বাংলাদেশে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি এবং একে ঘিরে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তার কারণে প্রবল সংকটের মুখে পড়েছে দেশটির শিক্ষা খাত।
বেশির ভাগ অভিভাবক নাশকতার আশঙ্কায় সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে চাইছেন না।
অন্যদিকে শিক্ষকরা একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন তেমনি চলমান সংকটের মধ্যে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সময় মতো ক্লাস পরীক্ষা শেষ করার চাপের মধ্যে আছেন।
ফলে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস যেমন মিস যাচ্ছে, তেমনি ব্যাহত হচ্ছে বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতিও।
যেখানে কোভিড মহামারির কারণে আগে থেকেই শিখন ঘাটতি রয়ে গিয়েছে, সেখানে নতুন করে বিশেষ করে বছরের শেষে এসে শিক্ষায় এমন ক্ষতি অপূরণীয় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
তাদের মতে এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি শিক্ষাবান্ধব নয়।
কিছু বেসরকারি স্কুল অনলাইনে পাঠদান শুরু করলেও সেটা শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পরিপূর্ণভাবে পূরণ করতে পারবে না বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম
বেসরকারি কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সরকারিভাবে হরতাল ও অবরোধের সময় স্কুল-কলেজ বন্ধের কোনো নির্দেশনা নেই।
এ কারণে সরকারি স্কুল কলেজগুলোকে বাধ্য হয়ে নির্ধারিত সময়ে ক্লাস ও পরীক্ষা শেষ করতে হচ্ছে।
কিন্তু গত প্রায় এক মাস ধরে টানা কর্মসূচি চলায় এবং বেশ কয়েকটি বাসে অগ্নি সংযোগের ঘটনায় সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে বেশ উদ্বেগের মধ্যে আছেন অভিভাবকরা।
যাদের বাড়ি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি, তারা যেতে পারলেও। যাদের গণপরিবহণ বা ব্যক্তিগত যানবাহনে চড়তে হয়, তাদের বেশিরভাগই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
এ কারণে বেশির ভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে কমে গিয়েছে।
বিশেষ করে এইচএসসি প্রথম বর্ষে পুরোদমে ক্লাস শুরু হলেও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেশ কম।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে আসার বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
উদ্বেগে অভিভাবক, ছুটির দিনে পরীক্ষা
এর মধ্যে অনেক স্কুলেই এখন বার্ষিক পরীক্ষা এবং নতুন সিলেবাসের অধীনে পরীক্ষার বদলে বার্ষিক মূল্যায়নও চলছে। যা অবরোধের কারণে সংকটের মুখে পড়েছে।
যেসব স্কুলে সাপ্তাহিক দিনগুলোয় স্বাভাবিক নিয়মেই বার্ষিক পরীক্ষা চলছে, সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের ও অভিভাবকদের রাস্তায় অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা নিয়েও বাধ্য হয়েই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে হচ্ছে।
এ নিয়ে ঢাকার অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শ্রাবন্তী বিশ্বাস বেশ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানান, “যখন বলল পরীক্ষা শুরু হবে তখন থেকেই টেনশন, হরতাল-অবরোধের মধ্যে কীভাবে মেয়েকে স্কুলে আনবো? ক্লাস চললে আসতাম না, কিন্তু পরীক্ষা তো – আসাই লাগবে!”
“আমাকে ঢাকা মেডিকেলের সামনে দিয়ে প্রতিদিন আসতে হয়। ওখানে তো মাঝে মাঝেই ঝামেলা লাগে। কখন কে ঢিল দেয়, আগুন লাগায় বলা তো যায় না”, বলছিলেন তিনি।
প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বার্ষিক মূল্যায়ন ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর।
তবে চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বেশ কয়েকটি স্কুল নির্ধারিত পরীক্ষা-সূচি পরিবর্তন করে বাধ্য হয়ে ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার পরীক্ষা নিচ্ছে।
একারণে নির্দেশনা অনুসারে সময় অনুযায়ী পরীক্ষা শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না।
শিক্ষা কার্যক্রম ওলট পালট
চলমান অস্থিরতার মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্কুলগুলোকে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পাঠদান শেষ করতে পারছেন না।
নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস শেষ করা নিয়ে শঙ্কায় আছেন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা।
এ নিয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বিবিসিকে জানান, “একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ক্লাসের মধ্যেই এই কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এজন্য আমরা তাদের সিলেবাস শেষ করতে পারিনি।”
“স্কুলগুলোয় ছুটির দিনে পরীক্ষা নিতে হয়েছে। একজন শিক্ষার্থী যদি কোনও দুর্ঘটনার শিকার হয় সেটার দায় দায়িত্ব কে নেবে? শিক্ষকদের এমন অনিশ্চয়তায় মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে।”
এ অবস্থায় তিনি রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তারা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে সুস্থ ধারার রাজনীতি করেন।
