ভারতের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২০২৩। আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন, জি-২০ সম্মেলনে মোদী সরকারের ‘গ্লোবাল সাউথ’- এর কন্ঠস্বর হয়ে ওঠার চেষ্টা যেমন রাজনৈতিক ভাবে উল্লেখযোগ্য, তেমনই ঘটেছে, মণিপুরে সহিংসতা, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কুস্তিগীরদের প্রতিবাদের ঘটনাও।
এই বছর ভারত চন্দ্রাভিযানে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে।
আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের পর ভারত চতুর্থ দেশ যারা চাঁদের মাটি ছুঁয়েছে।
অন্যদিকে, ওডিশার বালেশ্বরের কাছে মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনাও স্তব্ধ করেছিল মানুষকে।
বিবিসি বাংলায় ভারতের তেমনই কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হল:
যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে রাস্তায় ভারতীয় কুস্তিগীররা
বছরের শুরু, মাঝামাঝি সময়ে আর একেবারে শেষে – তিন বার আলোচনায় উঠে এসেছে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভারতের অলিম্পিকস পদক জয়ী সহ তারকা কুস্তিগীরদের প্রতিবাদের ঘটনাগুলি।
বিজেপি নেতা ও ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে নারী কুস্তিগীরদের ওপরে যৌন নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ তোলা হয়েছিল জানুয়ারি মাসে।
দিল্লির রাস্তায় ধর্নায় বসেন ভারতের অলিম্পিক পদক-জয়ী কুস্তিগীর বজরং পুনিয়া, কমনওয়েলথ গেমসে তিনবারের স্বর্ণপদক-জয়ী ভিনেশ ফোগত, রিও অলিম্পিকসে ব্রোঞ্জ পাওয়া সাক্ষী মালিকের মতো তারকা কুস্তিগীর।
কুস্তী ফেডারেশনের প্রধান মি. সিং অবশ্য তখন সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।
দ্বিতীয়বার এই একই ইস্যুতে মে মাসে ধর্নায় বসেছিলেন কুস্তিগীররা। কিন্তু যেদিন ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধন হয়, সেদিনই ধর্নায় বসা কুস্তিগীরদের ব্যাপক বলপ্রয়োগ করে তুলে দেয় পুলিশ।
কুস্তিগীরদের যেভাবে মারধর করে তুলে দিয়েছিল পুলিশ, সেই ঘটনার নিন্দা জানায় এমনকি আন্তর্জাতিক অলিম্পিকস কমিটি এবং বিশ্ব কুস্তির নিয়ামক সংগঠন ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড রেসলিং।
অন্যদিকে মি. সিংয়ের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় হাজার পাতার চার্জশিট আদালতে পেশ করেছে পুলিশ।
বছর শেষে আবারও ওই কুস্তিগীরদের কথা উঠে এসেছে আলোচনায়। ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের নির্বাচনে সভাপতি পদে যিনি জয়ী হয়েছেন, সেই সঞ্জয় সিং আগের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়েরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
নতুন সভাপতির আমলেও কুস্তিগীরদের যৌন নিপীড়ন থামবে না, এই আশঙ্কা জানিয়ে অলিম্পিকস পদক জয়ী কুস্তিগীর সাক্ষী মালিক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে তিনি আর কুস্তিই লড়বেন না।
রাম নবমীকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা
রাম নবমী অর্থাৎ হিন্দুদের ভগবান রামচন্দ্রের জন্মদিবস পালন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের একাংশের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই ছোট বড় সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে।
রামনবমীকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে আসানসোল রাণীগঞ্জ এলাকায় বড় সড় দাঙ্গা বেঁধেছিল, আর এ বছর ৩০শে মার্চ ওই উৎসব পালনের দিন হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ বাঁধে কলকাতা লাগোয়া শহর হাওড়া এবং পার্শ্ববর্তী জেলা হুগলীর রিষড়ায়।
হাওড়ায় সংঘর্ষ চলে দুদিন, কিন্তু রিষড়ায় এক সপ্তাহ ধরে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। কারও মৃত্যু না হলেও প্রচুর গাড়ি, দোকানে ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়, আবাসিক ভবনে পাথর ছোঁড়া হয়।
