দেবিকা রোতাওয়ানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ২০১০ সালে, মুম্বাইয়ের একটা বস্তিতে। তার মাত্র বছর দুয়েক আগে ভারতের বাণিজ্য আর বিনোদন জগতের রাজধানী মুম্বাইয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েও বেঁচে যায় ওই রোগা-পাতলা মেয়েটি।
মুম্বাই শহরটাকে প্রায় ৬০ ঘণ্টা ধরে একরকম দখল করে রেখেছিল ওই সন্ত্রাসীরা, যার শুরুটা হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বর।
মুম্বাইয়ের প্রধান রেলস্টেশন, বিলাসবহুল হোটেল এবং একটি ইহুদি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে চালানো ওই হামলায় মোট ১৬৬ জন প্রাণ হারান। হামলাকারীদের মধ্যে নয় জনও নিহত হয়।
ওই সন্ত্রাসীদের মধ্যেই একজন সে দিন দেবিকা রোতাওয়ানের পায়ে গুলি করেছিল, তার মাসখানেক পরেই ছিল ওর দশ বছরের জন্মদিন।
ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস স্টেশনে যে জঙ্গী মিস দেবিকার পায়ে গুলি করেছিল তার নাম ছিল মুহম্মদ আজমল আমির কাসাব – হামলাকারী দলের একমাত্র সদস্য যে তখন বেঁচে যায়।
‘কাসাবকে শনাক্ত করা মেয়েটি’
শুধুমাত্র ওই স্টেশনেই কাসাব আর তার সহযোগীদের গুলির আঘাতে প্রায় ৫০ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন, আরও অন্তত ১০০ জন আহত হয়েছিলেন।
পরে, ভরা আদালতে দাঁড়িয়ে দেবিকাই কিন্তু শনাক্ত করেছিলেন আজমল কাসাবকে। তিনিই ছিলেন ওই মামলার বিচারে সবথেকে কমবয়সী সাক্ষী।
তখন থেকেই সংবাদমাধ্যমের দৌলতে দেবিকা রোতাওয়ানের পরিচয় হয়ে গেছে ‘কাসাবকে সনাক্ত করা মেয়েটি’ হিসাবে।
বিচারে কাসাবের মৃত্যুদণ্ড হয় ২০১০ সালের মে মাসে আর তার দুবছর পরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় মোড়া পুনে শহরের জেলে তার ফাঁসি হয়।
আমি যখন দেবিকার সঙ্গে প্রথম বার দেখা করেছিলাম ২০১০ সালে, সে বেশ লাজুক ছিল। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটত ও আর খুব হাসত, কিন্তু বেশি কথা বলত না।
তার ভাই জয়েশ কোনও একটা অস্থিরোগে আক্রান্ত হয়ে ভাঙ্গাচোরা ঘরের একটা কোণেই শুয়ে থাকতেন।
তাঁর বাবা মি. নটওয়ারলাল শুকনো ফল বা ড্রাই ফ্রুটস বিক্রি করতেন। তার কাজটা চলে গিয়েছিল বলে সেই সময়ে তাদের একটা দুশ্চিন্তা ছিল।
পরিবারটির সম্পত্তি বলতে ছিল কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার, একটা ট্রাঙ্ক আর বাসনপত্র। দেবিকা আমাকে তখন বলেছিল, “আমি বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হতে চাই।“
ঝকঝকে, আত্মবিশ্বাসী এক নারী
সেই সাক্ষাতের প্রায় ১৩ বছর পরে কয়েকদিন আগে আমি আবারও তার সঙ্গে দেখা করতে মুম্বাই গিয়েছিলাম।
আর মাসখানেক পরেই দেবিকা রোতাওয়ানের বয়স ২৫ বছর হয়ে যাবে। প্রায় এক যুগ পরে বেশ ঝকঝকে, আত্মবিশ্বাসী এক নারী হয়ে উঠেছেন দেবিকা।
ওই বস্তির ঘর ছেড়ে তারা এখন একটা ছোট ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকেন।
আজকাল মিস দেবিকাই সব কথা বলেন, আর তার বাবা শোনেন।
এত বছর ধরে সাংবাদিক, টিভি শো, পডকাস্ট আর নানা সভা-সমিতিতে তিনি যে ঘটনার কথা শুনিয়ে এসেছেন, আবারও তিনি গড়গড় করে সেই কাহিনী শোনালেন।
