বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে ভারতের মুর্শিদাবাদে নৌ পথের একটি রুট ৫৯ বছর পর আবারো চালু হয়েছে। সোমবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুলতানগঞ্জ-মায়া নৌপথটি উদ্বোধন করা হয়।
এখানে একটি নৌ বন্দরও চালু করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে এই নৌ পথটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এখন দুই দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনা করে এ নৌ-পথ চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ।
তবে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরকে ঘিরে অবকাঠামোগত যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর দ্রুত সংস্কার না করলে সুফল পাওয়া যাবে না।
কেন আবার চালু হয়েছে এই রুট
১৯৬৫ মালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর দুই দেশের মধ্যে থাকা নৌ-পথের বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর ২০১৮ সালে দুই দেশের নৌসচিব পর্যায়ের একটি বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে থাকা বেশ কয়েকটি নৌ-পথ নতুন করে চালু করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
পরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০২০ সালের যে চুক্তির আওতায় বাণিজ্য হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ – ভারত অভ্যন্তরীণ নৌ পথ অতিক্রমণ ও বাণিজ্য প্রটোকলে ২০২০ সালে একটি সংশোধনী এনে আবার চালু হলো রুটটি।
সম্পূর্ণ রুটটি হবে আরিচা – রাজশাহী – গোদাগাড়ি – সুলতানগঞ্জ – মায়া – ধুলিয়ান। তবে, এখনই আরিচা পর্যন্ত চালু হচ্ছে না।
বাংলাদেশ অংশে রাজশাহী এবং গোদাগাড়ি বা সুলতানগঞ্জ এবং ভারতীয় অংশে মায়া এবং ধুলিয়ানকে নতুনভাবে পোর্ট অব কল হিসেবে ঘোষণা করেছে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ।
‘পোর্ট অব কল’ হলো নৌবন্দর বা সমুদ্র বন্দর যেখানে থেমে জাহাজ বা নৌযান খাবার, তেল, পানি সংগ্রহ বা বিরতি দিতে পারে।
ফলে এই নৌপথ চালু হওয়ার পরে দুই দেশের সীমান্তে আসলে একটি নদী বন্দর তৈরি হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভেতরে সুলতানগঞ্জ আর ভারতের ভেতরে মায়া নদী বন্দরে পরিণত হবে।
রাজশাহী – চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক থেকে এক কিলোমিটার ভেতরে পদ্মা মহানন্দার মোহনায় সুলতানগঞ্জ নৌ ঘাট অবস্থিত। আর এই সুলতানগঞ্জ থেকে মায়া নৌ ঘাটের দূরত্ব ২০ কিলোমিটার।
একই সাথে পদ্মা – মহানন্দার মোহনায় সারা বছরই পানি থাকে। ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মায়া থেকে সুলতানগঞ্জে পণ্যবাহী জাহাজ বা নৌ যানের সময় লাগবে এক ঘণ্টা। দুই দেশের দূরত্ব কমবে ১২০ কিলোমিটার।
“এই রুটে সারা বছরই স্বল্প নাব্যতার নৌযান দিয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য পরিচালনা করা সম্ভব” বলে জানিয়েছেন বি আই ডব্লিউ টি এর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা।
যেসব পণ্য আমদানি – রপ্তানি হবে
এরই মধ্যে এই রুট ব্যবহার করে যেসব পণ্য আনা – নেয়া করা যাবে তার প্রজ্ঞাপন দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
এই রুটে ভারত থেকে গবাদি পশু, মাছের পোনা, তাজা ফলমূল, গাছ গাছড়া, বীজ, গম, পাথর, কয়লা, রাসায়নিক সার, চায়না ক্লে, কাঠ, টিম্বার, চুনাপাথর, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদাসহ ১৯ ধরনের পণ্য আমদানি করা হবে।
আর রপ্তানি করা যাবে সব ধরনের পণ্য।
বর্তমানে চলমান রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অন্যান্য মেগা প্রকল্পের কাজে ভারতীয় পাথরের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রাপ্ত পাথর বর্তমান চাহিদার পাঁচ শতাংশও যোগান দিতে পারছে না।
এদিকে, ইউএই, ভিয়েতনাম, ওমান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভারত থেকে পাথর আমদানি করতে প্রতি মেট্রিক টন প্রায় ২০ মার্কিন ডলার খরচ হয়।
এর মধ্যে শুধু ভারত থেকে স্থল বন্দর দিয়ে পাথর আমদানি করতে খরচ হয় ১৩ ডলার।
তাই চাহিদা মতো পাথর আমদানি করা যায় না। এজন্য অন্যান্য দেশ থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পাথর আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে।
ভারতের সবচেয়ে বড় পাথরের উৎস পাকুড়, ঝাড়খণ্ড, নলহাটি, রাজগ্রাম এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য পাথরের উৎস থেকে বাংলাদেশের স্থল বন্দরের দূরত্ব অনেক বেশি।
