বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অঙ্গ, সহযোগী কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে শ্রমিক সংগঠন থাকলেও তারা শ্রমিকদের কল্যাণে কতটা কাজ করে সেটি নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগ এবং বিএনপির সহযোগী জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দলেরও নানা শ্রমিক সংগঠন আছে।
বিভিন্ন সময় শ্রমিকরা যখন নানা দাবি উত্থাপন করে সেগুলো মীমাংসার জন্য সরকার যে কমিটি গঠন করে সেখানে ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের যুক্ত করে। এতে করে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব শ্রমিকদের ওপর বজায় থাকে।
শ্রমিকদের সাথে বিভিন্ন দরকষাকষিতে সাধারণত ভিন্ন কোনো রাজৈনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব দেখা যায় না।
শ্রমিকদের দাবি যদি সরকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তখন সরকারি দল চায় না যে তাদের শ্রমিক সংগঠন সেসব দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসুক।
শ্রমিক সংগঠনগুলো কী করে?
বাংলাদেশে শ্রমিক রাজনীতির ধরন পরিবর্তিত হতে থাকে ১৯৯০ সালের পর থেকে। ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত সংকুচিত হয়ে বেসরকারি খাত যত বিস্তৃত হতে থাকে শ্রমিক আন্দোলনেও পরিবর্তন আসতে থাকে।
দেশের অর্থনৈতিক ধারা পরিবর্তনের সাথে সাথে শ্রমিক আন্দোলনও পাল্টে যেতে থাকে। ১৯৯০ সালের পর থেকে বিভিন্ন সেক্টর বা খাত ভিত্তিক শ্রমিকদের তৎপরতা দেখা যায়। যেমন গার্মেন্টস শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, পাটকল শ্রমিক। তাদের কেন্দ্রীয় একক কোনো সংগঠন নেই।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান একসময় দলটির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের শীর্ষ নেতা ছিলেন। তিনি নিজেও বহু বছর যাবৎ শ্রমিক আন্দোলনের সাথে জড়িত।
মি. খান বিবিসি বাংলাকে বলেন , জাতীয় শ্রমিক সংগঠনগুলোর দরকষাকষির ক্ষমতা তেমন একটা নেই। শ্রমিকদের দাবি নিয়ে আইনানুগ কাজ করার ক্ষমতা হচ্ছে কারখানা বা ইউনিট পর্যায়ের ট্রেড ইউনিয়নের।
“দেশের আইন অনুযায়ী তারা দাবি উত্থাপন করতে পারে, দরকষাকষি করতে পারে এবং চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে,” বলেন মি. খান।
রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিক সংগঠনগুলোর সে ক্ষমতা নেই। যদিও দেখা যায়, যে কোনো দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারি দলের শ্রমিক সংগঠনের প্রভাব বেশি থাকে।
কারখানা-ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়নের ওপর তাদের প্রভাব থাকে। অথবা কারাখানা-ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা কোনো না কোনোভাবে বড় রাজনৈতিক দলের শ্রমিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।
নব্বই’র দশেকে শ্রমিকদের দাবি আদায় এবং রাজনৈতিক দলের সাথে সংহতি জানানোর জন্য শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ গড়ে ওঠে। এর সাথে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শ্রমিক সংগঠনের সম্পৃক্ততা ছিল। সেটি এখন আর নেই।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, বড় দলগুলোর মধ্যে সাংঘর্ষিক রাজনীতি এবং বৈরি পরিবেশ সৃষ্টি হবার কারণে সেটি শ্রমিক আন্দোলনের ওপরও প্রভাব পড়েছে।
“এজন্য তারা শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার চাইতে রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে বেশি মবিলাইজ করছে,” বলেন মি. লেনিন।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিক সংগঠনগুলো চাইলেও শ্রমিকদের রাজনৈতিক ইস্যুতে মবিলাইজ করতে পারছে না।
“শ্রমিকরা তাদের নিজস্ব দাবি-দাওয়া নিয়ে যতটা আগ্রহী হয়, রাজনৈতিক দাবি নিয়ে তারা ও রকম হয় না।”
নব্বই এর দশক এবং বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। শেখ হাসিনার সরকার শ্রমিক শ্রেণির কিছু দাবি পূরণ করেছেন। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে আগের মতো শাসকদের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নেই।