পুনে যাওয়ার জন্য রাতের ট্রেন ধরতে ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে অপেক্ষা করছিলেন তারা। হঠাৎই তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান আর দেখেন যে তার চারপাশে মানুষজন গুলি লেগে পড়ে যাচ্ছেন।
এক তরুণ বড় একটা বন্দুক নিয়ে ভয়ডর-হীন হয়ে চতুর্দিকে গুলি করছিল।
দৌড়ে পালাতে গিয়েছিলেন মিস দেবিকা, তখনই তার ডান পায়ে একটা গুলি এসে লাগে। তিনি অজ্ঞান হয়ে যান।
ছয়বার অপারেশনের ধকল সহ্য করে সুস্থ হয়ে মিস দেবিকা বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন ৬৫ দিন পরে।
বছরখানেক পরে তিনি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ১১ বছর বয়সে।
কিন্তু গোড়ায় তাকে স্কুল ভর্তি নিতে চায়নি।
স্কুল কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা হয়েছিল যে তিনি অন্য ছাত্রছাত্রীদের ‘বিপদ ডেকে আনবেন’, কারণ ততদিনে তিনি যে ‘কাসাবকে সনাক্ত করা মেয়ে’ হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
‘দেবিকা রোতাওয়ান ২৬/১১’
একটি বিশেষ আদালতে ২০০৯ সালের জুন মাসে কাসাবকে শনাক্ত করার সময়ে তিনি কাসাবের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়েছিলেন।
মিস দেবিকা বলছিলেন, “সে আমার দিকে একবার তাকিয়েই মাথা নামিয়ে নিয়েছিল।“
এত বছর পরে, এখনও তার জীবনটা সেই ২৬/১১কে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
মুম্বাই অনেক এগিয়েছে, কিন্তু সেই হামলার আতঙ্ক দেবিকার জীবনে একটি লম্বা ছায়া ফেলে দিয়েছে।
তাঁর ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটার হ্যাণ্ডেল ‘দেবিকা রোতাওয়ান ২৬/১১’।
ফেসবুকে তিনি নিজেকে ‘মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার সর্বকনিষ্ঠ শিকার’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
সামাজিক মাধ্যমের পোস্টগুলোর মধ্যে যেমন রাহাত ফতেহ আলি খানের গান চালিয়ে তার জন্মদিন উদযাপন বা সৈকতের পাশে নাচের প্রাণবন্ত রিল রয়েছে, তেমনই এমন সব ছবিও আছে যেখানে দেবিকা রোতাওয়ান সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছেন বা মুম্বাই হামলায় নিহতদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।
সাহসিকতার জন্য তিনি যে শুধু প্রশংসাই পান, তা নয়। আর্থিক সহায়তাও আসে।
তার বাড়ির দেয়ালে জুড়ে টাঙ্গানো আছে ২৬/১১-র সঙ্গে জড়িত নানা ছবি, স্মারক আর প্রশংসাপত্র।
গত বছর মুম্বাই সফরের সময় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গেও তার ছবি রয়েছে।
ওইসবের পাশেই আছে প্লাস্টিকে মোড়া একটা বড় টেডি, সম্ভবত কোনও এক ফ্যান ক্লাবের দেওয়া উপহার।
তিনি ২৬/১১-র হামলায় বেঁচে যাওয়া একজন ভিক্টিম হিসাবে অমিতাভ বচ্চনের ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ আর ইণ্ডিয়ান আইডলের আসরে হাজির হয়েছিলেন।
এসবের বাইরে তো গণমাধ্যম রয়েইছে।
রাহুল গান্ধীর সঙ্গে পদযাত্রায়
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনও উত্তেজনা তৈরি হলেই গণমাধ্যম তার ‘বাইট’ নিতে চলে আসে।
“আমার মন্তব্য নেওয়ার জন্য কখনও সখনও সটান ঘরে ঢুকে পড়ে তারা। মাঝে মাঝে বেশ অস্বস্তিই লাগে আমার,” বলছিলেন মিস দেবিকা।
দেবিকা অবশ্য এগুলো উপভোগও করেন।
ইনস্টাগ্রামে তিনি লিখেছেন, ‘আপনি জীবনে যা-ই করুন না কেন, দিনের শেষে আপনি যেন সুখী হতে পারেন।“
