শীতকালে বা তার আশেপাশে।
কিন্তু ১৯৯১ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর আচমকা পদত্যাগ করলে যখন নবম লোকসভা ভেঙে দিতে হয়, সেই প্রথমবারের মতো ভারতে সাধারণ নির্বাচন হলো মে-জুন মাসের ভয়ঙ্কর গরমে।
পাঁচ বছর পর ১৯৯৬’র নির্বাচনও হয়েছিল এপ্রিল-মে মাসের দাবদাহে, কিন্তু পরপর দুটো লোকসভা তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে না-পারায় ঘটনাচক্রে আবার পরের দু’দুটো নির্বাচন হয়েছিল শরতে বা শীতকালে।
১৯৯৯ থেকে ভারতে প্রতিটি লোকসভাই তাদের মেয়াদ পূর্ণ করেছে বা করার মতো অবস্থায় ছিল– কাজেই ১৯৯৯ তে যেভাবে অক্টোবর মাসে শরতের মনোরম আবহাওয়ায় দেশে নির্বাচন হয়েছিল, সুযোগ ছিল যে তারপর থেকে সবগুলো নির্বাচনই বছরের ওই সময়টায় হবে।
কিন্তু রাজদীপ সারদেশাই জানাচ্ছেন– দেশের একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদের জন্যই সেটা সম্ভব হয়নি– আর তার নাম চন্দ্রবাবু নাইডু!
তিনি ছিলেন অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের কিংবদন্তি রাজনীতিক ও চিত্রতারকা ‘এনটিআর’র (নন্দমুরি তারক রামারাও) জামাতা ও তেলুগু দেশম দলের নেতা।
চন্দ্রবাবুর ‘আবদার’
আসলে তখন যেটা হয়েছিল, ২০০৪ সালেও ভারতে নির্বাচন অক্টোবর মাসেই হওয়ার কথা ছিল– কিন্তু তখন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও তেলুগু দেশম পার্টির নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে অনুরোধ করেন, লোকসভা নির্বাচনটা বরং কয়েক মাস এগিয়ে আনুন।
তেলুগু দেশম তখন ছিল বিজেপি জোটের খুব গুরুত্বপূর্ণ শরিক– তাদের অনুরোধ ফেলা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও বেশ কঠিন ছিল।
রাজদীপ সারদেশাইয়ের কথায়, “চন্দ্রবাবু নাইডু চেয়েছিলেন তার রাজ্যের বিধানসভা ভোট ও দেশের লোকসভা ভোট একসঙ্গে করাতে– যাতে বাজপেয়ীজির উজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তিনি রাজ্যেও জিতে যেতে পারেন।”
“বাজপেয়ী ও তার প্রবল আস্থাভাজন প্রমোদ মহাজন সেই অনুরোধ রক্ষা করে লোকসভা ভোট পাক্কা ছ’মাস এগিয়ে আনলেন– আর নির্বাচন হলো এপ্রিল-মে মাসে!”
সেই নির্বাচনেই বিজেপি ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ ক্যাম্পেইনে ভর করে তুমুল প্রচার চালিয়েছিল, আর অটলবিহারী বাজপেয়ীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তেলুগু দেশমও।
“তাতে অবশ্য শেষরক্ষা হলো না– শেষে দেখা গেল বাজপেয়ী ও চন্দ্রবাবু দু’জনেই সেই ভোটে হেরে গেলেন!”, জানাচ্ছেন রাজদীপ সারদেশাই।
কিন্তু ততক্ষণে যাদের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে– এবং সেই ২০০৪ সাল থেকে এই নিয়ে টানা পঞ্চমবার অসহ্য গরমেই গোটা ভারতকে ভোটের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে!
এতদিন তবু এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই ভোটগ্রহণ সীমাবদ্ধ ছিল, এবার তা গড়িয়েছে জুন মাসেও।
ফলে ভোটগণনা যে দিন হবে, তারও দিনচারেক বাদে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু ভারতের মূল ভূখণ্ডে ঢুকবে বলে কথা রয়েছে। তখন হয়তো বৃষ্টি নামায় দেশ কিছুটা ঠান্ডা হতে শুরু করবে।
অটলবিহারী বাজপেয়ী ও প্রমোদ মহাজন দু’জনেই আজ প্রয়াত – ফলে এত গরমে ভোট হচ্ছে বলে যারা বিরক্ত, তাদের গালিগালাজ সইবার জন্য হাতের কাছে আছেন শুধু চন্দ্রবাবু নাইডুই!
আর তিনিও সেই বিশ বছর আগের মতো এবারও বিজেপির সঙ্গে জোট গড়েই অন্ধ্রের ভোটে লড়ছেন।
ইতিমধ্যে গোদাবরী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, চন্দ্রবাবু নাইডুও মাঝে বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে আবার সেই জোটে ফিরে এসেছেন।
অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যটাও ভেঙে দিয়ে তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র– দুটি আলাদা রাজ্য গঠন করা হয়েছে দশ বছরের ওপর হলো।
কিন্তু গত বিশ বছর ধরেই চন্দ্রবাবু নাইডুকেও সেই তীব্র গরমে ঘেমেনেয়েই লোকসভা ভোটের প্রচার চালাতে হচ্ছে– তাতে কোনও পরিবর্তন হয়নি।