১৯৭০-৮০’র দশকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক ধর্মঘটে জনজীবন স্থবির হয়ে যেত ।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিক সংগঠনগুলো শুধু তাদের পরামর্শ দিতে পারে। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ঐ দলের নীতিগত সমর্থক যারা আছেন তাদেরকে সংগঠিত করার জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রমিক সংগঠন থাকে।
“রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিটি যতখানি গুরুত্ব পায় শ্রমিক আন্দোলন বা শ্রমিক সংগঠনের কাজ ততটা গুরুত্ব দিয়ে চলে না। ফলে ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যতটা করে, শ্রমিকদের কাজ ততটা হয়ে ওঠে না,” বলেন নজরুল ইসলাম খান।
“সব রাজনৈতিক দলের ঘোষিত আদর্শ তো হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ করা , তাদের সমস্যার সমাধান করা।”
শ্রমিক নেতারা বলছেন, সারা দুনিয়াতে শ্রমিক আন্দোলন একটা দুঃসময় পার করছে। বাংলাদেশে সেটা আরো বেশি। গত চার দশকে সরকারি খাতের শিল্প যত কমেছে বেসরকারি খাতের ভূমিকা তত বেড়েছে।
বেসরকারি খাত চলে আসার পরেও সেখানে শ্রমিকদের নিজেদের মতো করে সংগঠন করা বা সংগঠনের মাধ্যমে অধিকার জানানো- সেটি না হওয়ার কারণে প্রায়শই তাদের রাস্তায় গিয়ে আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে হয়
অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণও আছে বলে তিনি মনে করেন।
দুর্বল হয়েছে শ্রমিক আন্দোলন
১৯৮০’র দশকে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপ নামের একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল। মূলত সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে সেটি গড়ে উঠেছিল।
শ্রমিক নেতারা বলেছেন, ৯০’র দশকে শ্রমিক সংগঠনগুলো ভেবেছিল সামরিক শাসকের বিদায় না হলে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। সেজন্য স্কপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আন্দোলন জোরদার করা হয়েছিল
এই সংগঠনটি এখনও কাগজে কলমে বিদ্যমান। কিন্তু এটির কোনো তৎপরতা বা ভূমিকা দেখা যায় না।
আশির দশক পর্যন্ত পাট এবং বস্ত্রকল শ্রমিকরা সরকারের উপর চাপ তৈরি করতে পারলেও এখন আর সেটি নেই। এখন সেটি চলে গেছে ভিন্ন সেক্টরে।
গার্মেন্টস এবং পরিবহন শ্রমিকরাই এখন সবচেয়ে বড় প্রভাব তৈরি করে।
“প্রাইভেট সেক্টর যত বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিক আন্দোলন তত দুর্বল হয়েছে। কিন্তু, এই বিষয়টি উল্টো হওয়ার কথা ছিল,” বলেন নজরুল ইসলাম খান।
শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলস। প্রতিষ্ঠানটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, শ্রমিক আন্দোলন একটি রূপান্তরের ভেতর দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
শ্রমিক আন্দোলন যখন শক্তিশালী ছিল তখন বড় রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী সংগঠনগুলো শ্রমিকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকতো।
“এখন শ্রমিকদের স্বার্থের কাজের চাইতে দলীয় কাজের সম্পৃক্ততা বেশি দেখা যায়,” বলেন সুলতান উদ্দিন আহমেদ।
“বড় সংগঠনের ট্রেড ইউনিয়নগুলো যে একেবারে শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে বিষয়টি সে রকম নয়। তবে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় তারা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সক্রিয় না,” বলছিলেন সুলতান উদ্দিন আহমেদ।
শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে নানা সময় সোচ্চার দেখা যায় বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলোকে।
জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন নেতা ও ওয়ার্কার্স পাটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আমিরুল হক আমিন বলেন, “যেসব শ্রমিক সংগঠন বড় রাজনৈতিক দলের সরাসরি অঙ্গসংগঠন তারা শ্রমিকদের জন্য ভূমিকা রাখতে পারতেছে বলে আমার মনে হয় না। সাংগঠনিকভাবে তাদের শক্তি হয়তো অন্যদের চেয়ে বেশি। কিন্তু সেটা শ্রমিকদের কল্যাণে তেমন কোনো কাজে আসতেছে না।”
“রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প যত বেশি বেসরকারি খাতে চলে যাচ্ছে ততই আমাদের শ্রমিক আন্দোলন কোনো না কোনোভাবে দুর্বল হচ্ছে এবং আমাদের গতি কমতেছে।”
ইপিজেড এবং স্পেশাল ইকনমিক জোনের কারণেও শ্রমিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসছে। এসব জায়গায় শ্রমিকদের দরকষাকষির সুযোগ নেই।