বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সাড়ে তিন মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। ভোট পূর্ববর্তী ভারতের সব জনমত জরিপই বলছে, বাংলাদেশের মতো ভারতের নির্বাচনেও ক্ষমতায় পরিবর্তনের তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই।
এ কারণেই সম্ভবত এই নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ কিছুটা স্তিমিত। তবুও ঐতিহাসিকভাবে দিল্লিতে কী হচ্ছে তা সব সময়ই বাংলাদেশকে প্রভাবিত করে।
ভারতের নির্বাচনের ঠিক আগে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদী সরকার বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
এই পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার কি না, সে বিষয়টিও ভারতের রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা অনেকেই বলছেন, সিএএ বাস্তবায়নের পর ‘এনআরসি’ বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বাস্তবায়নেরও পরিকল্পনা রয়েছে বিজেপির।
এই এনআরসি কার্যকর হলে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বহু মুসলিম ভারতের নাগরিকত্ব হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা, এবং যথারীতি এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ সীমান্তে।
নতুন এই আইনটির কারণেই অতীতের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভারতের এবারের নির্বাচনে ‘বাংলাদেশ ইস্যু’টি জড়িয়ে রয়েছে খুব নিবিড়ভাবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এমনিতেই এই আইনটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনের আগে এই নাগরিকত্ব আইনের ইমপ্যাক্ট বাংলাদেশে পড়বেই।”
সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা নিয়েও এক ধরনের আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। যে কারণে ভারতের নির্বাচনের আগে সেটা নিয়েও নানামুখী আলোচনা ও বিশ্লেষণ রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাইমুম মৌসুমী বৃষ্টি যেমন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন চুক্তি – সব কিছুই ভারতের শাসনব্যবস্থায় কোন দল আসবে তার উপর নির্ভরশীল। আবার ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বাংলাদেশের উপর সব সময় প্রভাব রাখে। এসব নানা কারণে ভারতের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরনের আগ্রহ থাকেই।”
ভারতের ক্ষমতা কাঠামোতে পরিবর্তন আসুক আর নাই বা আসুক, এমন অন্তত পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করা যেতেই পারে যেগুলোর জন্য বাংলাদেশের মানুষ ভারতের আসন্ন নির্বাচনের দিকে সতর্ক নজর রাখবে।
এই প্রতিবেদনে এমন পাঁচটি কারণ তুলে ধরা হলো।
নাগরিকত্ব আইন
ভারতে গত সপ্তাহে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) কার্যকর করার পর থেকে এ নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক চলছে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ সে দেশের নানা জায়গায়।
ওই আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ওই তিন দেশের যে সমস্ত হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ও পারসিদের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে ভারতে চলে এসেছিলেন তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
এখন এর অর্থ দাঁড়ায়, আইনটি কার্যকর হলে ২০১৪ সালের পর থেকে যারা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে গত প্রায় সাড়ে নয় বছরে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের বাংলাদেশে ফেরত আসতে হবে। তখন এই প্রশ্নটিও উঠবে যে এই সংখ্যা তাহলে কত হতে পারে?
এদিকে গত পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।
এই সরকারের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তার কারণে দেশ ছেড়েছে কেন, এমন অস্বস্তিকর প্রশ্নও তখন সামনে আসতে পারে। সেই সঙ্গেই প্রশ্ন উঠবে, তারা যদি বাংলাদেশে ফেরত আসতে চায় তাহলে বাংলাদেশ কি তাদের গ্রহণ করতে রাজি হবে?