রাজ্যের হিন্দিভাষী এলাকাগুলোতে রাম নবমী বহু বছর ধরেই পালিত হয়, কিন্তু বছর দশেক ধরে তা অন্যান্য অঞ্চলেও শুরু হয়েছে।
এই মিছিলগুলি থেকে অস্ত্র প্রদর্শন এবং সরাসরি মুসলমান বিরোধী গান ও স্লোগান দেওয়া হয়েছে। আবার মুসলমান সম্প্রদায়ও যে পাথর ছুঁড়ে ভাঙচুর চালিয়েছে, সেটাও দেখা গেছে।
বিজেপি সরাসরি এবছরের রাম নবমীর মিছিল আয়োজন না করলেও হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠনগুলি এইসব আয়োজন করেছিল, আবার এবছর ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও পাল্টা রামনবমীর মিছিল করেছে।
মণিপুরে সহিংসতা
মে মাসের তিন তারিখ থেকে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে শুরু হয় জাতিগত সংঘর্ষ, যার জের বছর শেষেও শেষ হয় নি।
ওই সংঘর্ষে অন্তত ১৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে, ভিটে হারা হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সংঘর্ষের চলাকালীন নারীদের গণধর্ষণ করে হত্যার ঘটনাও হয়েছে, যা মণিপুরের মতো রাজ্যে, যেখানে নারীরা অত্যন্ত সম্মানিত, সেখানে খুবই বিরল।
বিজেপি শাসিত এই রাজ্যের সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়কে তপশীলি উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে সরকার, আদালত এরকম একটি নির্দেশ দেওয়ার পরেই সংঘর্ষ শুরু হয়।
মেইতেইরা হিন্দু সংখ্যাগুরু আর কুকি জনজাতি সংখ্যালঘু এবং মূলত খ্রিষ্টান।
কুকিদের বক্তব্য ছিল মেইতেইরা ইতিমধ্যেই রাজনীতি বা সরকারি কাজে সবথেকে বেশি নিয়োজিত, তাদের তপশীলি উপজাতির তকমা দেওয়া হলে সংরক্ষণের সুবিধা পাবে তারা। এমনকি কুকিরা যে পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করেন, সেখানকার জমিও দখল করে নিতে পারেন মেইতেইরা।
সংঘর্ষ শুরুর সময়েই পুলিশের অস্ত্র লুঠ হয় বিপুল সংখ্যায়। একে অপরের বাড়িঘর, গাড়ি, এমনকি গ্রামও জ্বালিয়ে দিতে থাকেন। সংঘর্ষ শুরুর দিন কয়েকের মধ্যেই সেনাবাহিনী নামাতে হয়, দীর্ঘদিন ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি এমনই হয়ে যায় যে মেইতেই অধ্যুষিত অঞ্চল – রাজধানী ইম্ফল লাগোয়া এলাকা আর কুকি অধ্যুষিত পাহাড়ি এলাকার মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা তৈরি হয়ে যায়। একে অপরের এলাকায় প্রবেশ করেন না সংঘর্ষ শুরু হওয়ার সাত মাস পরেও।
সশস্ত্র চেকপোস্ট গড়েছে দুই সম্প্রদায়ই। মাঝামাঝি এলাকায় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
ওডিশায় ট্রেন দুর্ঘটনা
ভারতে, এই শতাব্দীর সবথেকে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনাটি ঘটে এ বছরের দোসরা জুন, ওডিশা রাজ্যের বালেশ্বরের কাছে। ওই ঘটনায় প্রায় আড়াইশোরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, আহত হন প্রায় নয়শো যাত্রী।
কলকাতার দিক থেকে দক্ষিণ ভারত অভিমুখী একটি যাত্রীবাহী ট্রেন ওডিশার বাহানাগা বাজার স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালগাড়ীতে ধাক্কা মারে।
যাত্রীবাহী ট্রেনটির অনেক কামরা দুমড়ে মুচড়ে মালগাড়ীর ওপরে উঠে গিয়েছিল। আবার ওই যাত্রীবাহী ট্রেনটির কিছু বগি পাশের লাইনে ছিটকিয়ে থেকে পড়লে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি যাত্রীবাহী ট্রেনের কিছু কামরার সঙ্গে ধাক্কা লাগে।
বহু মৃতদেহ এতটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে তা শনাক্ত করাই অসম্ভব ছিল। আবার একই দেহকে একাধিক পরিবার দাবী করছে সঠিকভাবে চিনতে না পেরে, এমন ঘটনাও সামনে এসেছে।
শনাক্ত না হওয়া দেহগুলির ডিএনএ পরীক্ষা করিয়ে ভারতের নাগরিক পরিচয়পত্র আধার-কার্ডের তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে মিলিয়ে কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছিল।
