ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেনামে আর্থিক অনুদান দেয়ার জন্য জারিকৃত ‘নির্বাচনী বন্ড’ বাতিল করতে বলেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। এই বন্ডের বৈধতা প্রশ্নে দায়ের করা মামলার রায়ে এটিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছে আদালত।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে তথ্য অধিকার আইন এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯ (১) (এ) কে লঙ্ঘন করে নির্বাচনী বন্ড।
প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছেন, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলিকে আর্থিক সাহায্যের পরিবর্তে কিছূ পাওয়ার বিষয়টিকে উৎসাহ দেওয়া হতে পারে।
তিনি বলেছেন কালো টাকা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ নির্বাচনী বন্ড হতে পারে না। এর জন্য অন্য বিকল্পও রয়েছে।
২০১৭ সালে চালু হওয়া এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে গত প্রায় আট বছরে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।
আদালতের রায়ে স্টেট ব্যাঙ্ক ওফ ইন্ডিয়াকে রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী বন্ডের বিষয়ে জানানোর নির্দেশও দিয়েছেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। ওই নির্দেশ অনুযায়ী, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে সেই সমস্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দিতে বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ওই তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে ৩১ মার্চের মধ্যে প্রকাশ করবে।
এর ফলে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এসব বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেনামে অনুদান দিয়েছেন তাদের পরিচয়ও প্রকাশ হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। তার মতে এই সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই রায়?
আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেছেন, “নির্বাচনী বন্ড মামলায় সুপ্রিম কোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েছে, যা আমাদের গণতন্ত্রের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে। আদালত ওই বন্ড স্কিম খারিজ করেছে। এই স্কিমে কে কত টাকার বন্ড কিনেছে এবং কাকে দিয়েছে তা জানা সম্ভব নয়।”
“সুপ্রিম কোর্ট এটিকে তথ্য অধিকারের লঙ্ঘন বলে মনে করেছে।”
“এ বিষয়ে যে সংশোধন করা হয়েছিল যাতে যে কোনো কোম্পানি যেকোনো রাজনৈতিক দলকে যে কোনো পরিমাণ অর্থ দিতে পারে। আদালত কিন্তু তাও বাতিল করেছে।”
বিষয়টি ব্যাখা করেছেন তিনি। তার কথায়, “আদালত বলেছে যে এই নির্বাচন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কারণ এটি বড় কোম্পানিগুলিকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড শেষ করার সুযোগ দেয়৷”
” সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে এই স্কিমের অধীনে যত টাকা জমা হয়েছে, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে তা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। কমিশনের তা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরবে।”
সমাজকর্মী অঞ্জিল ভরদ্বাজ সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের এই রায় তথ্যের অধিকার আইনের জয়।”
“এই রায়ের ফলে নির্বাচনী বন্ডের নাম করে রাজনৈতিক দলগুলো যে সীমাহীন কর্পোরেট ফান্ডিং পেত, এবার তা বন্ধ হবে। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী আদেশের পর যে নির্বাচনী বন্ড কেনা হয়েছিল, তার বিশদ বিবরণ জনসমক্ষে আনার নির্দেশও দিয়েছে আদালত।”
বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, আদালত সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
তিনি জানিয়েছেন এই মামলায় একটি রায় তার ছিল, একটি বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার একটি মতামত ছিল। তবে এর উপসংহারে ক্ষেত্রে সবাই একমত।”
নির্বাচনী বন্ডের বিরুদ্ধে যে পিটিশনগুলো দাখিল করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, এটি তথ্য অধিকার আইন লঙ্ঘন করে। এর পাশাপাশি এটি কর্পোরেট ফান্ডিং অবাধ করেছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিপন্থী বলেও মন্তব্য করেছে আদালত।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) এমন একটি সংস্থা যারা নির্বাচনী খরচ এবং স্বচ্ছতা নিরীক্ষণ করে। ওই সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, বিজেপি ২০২২-২০২৩ সালে কর্পোরেট অনুদানের ৯০ শতাংশ পেয়েছে।
অন্যদিকে, ২০২২-২০২৩ সালে, জাতীয় দলগুলি অনুদান হিসাবে ৮৫০.৪৩৮ কোটি টাকা পাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৭১৯.৮৫ কোটি টাকা এবং কংগ্রেস পেয়েছে ৭৯.৯২ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, এই মামলা আট বছরেরও বেশি সময় ধরে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন ছিল। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এই রায় প্রভাব ফেলতে পারে সেই কারণে সমস্ত নজর ছিল এই মামলার রায়ের দিকে।
এই মামলার শুনানি শুরু হওয়ার আগে, ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরামানি এই স্কিমটিকে সমর্থন করেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টকে তিনি বলেছিলেন যে এই স্কিমটি রাজনৈতিক দলগুলিকে দেওয়া অনুদানে “ক্লিন মানি” ব্যবহারের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেবে।
এছাড়াও, অ্যাটর্নি জেনারেল সুপ্রিম কোর্টকে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধের অধীন না হয়েও নাগরিকদের সমস্ত কিছু জানার অধিকার থাকতে পারে না।
রাজনৈতিক দলগুলি কার কাছ থেকে কত টাকা অনুদান হিসেবে পেয়েছে সে তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবির প্রেক্ষিতেই তার এই যুক্তি।
নির্বাচনী বন্ড কী?
