ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রবিবার ২১শে এপ্রিল রাজস্থানে তার একটি নির্বাচনী জনসভায় ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে আনার পর, গত দুইদিনে দুইটি পৃথক সভায় আবার ধর্মের প্রসঙ্গ তুলেছেন।
সোমবার রাজস্থানেরই আরেকটি এবং উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ের একটি জনসভায় একই ভাবে হিন্দু-মুসলমান, ও হিন্দু-আদিবাসী প্রসঙ্গ তুলে মি. মোদী ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন, বলে অভিযোগ করে বিরোধী দল, মানবাধিকার সংগঠন আর নির্বাচন-নজরদারি সংগঠনসমূহ।
প্রতিটি ভাষণেই মি. মোদীর নিশানায় থেকেছে কংগ্রেস দল।
এদিকে, কংগ্রেস নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী প্রচারণায় আদর্শ আচরণবিধি ভঙ্গের ১৬টি অভিযোগ দায়ের করেছে নির্বাচন কমিশনের কাছে।
তবে এ নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে কমিশন বিবিসিকে বলেছে, অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে, মি. মোদীর এসব মন্তব্য নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও কয়েকদিন ধরে প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে।
সেই সাথে মি. মোদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে অন্তত ২০ হাজার ব্যক্তি ও সংগঠন নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
মনমোহন সিংয়ের পুরণো ভাষণের ‘বিকৃতি’?
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ১৮ বছরের পুরণো এক ভাষণের উল্লেখ করে গত রবিবার প্রথমবারের মতো দুইটি ইঙ্গিতের মাধ্যমে ধর্মকে টেনে আনেন নরেন্দ্র মোদী।
সেখানে ‘মুসলমান’ শব্দ ব্যবহার না করেই তিনি বলেছিলেন, ‘যাদের বেশি সন্তান থাকে’ এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’ – এই দুই শ্রেণীর মানুষকে কংগ্রেস অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছিল বলে মি. মোদী দাবি করেন।
তবে কংগ্রেস দাবি করছে, “মনমোহন সিং ২০০৬ সালের ভাষণে আসলে বলেছিলেন, ‘তফসিলি জাতি ও উপজাতি’দের পুনরুজ্জীবিত করা দরকার। সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা যায়, যাতে উন্নয়নের সুফল পেতে পারে তারা। এজন্য আমাদের নতুন প্রকল্প আনতে হবে। এদের সকলেরই সম্পদের ওপরে প্রথম দাবি থাকা উচিত।”
সেই বক্তব্যের সূত্র ধরে মি. মোদী তার ভাষণে বলেছিলেন যে, বিরোধীরা ভোটে জিতে দেশের ক্ষমতায় এলে সাধারণ মানুষের সম্পদ ‘অনুপ্রবেশকারী’দের মধ্যে বিলিয়ে দেবে।
রাজস্থানে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী আরও বলেন, “‘যাদের বেশি বেশি ছেলেমেয়ে আছে’ বিরোধী কংগ্রেস তাদের মধ্যেই দেশের ধনসম্পদ ভাগবাঁটোয়ারা করে দিতে চায়।”
দেশের প্রায় ২০ কোটি মুসলমানদের তিনি কীভাবে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলতে পারেন, সে প্রশ্ন তুলে এখন তা নিয়েও মি. মোদীর সমালোচনা হচ্ছে।
কেন ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রসঙ্গ আনলেন মোদী?
শুরুতে কয়েকদিন নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী হিন্দু অথবা মুসলমান শব্দগুলি ব্যবহার করেন নি।
তবে,এখন তিনি এমন ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দচয়ন করেছেন, যা শুনলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে তিনি কোন কোন ধর্মের প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
ভারতের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিসের অধ্যাপক হিলাল আহমেদের মতে মি. মোদীর সর্বশেষ ভাষণগুলো তার আগের ভাষণগুলোর মতো নয়।