দুর্ঘটনার পরে হাসপাতালগুলি আর যেখানে মৃতদেহগুলি সংরক্ষণ করা হচ্ছিল, সেখানে আত্মীয় স্বজনদের উৎকণ্ঠা, দেহ শনাক্ত করার পরে সন্তানের ভেঙ্গে পড়া বা সন্তানের খোঁজে অভিভাবকের ছুটে বেড়ানোর দৃশ্য – এসবই দীর্ঘকাল মনে থেকে যাবে মানুষের।
বাংলাদেশি নাগরিকরা, যারা দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসা করাতে যান, তাদের কাছে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনই জনপ্রিয়। দুর্ঘটনার পরে প্রথম কয়েকদিন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক নিখোঁজ ছিলেন, যদিও পরে সবার খোঁজ পাওয়া যায়।
দুর্ঘটনার পরে রেল যেমন নিজস্ব তদন্ত শুরু করেছিল, তেমনই অন্তর্ঘাত হয়েছে কী না, সেই খোঁজে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইকেও তদন্ত করতে দেয় সরকার। মনুষ্যজনিত সিগনালিং ব্যবস্থায় গুরুতর গলদ ধরা পড়েছিল। গ্রেপ্তারও হন রেলের কয়েকজন স্থানীয় কর্মচারী।
পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা
পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, যার আনুষ্ঠানিক নাম ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, তার ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে এবছর জুন-জুলাই মাসে অন্তত ২২ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ভোটগ্রহণের দিন, আটই জুলাই তারিখেই মারা যান ১১ জন।
সবথেকে বেশি সহিংসতার ঘটনা সামনে আসে কোচবিহার, মুর্শিদাবাদ, মালদা, পূর্ব বর্ধমান থেকে। এছাড়াও নদীয়া, বীরভূম, দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও সহিংসতা হয়েছিল।
রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করেছে যে নিহতদের বেশিরভাগই তাদের দলের কর্মী। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি, কংগ্রেস আর সিপিআইএম কর্মী-সমর্থকদের নামও সহিংসতায় নিহতের তালিকায় উঠে এসেছে।
রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা, বোমাবাজি, বুথ দখল হয়ে যাওয়া বা ছাপ্পা ভোট দেওয়ার খবরের মধ্যেই এবারের ভোটে একেবারেই নতুন ঘটনা দেখা গেছে নানা জায়গায়, যেখানে আস্ত ব্যালট বাক্স উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া বা পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
নানা জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী-দলীয় কর্মীদের জোটবদ্ধ প্রতিরোধ-এর মুখে পড়ে মারও খেয়েছে।
পঞ্চায়েত ভোটে প্রতিবারই সহিংসতা হয় পশ্চিমবঙ্গে।
বিশ্লেষকরা বলেন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমেই যেহেতু গ্রামোন্নয়নের সিংহভাগ অর্থ খরচ হয়, তাই দুর্নীতির ব্যাপক সুযোগ থাকে এখানে। সেই লোভেই সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে জিততে চান প্রার্থীরা, এমনটাই অভিযোগ।
কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দন্দ্ব
এ বছর ১৮ই জুন আততায়ীদের গুলিতে কানাডার শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের মৃত্যু হয়। কানাডার হাউজ অব কমন্সের সভায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ করেন খুনের ঘটনায় ‘ভারতীয় এজেন্টদের যোগ রয়েছে’।
তাঁর অভিযোগ নস্যাৎ করে ভারত পাল্টা অভিযোগ করে, কানাডায় জঙ্গিদের প্রশয় দেওয়া হচ্ছে নিষিদ্ধ খালিস্তানি সংঠনের সদস্যদের নাগরিকত্ব দেওয়ার মাধ্যমে। ক্রমশ এই ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে ভারত-কানাডার সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে এবং কূটনৈতিক দ্বন্দ্বও তৈরি হয়।
অন্যদিকে মি নিজ্জারের হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত খালিস্তানপন্থী এক শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নু কানাডার বসবাসকারী হিন্দুদের হুঁশিয়ারি ও ভারতে নাশকতার হুমকি দেন।