হরতাল অবরোধ হলেও কোথাও যেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় যাতে শিক্ষার্থীদের বিপদের মুখে পড়ে।
একই পরিস্থিতি ঢাকার বাইরের জেলা সদরের স্কুলগুলোতেও।
এ নিয়ে ময়মনসিংহ সদরের এসকেজি মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবিএম সিদ্দিক বলেন, “কোভিডের সময় আমাদের যে ক্ষতিটা হয়েছিল সেটা কাটিয়ে উঠতে আমরা চেষ্টা করছিলাম।”
“কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা প্রচণ্ডভাবে বিঘ্ন ঘটেছে। আমরা সরকারি নির্দেশমতো ক্লাস পরীক্ষা শেষ করতে পারছি না।”
এক্ষেত্রে দ্রুত রাজনৈতিক অস্থিরতার উত্তরণ দাবি করেন তিনি।
ঝুঁকিতে মূল সড়কের পাশের স্কুল
এদিকে চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় যেসব বেসরকারি স্কুল তাদের পাঠদান বন্ধ রেখেছিলেন তারা সময় মতো সিলেবাস শেষ করতে না পারায় পরীক্ষা পিছিয়ে গিয়েছে।
এখনও রাজনৈতিক কর্মসূচি চলমান থাকায় এই পরীক্ষাগুলো নিরাপদে নেয়া যাবে কিনা সেটা নিয়ে শঙ্কায় আছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
এ নিয়ে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন, স্কুল ও কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, “আমরা ভেবেছিলাম কর্মসূচি সাময়িক। এখন দেখি এক মাস হয়ে গেল।”
“বাচ্চারা ক্লাসে আসছে না। অনেকে ভয়ে পরীক্ষা দিতেও আসছে না। যারা আসছে তারাও প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এজন্য আমরা শুক্র শনিবার পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কোভিডের সংকটই আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি, এর মধ্যে আবার এই ক্ষতি!”
তার মতে, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে মূল সড়ক সংলগ্ন স্কুলগুলো। ওইসব স্কুলের বেশির ভাগই ছুটির দিনে ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন।
এ নিয়ে মি. চৌধুরী জানান, “যেসব স্কুল আবাসিক এলাকায় রয়েছে, সেগুলোতে আমরা অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করার চেষ্টা করছি। কিন্তু যে স্কুলগুলো রাস্তার পাশে এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সেখানে অভিভাবকরা কোনভাবেই শিক্ষার্থীদের পাঠাতে আগ্রহী নন।”
অনলাইন ক্লাসে ফিরেছে ইংরেজি মাধ্যম
অন্য দিকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর বেশির ভাগ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শ্রেণীকক্ষে পাঠদান বন্ধ করে অনলাইন ক্লাসে ফিরে গেছে।
কিন্তু অনলাইনে যে পাঠদান করা হয়, তা শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। আবার অনেক শিশু শিক্ষার্থী এতে ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
তাদের মতে, বড় ক্লাসের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে কিছুটা উপকৃত হলেও শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস কখনও সশরীরে ক্লাসের বিকল্প হতে পারে না।
এ নিয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এসোসিয়েশনের সভাপতি রাজি তাইফ সাদাত বলেন, “ক্লাস ওয়ান, টুতে যে বাচ্চা পড়ে তার পক্ষে অনলাইন ক্লাসে মনোযোগ রাখা সম্ভব না।”
“প্রথমত এই ডিভাইসগুলো বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। তারা কোভিডের সময়ের মতো আবার ডিভাইসে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। স্কুলে যে ডিসিপ্লিনটা থাকতো, সেটা থাকছে না। আবার অনেক কর্মজীবী মা-বাবার পক্ষে সম্ভব নয় অনলাইন ক্লাসে বাচ্চার পাশে থাকা।”
অনলাইন সশরীরে শিক্ষার বিকল্প নয়
নির্বাচন উপলক্ষে ডিসেম্বর মাসও বেশ ঘটনাবহুল হবে আন্দাজ করা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাবিদদের শঙ্কা রয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘ হলে কোভিডকালীনের সময়ের মতো পুনরায় বড় ধরনের শিখন ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
যেসব স্কুল ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইনে ক্লাস করছেন তাদের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি এই উপায়ে পরিপূর্ণভাবে পূরণ সম্ভব নয় বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক মরিয়ম বেগমের মতে, অনলাইন শিক্ষা সশরীরে শিক্ষার বিকল্প কিছুতেই হতে পারে না।
এ অবস্থায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের বহনকারী যানবাহনগুলো এই কর্মসূচির আওতামুক্ত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, “এই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশে এখন শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নেই। অনলাইন ক্লাস খুব একটা কার্যকর হয় না।”
“আবার আমরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আসার ব্যাপারে চাপও দিতে পারি না, যেহেতু নিরাপত্তা প্রশ্ন আছে।”
তার মতে, এখন পুনরায় যে শিখন ঘাটতি হচ্ছে সেটা পূরণ করা কঠিন। তাই হরতাল অবরোধ যাই হোক রাস্তায় যান চলাচল যদি ব্যহত করা না হয় তাহলে অন্তত সবাই স্বস্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে পারে।