ফলে ভারতের নির্বাচনের ঠিক আগে এই আইন চালু হওয়ায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিষয়টি নিয়ে নানামুখী আলোচনা করছে।
নয়াদিল্লির সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শাহাদাৎ হোসাইন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সিএএ বাস্তবায়নের পর এনআরসি বাস্তবায়নের একটি পরিকল্পনাও রয়েছে। আর এনআরসি হলে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু মুসলিম নাগরিকত্ব হারাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অবধারিতভাবে যার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ সীমান্তে।”
ফলে অতীতের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভারতের এবারের জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ ইস্যু অনেক বেশি জড়িয়ে রয়েছে বলেও মনে করছে বিশ্লেষকরা।
এই নাগরিকত্ব আইন কার্যকরের ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারত জুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর তীব্র বিরোধিতা করে বলেছেন, “সিএএ হচ্ছে বাংলাকে আবার ভাগ করার এবং দেশ থেকে বাঙালিদের বিতাড়িত করার খেলা।”
যদিও ভারতে এই আইন কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশ অনেকটাই নীরব দর্শকের ভূমিকায়।
দু’চারদিন আগেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, “এই আইনটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বিষয়টির ওপর নজর রাখছি।”
এদিকে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের মেরুকরণ করতেই লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এই আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে দেশের সরকার।
দীর্ঘদিন ধরে এই সিএএ কার্যকর করার দাবি ছিল হিন্দুদের একটি শাখা মতুয়া সম্প্রদায়ের। এই মতুয়া সম্প্রদায়ের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তাদের বিপুল সমর্থনও পেয়েছিল।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন আবার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “এই নাগরিকত্ব আইন চালু করার প্রভাব পড়বে ভারতের পশ্চিমে আর পূবে। তবে আসামে তো এটার বিরুদ্ধে অনেক মানুষের অবস্থান। যে কারণে বিজেপির ভোট কিছুটা কমতে পারে আসামে।”
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করছেন, “নির্বাচনের আগে এই আইনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়বেই।”
“স্বাভাবিকভাবে বিজেপি আবার ক্ষমতায় আসলে ভারতে যেমন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের চিন্তা বাড়বে, সেই সাথে বাংলাদেশের সীমান্তেও এর প্রভাব পড়তে পারে”, জানাচ্ছেন মি আহমেদ।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণ
আগামী ১৯শে এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ, যা চলবে দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে।
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। কিন্তু নির্বাচনের পরে দেশটিতে সম্ভাব্য সরকার ও নীতি বদলের প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও।
সে কারণে ভারতের নির্বাচন এগিয়ে এলেই সে দিকে সতর্ক নজর রাখে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুটি দেশের ভোটের সময়ই রাষ্ট্র ক্ষমতায় কোন দল আসছে, সেটা পারস্পরিকভাবে দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল সব সময়।
তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকলে সেটা ভারতের বিজেপি বা কংগ্রেস, উভয় দলের জন্যই স্বস্তির।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন ভারতের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। ঐতিহ্যগতভাবে মূলত কংগ্রেসের সঙ্গেই আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের সুসম্পর্ক। কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসার পরে সেই সরকারেরও জোরালো সমর্থন পেয়েছে আওয়ামী লীগ।”
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসায় তখন অনেকের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের নতুন সরকারের সমর্থন এতটা নিরঙ্কুশ হবে না।
কিন্তু গত দশ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনও পরিবর্তন আসেনি। উল্টো ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখায়। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে তখন ভিসা নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
পশ্চিমা দেশগুলোর সেই চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে ভারত তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে।
পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, ভারতের কারণেই শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি অনেকটা নমনীয় অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।
যে কারণে শেষ পর্যন্ত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থ বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের ধারণা, ভারতের প্রত্যক্ষ মদদেই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ দিনের পর দিন ক্ষমতায় থেকে যেতে পারছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার অলিন্দে কে থাকবে, তা নির্ধারণে সবচেয়ে বড় নির্ণায়ক শক্তি হয়ে গেছে ভারত।
সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারত মৌন ও প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেওয়ায় বাংলাদেশের একটা শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব আরও প্রবল হয়েছে। যে কারণে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়াসহ ‘ইন্ডিয়া আউট’ নামে ভারত বিরোধী একটি প্রচারণাও চলছে বাংলাদেশে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন, “মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরই কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে বিজেপির যে নেতিবাচক মনোভাব ছিল তা তারা অনেকটাই সংযত রেখেছিল।”
“তার কারণ ভারতের যে কোনও ক্ষমতাসীন দলের জন্য বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাটা যে সুবিধাজনক, সেটা তারা খুব ভালোভাবেই বোঝে,” মন্তব্য করেন মি হোসেন।
তিস্তা চুক্তি ও অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন
অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার একটি দীর্ঘমেয়াদী ও জটিল ইস্যু।
দু’দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮টি নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের মেয়াদে নানা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক অনেক শক্তিশালী হলেও অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সংকট কিন্তু রয়েই গেছে। যে সব বিষয়ে দুদেশের মধ্যে একটা দূরত্ব রয়েছে তার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হল তিস্তা চুক্তি সম্পাদন ও গঙ্গা চুক্তির নবায়ন।
গঙ্গা চুক্তির পর আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়টি।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা আর বাস্তবায়ন করা যায়নি।
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের জন্য দুই দেশের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি সই করা হয়। ২০২৬ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এছাড়া অভিন্ন আরও ছয়টি নদীর পানি বণ্টনের প্রস্তাবিত চুক্তি নিয়ে নানা আলোচনা হলেও সেগুলো এখনও সম্পাদিত হয়নি।
এদিকে জানুয়ারিতে বাংলাদেশের নির্বাচনের পর সরকার গঠিত হলে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ পরের মাসেই ভারত সফর করেন।
দেশে ফিরেই তিনি জানান, ভারতের নির্বাচনের পর দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি এবং গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে ঢাকা ও দিল্লি একসঙ্গে মিলে কাজ করবে বলে সম্মত হয়েছে।
এদিকে বিগত এক দশক ধরে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু একটানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শাসন করছে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস।
সেই রাজ্য সরকারের মতামত উপেক্ষা করে ভারতের নতুন কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সাথে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তি করবে, এমনটা কিন্তু মনে করছেন না বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বারবার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, রাজ্য সরকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকার কারণে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এখন রাজ্য অন্য সরকারে অন্য কেউ আসলেই যে তারা চুক্তি করার অনুমতি দেবে, এমনটা ভাববার কোনও কারণ নেই।”
এখন লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে যদি বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের তুলনায় ভালো ফল করে এবং ওই রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের ইঙ্গিত দেখা যায়, তাহলেও কি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তিস্তা চুক্তি হবেই?
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন জবাবে বলছেন, “বাস্তবে এর কোনও প্রতিফলন হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ বিজেপির এমন কোনও দায়বদ্ধতা নেই যে বাংলাদেশকে কোনও সুবিধা দিতে হবে। সুতরাং বাংলাদেশের নিজেদেরই এই সংকটের বিকল্প ভাবতে হবে।”
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে প্রতিবেশী ভারত। চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ স্থল-সীমান্ত রয়েছে দুই দেশের মধ্যে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রে’র হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই এই সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে মারা গেছেন ৩০জন বাংলাদেশি নাগরিক।
তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে সীমান্তে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। এর মধ্যে ১৬ জনই মারা গিয়েছিলেন বিএসএফের গুলিতে।
আর ২০২১ সালে এই সংখ্যাটা ছিলো ১৭। এছাড়াও সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের অপহরণের খবরও মেলে প্রায়ই।
আসলে বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সরকারের মধ্যে সম্পর্কের প্রভূত উন্নতি হলেও সীমান্তে তার কোনও প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
এমন অবস্থায় সীমান্ত-হত্যা বন্ধে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলোচনা হলেও তাতে সীমান্ত পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।
সীমান্তে প্রাণহানি বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। সেখানে সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনাগুলোতে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করতে সহমতও হয় দুই দেশ।
কিন্তু এরপরও সীমান্তে এই সব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায়নি কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সময়। বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে সীমান্ত হত্যা কমানোর জন্য দুই দেশের আন্তরিক প্রচেষ্টা বা সদিচ্ছা না থাকার কারণেই এটি কমছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভারত ও চীন তাদের সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধে চুক্তি করেছে যে ওই দুই দেশের সীমানার দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনও অস্ত্র আনা যাবে না, কোনও ফায়ারিং হবে না।”