নির্বাচনী বন্ড রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান দেওয়ার একটি মাধ্যম। অনেকটা প্রতিশ্রুতি নোটের মতো যা ভারতের যে কোনো নাগরিক বা সংস্থা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার নির্বাচিত শাখাগুলি থেকে কিনতে পারে এবং তাদের পছন্দের যেকোনো রাজনৈতিক দলকে বেনামে দান করতে পারে।
ভারত সরকার ২০১৭ সালে নির্বাচনী বন্ড স্কিম ঘোষণা করেছিল। এই স্কিমটির আইনি প্রয়োগ হয় ২০১৮ সালের ২৯ শে জানুয়ারি।
এই স্কিম অনুযায়ী, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া রাজনৈতিক দলগুলিকে তহবিল দেওয়ার জন্য বন্ড ইস্যু করতে পারে।
ওই ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট রয়েছে এবং কেওয়াইসি করা আছে, এমন ব্যক্তি ওই বন্ড কিনতে পারেন৷ কিন্তু নির্বাচনী বন্ডে যিনি টাকা দিচ্ছেন তার নাম থাকে না।
স্কিমের অধীনে, ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট শাখা থেকে এক হাজার, দশ হাজার, এক লক্ষ, দশ লক্ষ এবং এক কোটি টাকার মধ্যে যে কোনও মূল্যের নির্বাচনী বন্ড কেনা যায়।
নির্বাচনী বন্ডের মেয়াদ মাত্র ১৫ দিন। এই সময়ে এটি শুধুমাত্র জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের অধীনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলিতে অনুদানের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অনুদান দেওয়া যেতে পারে শুধুমাত্র সেই রাজনৈতিক দলগুলিকে যারা লোকসভা বা বিধানসভার জন্য গত সাধারণ নির্বাচনে অন্তত এক শতাংশ ভোট পেয়েছে।
নির্বাচনী বন্ড কেন চিন্তার বিষয়?
গত ২০১৮ সালে ভারতে নির্বাচনী অনুদানের জন্য নির্বাচনী বন্ড চালু করা হয়েছিল। এই বন্ডগুলি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জারি করা হয় এবং এথেকে সুদ পাওয়া যায় না।
সরকারের মতে, ইস্যু করার পর থেকে, ১৯টি ধাপে ১১৫ কোটি ডলার মূল্যের নির্বাচনী বন্ড বিক্রি হয়েছে।
এতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, অনুদানে জারি করা মোট বন্ডের দুই-তৃতীয়াংশ পেয়েছে বিজেপি। সেই তুলনায় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ বন্ড।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর), একটি সংস্থা যারা ভারতে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দলগুলি পর্যবেক্ষণ করে। ওই সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, সাতটি জাতীয় দলের আয়ের ৬২ শতাংশেরও বেশি নির্বাচনী বন্ড থেকে প্রাপ্ত অনুদান থেকে এসেছে৷
ভারতে নির্বাচনী বন্ড চালু করা হয়েছিল যাতে রাজনৈতিক অনুদানে কালো টাকার লেনদেন বন্ধ করে রাজনৈতিক দলগুলির তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করা যায়।
তবে সমালোচকরা বলছেন, নির্বাচনী বন্ডের প্রভাব হয়েছে উল্টো। বন্ডের মাধ্যমে দান রহস্যময়।
প্রথমত, একটি বন্ড কে কিনেছে এবং কাকে দান করেছে তার কোনো পাবলিক রেকর্ড নেই। এডিআর জানিয়েছে, এই প্রক্রিয়া নির্বাচনী বন্ডকে ‘অসাংবিধানিক এবং অবৈধ’ করে তোলে কারণ দেশের করদাতারা অনুদানের উৎস সম্পর্কে সচেতন নন।
সমালোচকেরা এও বলেছেন যে নির্বাচনী বন্ডগুলি সম্পূর্ণ বেনামী এমনটা নয়। কারণ পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলির কাছে কে বন্ডটি কিনেছিল এবং কোন দলকে এটি দান করা হয়েছিল তার সম্পূর্ণ তথ্য রয়েছে৷
এই অবস্থায় ক্ষমতাসীন দল সহজেই এই তথ্য সংগ্রহ করে দাতাদের প্রভাবিত করতে ‘ব্যবহার’ করতে পারে।
এডিআর-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জগদীপ ছোকার বলছেন, ‘এইভাবে নির্বাচনী বন্ড শাসক দলকে অন্যায্য সুবিধা দেয়।’