সেক্ষেত্রে নতুন চালু হওয়া এই রুট মায়া, ভারত থেকে গোদাগাড়ি, সুলতানগঞ্জের দূরত্ব নৌ পথে মাত্র ২০ কি.মি.।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ সড়ক পথে খরচ বরাবরই বেশি, নদীপথ সবসময়ই সাশ্রয়ী। শুধুমাত্র এই পাথর নদীপথে আমদানি করলে খরচ ১৩ ডলার থেকে ৯ – ১০ ডলারে নেমে আসবে”।
“ভারত – বাংলাদেশ দুই দেশেরই এই বিষয়ে ইন্টারেস্ট রয়েছে। ভারত থেকে যেসব জিনিস আমদানি করা হয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি আনে। ফলে খরচ ও বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনায় দুই দেশের জন্যই এটি গুরুত্বপূর্ণ” জানান মি. মোস্তফা।
বাংলাদেশ – ভারত অভ্যন্তরীণ নৌ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় গত বছর ৪৮ লাখ মেট্রিক টনের বাণিজ্য হয়। পাঁচ বছরে এটি দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন মি. মোস্তফা।
ভারতের সুবিধা হচ্ছে যে, এর ফলে তাদের রপ্তানি আরও বাড়বে।
কখন বন্ধ হয় এই নৌ রুট
স্বাধীনতার আগে রাজশাহী থেকে নৌপথে ভারতে পণ্য আনা – নেয়া করা হতো।
ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদীঘি থানার মায়া এলাকা থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার সুলতানগঞ্জ পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা হতো।
সে সময় বাংলাদেশ থেকে পাট ও মাছ পাঠানো হতো। ভারত থেকে নানাবিধ পণ্য আসতো।
১৯৬৫ সালে ভারত – পাকিস্তান যুদ্ধের আগে পর্যন্ত সুলতানগঞ্জ – মায়া ও গোদাগাড়ি ভারতের লালগোলা নৌ ঘাটের মাধ্যমে নৌপথে বানিজ্য কার্যক্রম চালু ছিল।
সে সময় হযরত সুলতান শাহের মাজারের পাশে বন্দরটি চালু ছিলো।
যুদ্ধের সময় এ নৌ পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই থেকে ৫৯ বছর বন্ধ ছিলো এই নৌ পথ।
বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের পহেলা মার্চ থেকে ১০ই মে পর্যন্ত মাত্র আড়াই মাসে চট্টগ্রাম ও অন্যান্য সমুদ্র বন্দর দিয়ে প্রায় ৩৫ লাখ মেট্রিক টন পাথর আমদানি করা হয়েছে। যার দাম প্রায় সাত কোটি মার্কিন ডলার।
বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান মি. মোস্তফা জানান, ‘এই রুটে পাথর আমদানি করা হলে এই ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসবে ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ কমবে’।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নৌ পথ চালু হলেও এর পুরোপুরি সুবিধা পেতে আরও সময় লাগবে।
রাজশাহীর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই বন্দর চালুর ফলে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় হবে। তবে, এই সুফল তখনই ভোগ করবো যখন এই পোর্ট কেন্দ্রিক অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হবে”।
এছাড়া মেইন রোডের সাথে পোর্টের সংযোগ সড়ক প্রশস্ত করা, সংলগ্ন কালভার্ট মেরামত না করলে সুফল সেভাবে পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
একইসাথে সুলতানগঞ্জের পোর্টকে শহরমুখী করার জন্য একটা প্রস্তাবনা পাস হয়েছে জানিয়ে মি. রহমান বলেন, “এটা কার্যকরী হলে এই অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্য আরো বৃদ্ধি পাবে”।
স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার আলি হিমু বিবিসি বাংলাকে জানান এ পোর্টকে কার্যকর করতে হলে আগে অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি।
তিনি বলেন, “মূলত ভারত থেকে পাথর আসবে এ বন্দর দিয়ে। আজ ও এসেছে। কিন্তু নামাবে কোথায়? চরে একদিন নামাতে পারবে, প্রতিদিন পারবে না। অবকাঠামো এখনো তৈরি হয় নি”।
“তবে, রুট চালু হলো। এটা ব্যবহার উপযোগী করতে ইমিগ্রেশন বসাতে হবে। অবকাঠামো তৈরি করে পুরোপুরি কার্যকর করলে বেনিফিট পাওয়া যাবে”।
সোমবার চালুর পর প্রথম দিনেই বাংলাদেশ থেকে ‘ সাইফ – সিয়াম – সাফি- ১’ নামে একটি কার্গো সাড়ে ১১ মেট্রিক টন গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় নিয়ে সুলতানগঞ্জ থেকে মায়াতে যায়।
এছাড়া মায়া থেকে ১০০ মেট্রিক টন পাথর নিয়ে ‘দেশবাংলা’ নামে একটি কার্গো সুলতানগঞ্জ এসে পৌঁছেছে।
বর্তমানে ভারত – বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে মোট আটটি টি নৌ পথ রয়েছে। নতুন এই নৌ পথসহ এর মধ্যে চালু রয়েছে আটটা পথ। তবে এর মধ্যে দুইটি রুটে নৌ যান চলাচল একেবারেই কম।
দাউদকান্দি-সোনামুড়া নৌপথে দুটি নৌপথ চালুর কথা থাকলেও কবে হবে, তা নিশ্চিত নন কর্মকর্তারা।