মি. আহমেদ প্রশ্ন তুলছেন, ভারত ও চীন যদি এটা করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ-ভারত কেন করতে পারছে না?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তার ভারত সফর শেষে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাতে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি জানান, “সীমান্তে হত্যা কমাতে নন-লিথাল ওয়েপন (প্রাণঘাতী নয় এমন) ব্যবহারের বিষয়ে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত।”
তবে, এর আগেও সীমান্তে প্রাণহানি শূন্যে নামিয়ে আনতে চুক্তি হয়েছে, কিন্তু তা কাগজে-কলমেই আটকে ছিল বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফরিদ আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নানা কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কটি অসম।“
“এ কারণে দ্বিপাক্ষিক এসব ইস্যুতে বাংলাদেশ কখনও জোরালোভাবে ভারতের কাছে কিছু দাবি করতে পারে না। এটাই মূল কারণ যে সীমান্তের এই সব হত্যাকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না,” বলছেন মি আহমেদ।
ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহার
বাংলাদেশে এখন একটানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে বেশ একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে।
এই সময়কালে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়-সহ স্থল সীমান্ত চুক্তি, সড়ক পথে ট্রানজিট, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়াসহ নানা চুক্তি হয়েছে দুই দেশের মধ্যে।
ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রদানের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে নানা তর্ক বিতর্ক ছিল বহুদিন থেকে।
২০১০ সালে তখনকার সরকার সে সময় বিশেষজ্ঞ ও আমলাদের সমন্বয়ে এই বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করে।
অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে ওই কমিটির প্রতিবেদনে ভারতকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
সে সময় ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ফি বা মাশুল নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়। বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে কেউ কেউ কোনও মাশুল না নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন।
সম্প্রতি ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতকে সেই সুযোগ দেওয়া হলেও স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল কিংবা ভুটানে পণ্য রফতানি করার জন্য এখনও অনুমতি পায়নি বাংলাদেশ।
ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার বিনিময় বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী, তা নিয়ে যথারীতি নানা আলোচনা রয়েছে বাংলাদেশে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার ১৫ বছরে বাংলাদেশ-ভারত এই দুই দেশের মধ্যে ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারসহ যে সব চুক্তি হয়েছে তা অতীতে কখনও হয়নি।
তবে ভারতকে ‘একতরফাভাবে’ অনেক কিছু দেওয়া হলেও তার বিনিময়ে বাংলাদেশ ‘তেমন কিছু পায়নি’ – এই অভিযোগও আছে।
স্বাভাবিকভাবে ভারতে নির্বাচনের আগে প্রশ্ন উঠেছে ভারতে যদি নতুন কোনও সরকার ক্ষমতায় আসে তাহলে বাংলাদেশের স্বার্থ কতখানি পূরণ হবে?
এমন প্রশ্নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ফরিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভারতে গত দশ বছর ধরে একই সরকার আছে। তারা এই সময় বাংলাদেশের কাছ থেকে যে সব সুবিধা নিয়েছে তার বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তির খাতা প্রায় শূন্য।”
“নির্বাচনের পর নতুন সরকার বিজেপির না হয়ে অন্য কেউ হলেও এই অসম সম্পর্কের পরিবর্তনের তেমন কোন সম্ভাবনা নেই,” মনে করছেন তিনি।
কথিত ‘অসম সম্পর্কে’র এই আলাপ থেকেই সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও এক ধরনের বৈরি তিক্ত সম্পর্ক দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এমন অবস্থায় ভারতের আগামী নির্বাচন কি এই পরিস্থিতির সমাধানের কোনও পথ দেখাবে?
দিল্লির সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের গবেষক শাহাদাৎ হোসাইন মনে করেন, দিল্লি যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে একচেটিয়া সমর্থন করে সেটা প্রমাণিত।
তার কথায়, “তবে ভারতে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক, তাতে দিল্লির ‘বাংলাদেশ নীতি’তে পরিবর্তনের কিন্তু কোনও সম্ভাবনা নেই।”
আগামী ১৯শে এপ্রিল শুরু হয়ে সাত দফায় ভোটগ্রহণ শেষে ভারতের ভোট গণনা হবে জুনের ৪ তারিখ। কিন্তু সে দিন দিল্লির মসনদে নতুন কোনও দল বা জোট আসবে, এমন সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
ফলে জুনের পরও সম্ভবত দুটো দেশেই থাকবে ক্ষমতায় থাকা পুরনো দুটো দলই। কিন্তু তারা এখন নতুন কী করে, সে দিকেই থাকবে নজর।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলছেন, “দিল্লি সব সময় চায় বাংলাদেশে তাদের সাথে যে দল সম্পর্ক ভালো রাখবে ও তাদের প্রয়োজন মেটাবে, তারাই ক্ষমতায় থাকুক।”
কিন্তু দিল্লির মসনদে বাংলাদেশের পছন্দের কেউ বসুক, বাংলাদেশের এই চাওয়া ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না বলেই বিশ্লেষকদের অনেকের অভিমত।