পরে, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল দপ্তর সে দেশের নাগরিক ও শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে। ওই ষড়যন্ত্রে নিখিল গুপ্তা নামে এক ভারতীয়কে গ্রেপ্তারও করা হয়।
দায়ের করা অভিজগপত্রে একই সঙ্গে বিস্তারিতভাবে জানানো হয়েছিল কীভাবে ভারতের এক সরকারী কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন।
ভারতীয় দূতাবাসের এক আধিকারিকের নামও জড়ায় এই ঘটনায়। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর নিউ ইয়র্কের সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট আদালতে যে ১৫ পাতার অভিযোগপত্র দায়ের করেছে, সেখানে ওই ভারতীয় অফিসারকে ‘সিসি-১’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারত এই অভিযোগের তীব্র বিরোধীতা করে। এরপর এফবিআই-এর ডিরেক্টর ক্রিস্টোফার রে ভারতে এসে সিবিআই প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন, সেখানে মূলত দুই দেশের নিরাপত্তা বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা হলেও, মার্কিন প্রশাসনের তোলা অভিযোগের পর এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হয়।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রসঙ্গে একটি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি এ বিষয়ে কোনও তথ্য দেয় তবে তা খতিয়ে দেখা হবে। একইসঙ্গে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুইদেশের সম্পর্কের অবনতির সম্ভাবনার কথাও উডিয়ে দেন তিনি।
অন্যদিকে জাস্টিন ট্রুডো সিবিএসকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তোলা অভিযোগের পর বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানিদের হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে ভারত আর সুর চড়াতে পারবে না।
উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে আটক ৪১জন কর্মীকে উদ্ধার
উত্তারাখণ্ডের জেলার ব্রহ্মতাল-যমু্নেত্রী জাতীয় সড়কের উপর নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গের একাংশ ধসে পড়ে ১২ই নভেম্বর ভোরে। সিল্কিয়ারা এবং ডন্ডালহগাঁওয়ের মধ্যে ওই নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গে সে সময়ে কাজে ব্যস্ত ছিলেন উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও অসমের ৪১জন কর্মী।
ঘটনার খবর কোনওমতে বাইরে পৌঁছানোর পর থেকেই যুদ্ধকালীন তৎপরতাতে উদ্ধারের চেষ্টা চলতে থাকে রাজ্য সরকারের তরফে এবং একে একে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাহায্যের হাত এগিয়ে আসে। শুরু হয় ‘অপারেশন জিন্দেগি’।
ভেতরে আটকে থাকা কর্মীদের জন্য বাইরে থেকে খাবার, পানীয় জল ও ওষুধ পাঠানো হয়। ব্যবস্থা করা হয় শুরু হয় পাইপ দিয়ে অক্সিজেন সরবারহেরও।
একে একে জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা বাহিনী, রাজ্য দুর্যোগ মোকাবেলা বাহিনী, উত্তরাখণ্ড পুলিশ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার্স কোরের প্রকৌশলী এবং বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশনের প্রকল্প শিবালিক সহ বেশ কয়েকটি সরকারী সংস্থা উদ্ধারকার্যে সামিল হয়।
নিয়ে আসা হয় অস্ট্রেলিয়ান টানেলিং বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিক্স এবং ক্রিস কুপারের মতো বিশেষজ্ঞদেরও। বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও উদ্ধারকার্যে বিভিন্ন কারণে বাধা আসে। প্রথমে চেষ্টা করা হচ্ছিল ভূমি ধসের ফলে সুড়ঙ্গের ভেতরে জমা মাটি-পাথর জমা সরিয়ে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনোর। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরে ধস নামে। তাই সেই পদ্ধতি বাতিল হয়।
পরে মাটি কাটার যন্ত্র দিয়ে ধ্বংসাবশেষের ভেতরে গর্ত খোঁড়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু সেটাও খারাপ হয়ে যায়। এরই মধ্যে কিন্তু আটকে থাকা শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও তাঁদের মনোবল দৃঢ় রাখার ব্যবস্থা করা হয় বাইরে থেকে।
