মিয়ানমার সীমান্তের বিবদমান পক্ষগুলো যদি নাফ নদে চলাচলকারী কোনো বাংলাদেশি নৌযানে আর গুলি চালায় তাহলে বাংলাদেশ থেকেও পাল্টা গুলি করা হবে। মিয়ানমার বাহিনী ও আরাকান আর্মি দুই দলকেই এমন বার্তা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান আসাদুজ্জামান খান। দুই সপ্তাহ আগে কয়েকটি বাংলাদেশি নৌযানে গুলির ঘটনার পর দ্বীপটিতে যাতায়াত সংকটের মুখে পড়ে। ফলে, পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে সেখানে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের সংকট দেখা দিয়েছিল।
বাংলাদেশি নৌযানগুলোতে “ভুল করে ফায়ার ওপেন করেছিল”, বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের ভেতর আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার জান্তা সরকারের সৈন্যদের মধ্যে তুমুল সংঘাতের খবর পাওয়া যাচ্ছে গত বেশ কয়েকমাস যাবত। এ সংঘাতের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ভেতরে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের তরফ থেকে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারকে বার্তা দেয়া হয়েছে।
“তাদেরকে আমরা জানিয়েছি। তারা যেটা বলছে, সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ যাতে উড়িয়ে যায় সেইরকম একটা ব্যবস্থা করেন। তাহলে, বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ দেখলে আর কেউ গুলি করবে না,” সাংবাদিকদের বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কী করা উচিত সেটি নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।
মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম মনে করেন, পাল্টাপাল্টির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
সেজন্য পাল্টাপাল্টি গুলির হুমকি দিয়ে “সম্পর্ক বিনষ্ট করার প্রয়োজন দেখেন না” তিনি।
তবে আরেকজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেনের ভাষ্য হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে সংঘাতরত পক্ষগুলোকে বাংলাদেশের দিক থেকে একটা ‘বার্তা’ দেয়া উচিত।
“যদি অ্যাটাক করতে চাও তার জবাব আমরা দিতে পারি, এই বার্তাটা দেয়া উচিত,” বলেন মি, হোসেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো যা বলেছেন
প্রসঙ্গের শুরুতেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমরা যতটুকু জানি আরাকান আর্মি রাখাইনের অনেকটা অংশ দখল করে ফেলেছে।”
তবে, আরাকান আর্মি ঠিক কোন কোন জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বা অবস্থান করছে তা সুনির্দিষ্টভাবে এখন বলতে পারবেন না বলে জানান তিনি।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দ্বীপ সেন্ট মার্টিন যাওয়ার রুটে টেকনাফের কাছে নাফ নদের কিছু অংশ নাব্যতা হারিয়েছে।
এতে, সেই দিক দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারে না। যেতে হয় মিয়ানমার অংশ দিয়ে।
“সেইখানেই এই বিপত্তিটা করে,” বলেন মি. খান। এর আগে কারা গুলি সে সম্পর্কে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হতে পারেনি।
এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানাচ্ছেন, কখনো মিয়ানমার আর্মি কখনো বা আরাকান আর্মি ফায়ার ওপেন করে।
“আমরা দুই দলকেই বলে দিয়েছি, আমাদের গুলি করলে আমরাও পাল্টা গুলি করবো। কাজেই এখানে আর কোনো গোলাগুলি হচ্ছে না,” যোগ করেন তিনি।
আরো জানান, ওই সীমান্তে মিয়ানমারের দুইটি জাহাজ অবস্থান করছিলো, সেগুলোও ফেরত নিয়ে গেছে।
সীমান্তে জটিল পরিস্থিতি
আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি শহর। কিন্তু, তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিল না বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের। গত মার্চে বিবিসি বাংলাকে একথা বলছিলেন বিজিবি’র একটি ব্যাটালিয়ানের কমান্ডার।
ফলে, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে যে পতাকা বৈঠক হয় বিজিবি সেটি করতে পারে না আনুষ্ঠানিকভাবে।
বাহিনীটির সাবেক মহাপরিচালক ফজলুর রহমান মার্চে বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকারি নির্দেশনা ছাড়া এই যোগাযোগের ম্যান্ডেট বিজিবির নেই।
“বিজিবির এরকম কোনো ম্যান্ডেট নাই যে রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এটা সরকারকেই এটার ব্যবস্থা নিতে হবে,” বলেন ফজলুর রহমান।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ তাগিদ দিয়ে আসছিলেন তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের। তাদের একজন সাখাওয়াত হোসেন।
মি. হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটা নিশ্চিত যে আরকান বা রাখাইনে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সেই একচ্ছত্র আধিপত্য আর থাকবে না”।
“স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যেহেতু দুই পক্ষকেই বার্তা দেয়ার কথা বলেছেন, আরাকান আর্মির সাথে মেসেজ দেয়ার মতো যোগাযোগ নিশ্চয়ই হয়েছে”।
“আরাকানের সাথে একমাত্র বাংলাদেশই সীমান্তবর্তী দেশ। আরাকান আর্মিরও আমাদেরকে প্রয়োজন আছে। একটা সম্পর্ক তো ডেভেলপ করাই উচিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে,” বলছিলেন এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
পাল্টা হুঁশিয়ারি’র প্রভাব কী হতে পারে?
গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে জান্তা বাহিনীর যুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়া মর্টার শেলের আঘাতে প্রাণ যায় দুই জনের। আতংকে জনশূন্য হয়ে পড়ে সীমান্তের গ্রামগুলো।
সেই সময় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। এর আগে ও পরে বিভিন্ন সময় সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হলে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, “সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে” জবাব দেয়া হবে।
ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চলতি মাসে নৌযানে গুলির ঘটনার পরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরাও প্রস্তুত। আক্রমণ করব না, কিন্তু আক্রান্ত হলে কি ছেড়ে দেব?”
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তরফে গুলির কথা বলাটা “অপ্রয়োজনীয় ছিল” বলে মন্তব্য করেছেন, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম।
একসময় মিয়ানমারের সিতওয়েতে বাংলাদেশ মিশনে কাজ করা মি. ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দুই চার রাউন্ড গুলি করে কি কেউ কোনো যুদ্ধে আসে? ও একটা গুলি করবে, আমি একটা করবো, এভাবে তো সম্পর্ক বিনষ্ট হবে। এখানে তো রিট্যালিয়েট (পাল্টা আঘাত) করার কিছু নেই।”
মিয়ানমারের দিক থেকে আগে যেসব গুলির ঘটনা ঘটেছিল সেগুলোকে ‘প্রুভেন ফায়ার’ বলে ধারণা করছেন এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
‘প্রুভেন ফায়ার’ শব্দ দুটি সামরিক বাহিনীতে প্রচলিত বলে জানালেন তিনি। এতে বোঝানো হয়, সন্দেহজনক কোনো গতিবিধি দেখলে সেখানে শত্রুপক্ষের উপস্থিতি আছে কী না বোঝার জন্য এক বা দুই রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে দেখা হয় যে কোনো পাল্টা জবাব আসে কী না।
যেহেতু, মিয়ানমারের দুটি পক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত তারা নাফ নদে কোনো নৌযান দেখলে সতর্কতাবশত ‘প্রুভেন ফায়ার’ করে থাকতে পারে মি.এমদাদ ধারণা করছেন।
তবে, একাধিকবার সতর্ক করা বা প্রতিবাদ জানানোর পরেও গুলির ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশ পাল্টা জবাব দেয়ার অধিকার রাখে বলে মনে করেন আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাখাওয়াত হোসেন।
বলেন, “যদি অ্যাটাক করতে চাও, তার জবাব আমরা দিতে পারি, এটা জানানোর পাশাপাশি স্থানীয় মানুষজনকে একটা সাহসও দিতে হবে”।
সেই দিক থেকে হুঁশিয়ারিটাকে ‘যৌক্তিক’ হিসেবেই দেখেন তিনি। একই সাথে পরিবহন ও সরবরাহ অব্যাহত রাখতে নৌবাহিনী বা কোস্টগার্ডের এসকর্ট (প্রহরা) ব্যবহার করার পরামর্শ তার।