বিবিসির ভিনিত খারেকে তিনি বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী মি. মোদী আগে হিন্দু, হিন্দুত্ব, মুসলিম এই ধরণের শব্দগুলো ব্যবহারের সময়ে খুব সতর্ক থাকতেন। তার ১০ বছরের শাসনামলে মাত্র তিন কি চারবার তিনি হিন্দু বা মুসলিম শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন।
তবে তার অর্থ এটা কখনই নয় যে তিনি কী বলতে চাইছেন, তার কোনও ইঙ্গিত তিনি ভোটারদের দেন নি।”
অধ্যাপক আহমেদ মনে করেন, বিজেপির তিন ধরনের ভোটার রয়েছে- প্রথমত নিশ্চিতভাবেই বিজেপির ভোটার, দ্বিতীয়ত যারা আগে অন্য দলকে ভোট দিতেন এবং এখন বিজেপিকে ভোট দেন এবং তৃতীয় অংশটি ভাসমান ভোটার, যারা যে কাউকে ভোট দেন।
“মোদী এমনভাবে কথা বলেন যাতে তার কথা সব ধরনের ভোটারের কাছে পৌঁছে যায়। এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন ভোটদানের হার কমে গেছে, তখন প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে তার দল আসলে পুরণো রাজনীতির পথ ধরছে। এই বিষয়টা খুবই লক্ষণীয়।”
একটানা তিনবার ধর্মীয় প্রসঙ্গ
রাজস্থানের টঙ্ক-সোওয়াই মাধোপুর কেন্দ্রে আরেকটি নির্বাচনী সভায় মঙ্গলবার মি. মোদী তার রবিবারের ভাষণের পুনরাবৃত্তি করেন।
লাইভ মিন্ট পোর্টাল ওই জনসভার বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
তারা লিখেছে, ওইদিন মি. মোদী বলেন, “কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা চেয়েছিল যাতে, তফসিলি-জাতি উপজাতিদের সংরক্ষণ কমিয়ে দিয়ে সেটা মুসলমানদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া যায়।”
মঙ্গলবার তিনি এ-ও বলেছেন যে কংগ্রেস ‘আপনাদের সম্পত্তি’ ছিনিয়ে নিয়ে ‘নির্দিষ্ট মানুষদের মধ্যে বিলি করতে চায়’।
আবার রবিবারের তার যে ভাষণ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, সেই প্রসঙ্গে মঙ্গলবার মি. মোদী বলেন, “পরশুদিন রাজস্থানে আমি দেশের সামনে কিছু সত্য উপস্থাপন করেছিলাম আর তাতেই পুরো কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোট আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
আমি তো এই সত্যটা তুলে ধরেছিলাম যে কংগ্রেস ষড়যন্ত্র করছে আপনাদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়ে তাদের বিশেষ কিছু মানুষের মধ্যে বিলি করার ষড়যন্ত্র করছে। আমি যখন তাদের রাজনীতির মুখোশ খুলে দিয়েছি, তারা রেগে গিয়ে মোদীকে কুকথা বলছে।”
রবিবার, নির্বাচনী প্রচারণায় মি. মোদী উল্লেখ করেছিলেন যে কংগ্রেস যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে নারীদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিতে পারে।
এই নিবন্ধে Google YouTubeএর কনটেন্ট রয়েছে। কোন কিছু লোড করার আগে আমরা আপনার অনুমতি চাইছি, কারণ তারা হয়ত কুকি এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকতে পারে। আপনি সম্মতি দেবার আগে হয়ত Google YouTube কুকি সম্পর্কিত নীতি এবং ব্যক্তিগত বিষয়ক নীতি প়ড়ে নিতে চাইতে পারেন। এই কনটেন্ট দেখতে হলে ‘সম্মতি দিচ্ছি এবং এগোন’ বেছে নিন।
সতর্কবাণী: বিবিসির নয় এমন ওয়েবসাইটের কনটেন্টের জন্য বিবিসি দায়ী না YouTube কনটেন্টে বিজ্ঞাপন থাকতে পারে
End of YouTube post
ছবির কপিরাইট
YouTube -এ আরো দেখুনবিবিসি। বাইরের কোন সাইটের তথ্যের জন্য বিবিসি দায়বদ্ধ নয়।
প্রধানমন্ত্রী সেখানে অভিযোগ করেন, কংগ্রেসের ইশতেহারে বলা হয়েছে ভারতের নারীরা তাদের বাড়িতে আবহমান কাল ধরে যেসব সোনাদানা বা অলঙ্কার জমিয়ে রাখেন, তারা ক্ষমতায় এলে সেগুলোর ‘হিসাব নেবে’ এবং নতুন করে তার বিলি-বন্দোবস্ত করবে।
তিনি হিন্দু বিবাহিত নারীদের গলায় যে মঙ্গলসূত্র থাকে, তার উল্লেখ করে বলেন, “মঙ্গলসূত্রের দাম শুধু সেটির সোনার দাম নয়। একজনের জীবনের স্বপ্নের সঙ্গে সেটি জড়িয়ে থাকে। আর আপনারা বলছেন সেটা কেড়ে নেবেন?”
