বাংলাদেশের নির্বাচন বর্জন করে বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচির মধ্যে ভোট প্রতিহত করার ঘোষণার কারণে শান্তিপূর্ণ ভোট আয়োজন করতে সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার(সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
নির্বাচনকে ঘিরে মার্কিন ভিসা নীতির প্রশ্নে সিইসি বললেন, ‘আমি ভিসা কী জিনিস বুঝি না, পাসপোর্ট কী বুঝিনা, অর্থনীতি কী বুঝি না, এটা আমাদের দায়িত্ব না।আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে মিট দ্যা প্রেসে যোগ দিয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন।
সিইসি বলেন, একটি পক্ষ নির্বাচন বর্জন করেছে এবং প্রতিহত করার চেষ্টা করতে পারে। সেদিক থেকে কিছুটা সংকট আছে। তবে আমরা আশা করছি এই সংকট আমরা মোকাবিলা করতে পারবো।
ভোটের দুয়েক দিন আগে থেকে ট্রেন কিংবা ভোটকেন্দ্রে আগুনের ঘটনা খুব বেদনাদায়ক, সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন মি. আউয়াল।
তিনি বলেন, যারা হরতাল দিয়েছে তারাও বলেছিল তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবে। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে ভোটারদের ভোট বিরোধী প্রচারণা চালাবে। কোনও দল যদি এটি করে থাকে এটি অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে করি, বলেন তিনি।
সাংবাদিকদের সিইসি যা বললেন
ভোটের আগেরে দিন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল সংঘাত-সহিংসতা হলে ভোটের নিয়ন্ত্রণ কতটা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকবে? প্রশ্নের জবাবে সিইসি বললেন, কতটা নিয়ন্ত্রিত হবে সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। সর্বাত্মক চেষ্টা হচ্ছে। তবে কোনও একটা বিরোধী পক্ষ ভোট বর্জনের পাশাপাশি প্রতিহত করার চেষ্টা করছে।
এতে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে উঠিয়ে আনা কঠিন হবে। “আশা করি ভোটাররা আসবে। আরও ৪৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করুন, সেটা হয়তো দেখতে পারবেন” বলেন মি. আউয়াল।
বাংলাদেশের বিগত দুটি নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। এমন অবস্থায় পরের নির্বাচনে দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলসহ ১৬টি দলের অংশগ্রহণ নেই এই ভোটে, নির্বাচন কমিশনের ওপর কতটা আস্থা থাকবে সাধারণ মানুষের এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল সাংবাদিকদের।
জবাবে মি. আউয়াল পাল্টা প্রশ্ন করেন, কমিশন কি কোনও রাজনৈতিক দল? কমিশনের ওপর আস্থা থাকুক বা না থাকুক দলগুলোর মধ্যে আস্থা আছে। কোনও বিশেষজ্ঞ কী বলবেন, যে দশ বছর নির্বাচন বন্ধ করুন, দলগুলো সমঝোতায় আসলে ভোট করুন। তাহলে আমি নির্বাচন বন্ধ করে দেবো।
তিনি বলেন, ভোটগ্রহণের মধ্যেই যদি কারচুপি হয়, কিছু দায়ভার আমাদের ওপর আসবে। কেন্দ্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রিজাইডিং অফিসার। বারবার তার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মি. আউয়াল বলেন, খারাপ ভোট হলে দায়ভার আপনারকেও নিতে হবে। কেননা, ভোটকেন্দ্রে মিডিয়ার অবাধ অধিকার থাকবে। তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। স্বচ্ছতা তুলে ধরতে পারলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যেতে পারে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, অনেকে সিলেকশন বলছেন, শুধু সিলেকশন নয় আরও কিছু বলছেন। আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচন আয়োজন করা, রাজনৈতিক বিতর্কে সম্পৃক্ত হওয়া আমাদের কাজ না। এ সংকট রাজনৈতিক।
তিনি বলেন, গ্রহণযোগ্যতার কোনও সুস্পষ্ট মানদণ্ড নেই। কেউ বলবেন গ্রহণযোগ্য হয়েছে, কেউ বলবেন হয়নি। আপনারা দৃশ্যমান করে তোলার চেষ্টা করবেন। এতে দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে। গণমাধ্যমের প্রকৃত চিত্র উঠে আসলেও মানুষ প্রকৃত চিত্র বুঝতে পারবে।
কেন্দ্রের নিরাপত্তা কী ব্যবস্থা? সিইসির জবাব, আট লাখের বেশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ভোটগ্রহণের সময় ভোটারদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছে। বড় দল ভোট বিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ হলে আমরা কিছু মনে করবো না। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বলবে সেটা অপরাধ। এটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ।