ওই সুখের জন্য অবশ্য কঠোর পরিশ্রমও করতে হয় রোতাওয়ান পরিবারকে।
মাস ছয়েক আগে শহরতলির দিকে ‘বস্তি পুনর্বাসন প্রকল্পে’ নির্মিত একটা বাড়ির সাত তলায় ২৭০ বর্গফুটের এক কামরার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন তারা। মাসিক ১৯ হাজার টাকা ভাড়াটা তাদের পক্ষে বেশ চাপের।
তবে ১৫ বছর আগের ওই সন্ত্রাসী হামলার কারণেই সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা মিস দেবিকার খ্যাতিই এখনও সংসারটা টেনে নিয়ে চলে।
তার বাবা মি. নটওয়ারলাল এখনও বেকার।
মিস দেবিকার ২৮ বছর বয়সী ভাই জয়েশ কয়েক মাস আগে অফিস সহকারী হিসেবে একটা চাকরি পেয়েছেন।
২৬/১১-র আক্রান্ত হিসাবে মিস দেবিকা আট বছরে দুই দফায় মাত্র ১৩ লক্ষ টাকা সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন।
স্কুল শেষ করার পরে, তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, যার জন্য তার পড়াশোনাও প্রভাবিত হয়েছিল।
হামলার পরে সরকার যে ঘোষণা করেছিল যে আক্রান্তদের বাড়ি দেওয়া হবে, সেই প্রতিশ্রুতি আদায়ের জন্য মামলা লড়ছেন মিস দেবিকা।
হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সহায়তা করে একটি বেসরকারি ট্রাস্ট। তারাই মিস দেবিকার কলেজের বেতন দেয়।
গত বছর ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী তাকে ‘ভারত জোড়ো’ পদযাত্রায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
বাবার জন্মস্থান রাজস্থানে গিয়ে ওই পদযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন মিস দেবিকা। সে রাজ্যের কংগ্রেস সরকার তাকে সেখানে একটি ছোট জমি উপহার দিয়েছে।
মিস দেবিকা পরের বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক হবেন। আর তার পরেই পুলিশে যোগ দেওয়ার পরীক্ষায় বসতে চান তিনি।
তার কথায়, “আমিও গত কয়েক মাস ধরে চাকরি খুঁজছিলাম, কিন্তু পাইনি। এর জন্য বেশ চিন্তায় আছি কারণ মুম্বাই শহরটা থাকার জন্য খুব খরচ সাপেক্ষ হয়ে উঠছে।“
পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন
২৬/১১-র সেই মর্মান্তিক ঘটনার গত ১৫ বছর পরেও মিস দেবিকা আর তাঁর পরিবারটা চলছে বন্ধু, দাতা বা ক্লাবগুলির থেকে পাওয়া সহায়তায়।
তার বাবা মি. নটওয়ারলাল বলছিলেন, “ভাষণ দেওয়ার জন্য যখন দেবিকাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায়, আমরাও সেখানে যাই ট্রেনে বা বিমানে করে। তারা সার্টিফিকেট দেয়, আবার টাকাও দেয়।“
“এরকম কয়েকশো জায়গায় গেছি। এভাবেই আমাদের সংসার চলে,” বলছিলেন মিস দেবিকার বাবা।
কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?
‘কাসাবকে সনাক্ত করা মেয়ে’ – এই পরিচয়ে দিন কাটাতে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন মিস দেবিকা?
“এই পরিচয়টা তো আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এটা দূরে সরিয়ে দিতে পারব না, এটাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে,” তিনি আমাকে বলেছিলেন।
তার কথায়, “একমাত্র যে পরিচয়টি আমার পছন্দ তা হ’ল একজন পুলিশ অফিসারের পরিচয়, যাতে সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করতে পারি।“
তার মুখে হাসি লেগেই থাকে। স্বপ্নগুলোও মরে না।