রবিবারের ওই ভাষণের পরে সোমবার উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ের একটি জনসভায় আবারও মঙ্গলসূত্রের প্রসঙ্গ তোলেন নরেন্দ্র মোদী।
তিনি সোমবার বলেন, “আমি দেশের মানুষকে সাবধান করে দিতে চাই। কংগ্রেস এবং ইণ্ডিয়া জোটের নজর পড়েছে আপনাদের আয় আর সম্পত্তির ওপরে। কংগ্রেসের ‘শাহজাদা’ বলছেন তাদের সরকার যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে কে কত আয় করে, কার কত সম্পত্তি আছে সব হিসাব নেবে।“
“এখন এদের নজর পড়েছে নারীদের মঙ্গলসূত্রের ওপরে। তারা মা বোনেদের সোনা চুরি করার পরিকল্পনা করছে,” আলিগড়ের সভায় বলেন মি. মোদী।
‘আমার মা তো দেশের জন্য মঙ্গলসূত্র বিসর্জন দিয়েছেন’
প্রধানমন্ত্রী বারবার নারীদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেয়ার যে ‘কংগ্রেসি পরিকল্পনা’র কথা বলে আক্রমণ করছেন, তার জবাব দিয়েছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
তিনি নিজের ঠাকুমা ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং মা – কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর মঙ্গলসূত্র বিসর্জন দেয়ার কথা উল্লেখ করে মঙ্গলবার বেঙ্গালুরুতে এক নির্বাচনী সভায় প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বক্তব্য দেন।
ডেকান হেরাল্ড সংবাদপত্র ওই সভার প্রতিবেদন করতে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, “এ দেশ তো ৭০ বছরের বেশি স্বাধীন হয়েছে, কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল ৫৫ বছর। আপনার সোনা বা মঙ্গলসূত্র কি কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে?
ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধের সময়ে তার সোনাদানা দিয়ে দিয়েছিলেন। আর আমার মা সোনিয়া গান্ধী তার মঙ্গলসূত্র দেশের জন্য বিসর্জন দিয়েছেন।”
কংগ্রেস বলছে, মি. মোদী তাদের দলীয় ইশতেহারের যে অংশটাকে বিকৃত করে পরিবেশন করছেন, সেখানে তারা বলেছিল যে ক্ষমতায় এলে দলটি সারা দেশে একটা আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা করাবে।
তাদের ইশতেহারের ষষ্ঠ পাতায় ‘সামাজিক ন্যায়’ পরিচ্ছদের প্রথমেই লেখা হয়েছে – “কংগ্রেস দেশব্যাপী আর্থ-সামাজিক এবং জাতিগত জনগণনা করাবে যাতে জাতি ও উপজাতিগুলির আর্থ-সামাজিক অবস্থা বোঝা যায়। ওই তথ্যের ওপরে ভিত্তি করে ইতিবাচক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রটি জোরালো করা যাবে।”
ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়া বা সেই সম্পদ কারও মধ্যে বিলি করে দেয়ার কোন প্রসঙ্গ কংগ্রেসের ইশতেহারে আসে নি।
“নারীদের মঙ্গলসূত্র নিয়ে নেওয়া হবে, এমন কথাও কংগ্রেস কোথাও বলে নি।”
মি. মোদীর ভাষণের বিরোধিতা যে শুধু বিরোধী দলগুলি করছে তা নয়, তাদের জোটসঙ্গী শিরোমনি আকালি দলও মুখ খুলেছে মি. মোদীর ভাষণের বিরুদ্ধে।
তারা বলছে,আজ মুসলমানদের বলা হবে, কাল তো আমাদেরও বলা হতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা
লোকসভা নির্বাচনের সময় দেশে আদর্শ আচরণবিধি চালু হয়েছে। ওই আদর্শ আচরণবিধি অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারের সময় কোনও ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না এবং ধর্ম, সম্প্রদায় বা বর্ণের ভিত্তিতে ভোট দেওয়ার আবেদন করা যাবে না।
আচরণবিধি অনুযায়ী, কোনো ধর্মীয় বা জাতিগত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা স্লোগান দেওয়াও নিষিদ্ধ।
এই নিয়ম দেখিয়েই বিরোধীরা এবং সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই প্রধানমন্ত্রী মি. মোদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
সোমবার সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হন কংগ্রেস নেতারা।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, ১৯৫১ সালের জন-প্রতিনিধিত্ব আইন, সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেএমন ১৬টি অভিযোগ আমরা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছি।
তবে, নির্বাচন কমিশনের তরফে এখনও পর্যন্ত এই অভিযোগের ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি।
মি. মোদীর বক্তব্যের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনও নোটিশ দিয়েছে বা ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা সে সম্পর্কেও কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে নির্বাচন কমিশনের সূত্র উদ্ধৃত করে ভারতের কয়েকটি সংবাদপত্র লিখেছে যে ওইসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে কমিশন।
‘দ্য নিউজ মিনিট’ পোর্টালের খবর অনুযায়ী, কংগ্রেসের তরফ থেকে আদর্শ আচরণ বিধি ভঙ্গের যে অভিযোগ নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে করা হয়েছে, তা ছাড়াও বিভিন্ন গণ সংগঠন, নির্বাচন-নজরদারি সংগঠনও নির্বাচন কমিশনের কাছে আচরণ বিধি ভঙ্গের অভিযোগ পাঠিয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক সংগঠন মুসলমানদের প্রসঙ্গ নির্বাচনী সভায় আনার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে।
ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলির খবর অনুযায়ী, মি. মোদীর ভাষণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রায় ২০ হাজার ব্যক্তি ও সংগঠন আবেদন জানিয়েছে।