মার্কিন ভিসা নীতির বিষয়ে জাপানি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মি. আউয়াল বলছেন, এটা কমিশনের দায়িত্ব নয়, কে অংশ নেবে। কমিশন সবাইকে আহ্বান জানাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য। নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য। তারা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) অবাধ, সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বিশ্বাস করে।
তিনি বলেন, যারা এক্ষেত্রে বাধা দেবে তাদের ওপর এই নীতি প্রয়োগ করবেন। আমরা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করছি না। আমরা জানি না, কারা আগুন দিচ্ছে, মানুষকে হত্যা করছে। আমরা আমাদের জায়গায় থেকে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের চেষ্টা করছি। আমরা এটা নিয়ে চিন্তিত নই। কারণ এটা আমাদের বিষয় নয়। ভিসা কী, পাসপোর্ট কী, অর্থনীতি কী তা আমি বুঝি না। এটা বোঝে পররাষ্ট্র দপ্তর।
এই নির্বাচনের সরকার কে হবে, কিন্তু বিরোধী দল কে হবে? এমন ভোটে নির্বাচন কমিশন বিব্রত কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, এটা আমাদের বিষয় নয়। নির্বাচন হলে তারাই সংসদে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা এজন্য মোটেই বিব্রত নই।
সিইসি বলেন, “নির্বাচন কমিশন হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বডি। আমি বলতে চাই আমরা বিশ্বাস করি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছতামূলক নির্বাচন। স্থানীয়ভাবেই কেবল নয়, আমরা আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষণ হোক সেটা চাই”।
দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের সামনে নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে মিট দি প্রেস আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। এ সময় অন্য নির্বাচন কমিশনার, সচিবসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
৭ই জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে ২৮ টি দল ও স্বতন্ত্র মিলে এক হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
সিইসির জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ
শনিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এসময় তিনি বলেন, মতবিরোধের কারণে এবারের নির্বাচনে কাঙ্খিত রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। নির্বাচনী সার্বজনীনতা প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি। তবে, নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও অংশগ্রহণমূলক নয় মর্মে আখ্যায়িত করা যাবে না।
নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে সিইসি বলেন, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, শৈথিল্য, অসততা ও ব্যত্যয় সহ্য করা হবে না। কেউ কোনো প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে জাল ভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, অর্থের লেনদেন ও পেশিশক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রার্থিতা তাৎক্ষণিক বাতিল করা হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্র বা নির্বাচনী এলাকার ভোট গ্রহণ সামগ্রিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হবে।
মি. আউয়াল বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ রয়েছে। মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা কাম্য নয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় নাশকতা ও সহিংসতা একেবারেই হচ্ছে না তা বলা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় ধন-সম্পদের ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে। নির্দোষ, নিরীহ, নিষ্পাপ শিশু-নারী-পুরুষের মর্মান্তিক ও মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। চলমান এহেন পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান ও অবসান প্রয়োজন। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে।
ভাষণে সিইসি বলেন, “যে কোনো রাজনৈতিক সংকটের নিরসন সম্ভব। নির্বাচন বর্জনকারী দলসমূহ সহিংস পন্থা পরিহার করে কেবল শান্তিপূর্ণ পন্থায় জনগণকে নির্বাচন বর্জনের আহবান জানানোয় এতে জনমনে আস্থা সঞ্চারিত হয়েছিল। ঘোষিত হরতাল অবরোধের মধ্যে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা ঘটছে। কারা দায়ী সেটি আমাদের বিবেচ্য নয়। তবে নাশকতা ও সহিংসতার কতিপয় সাম্প্রতিক ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন”।
রবিবারের ভোটে ভোটারদের নির্ভয়ে কেন্দ্রে এসে ভোট দেয়ার আহবান জানান সিইসি।