ভেতরে অবশ্য সেই কাজ করছিলেন গব্বর সিং নেগী যিনি অন্যান্য কর্মীদের মনোবল ক্রমাগত বাড়াচ্ছিলেন।
এদিকে মাটি কাটার যন্ত্র এনে উদ্ধারের চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয় হাত দিয়ে মাটি কাটার। ১২ জন র্যাট হোল মাইনারদের নিয়ে আসা হয়, আবার গতি পায় উদ্ধারের কাজ।
র্যাট হোল মাইনারদের মধ্যে প্রথম আটকে থাকা শ্রমিকদের কাছে পৌঁছন মুন্না কুরেশি। শেষপর্যন্ত, ১৭দিন টানা লড়াইয়ের পর ২৮ নভেম্বর উদ্ধার করা যায় ৪১জনকে।
জি ২০ সম্মেলন
এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে আয়োজিত জি ২০ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেছে ভারত। আফ্রিকান ইউনিয়ন যারা ৫৫টি আফ্রিকান দেশের প্রতিনিধিত্ব করে তাদের জি-২০-এর স্থায়ী সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ভারতের তরফে। মোদী সরকারের এই পদক্ষেপ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
জি ২০ সম্মেলনে অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্ত্ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আন্তর্জাতিক ঋণ মকুব এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর করদানের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
রাশিয়ার সরাসরি সমালোচনা না করেই জি-২০ সদস্যদের এক যৌথ ঘোষণায় ‘ইউক্রেনে সংঘাতের ফলে মানুষের দুর্ভোগ, বিশ্বের খাদ্য ভাণ্ডার ও জ্বালানির নিরাপত্তাতে ওই সংঘাতের বিরূপ প্রভাবের’ নিন্দা করা হয়েছে। উইক্রেন অবশ্য এতে খুশি হয়নি এবং স্পষ্ট জানিয়েছে ওই সম্মেলনে তাদের উপস্থিতি আরও ভাল করে সেখানকার ছবি তুলে ধরতে পারত।
শীর্ষ সম্মেলনের মাঝেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, সৌদি আরব এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রেলপথ এবং শিপিং রুটের একটি নতুন নেটওয়ার্ক ঘোষণা করেছে।
এটি দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। এটা চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-কে প্রতিহত করতে একটি পদক্ষেপও।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ এর নির্বাচনের আগে এটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে ভারতকে গ্লোবাল সাউথ-এর কন্ঠস্বর হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ ছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সেপ্টেম্বরে এই সম্মেলনের পর প্রধানমন্ত্রী নভেম্বর মাসে একটি জি-২০ সম্মেলনের প্রস্তাব দেন, উদ্দেশ্য ছিল সেপ্টেম্বরে জি২০-র পর যে সব সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলির বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা। এই সম্মেলনটি ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়।
চন্দ্রযান ৩
এ বছর চন্দ্রাভিযানে সাফল্যের শিরোপা উঠে এসেছে ভারতের মাথায়। আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনের পর ভারত চতুর্থ দেশ যেটি চাঁদের মাটি ছুঁয়েছে। ১৪ই জুলাই অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটা উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে চাঁদের দিকে রওনা দেয় চন্দ্রযান ৩।
একটি এলভিএম-৩ রকেট দিয়ে চাঁদের উদ্দেশ্যে চন্দ্রযানটিকে উৎক্ষেপণ করা হয় যাতে ছিল একটি ল্যাণ্ডার ও রোভার। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা বিক্রম সারাভাইয়ের নামে ল্যাণ্ডারটির নাম রাখা হয়েছে ‘বিক্রম’ আর রোভারটির নাম ‘প্রজ্ঞান’।
চাঁদে বিক্রমের সফট ল্যান্ডিং, চাঁদে রোভারের চলাচল এবং চন্দ্রপৃষ্ঠকে পর্যবেক্ষণ করা এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল।
ইসরোর প্রধান শ্রীধর পানিক্কর সোমনাথ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, রোভারে পাঁচটি যন্ত্র রয়েছে, যার মূল লক্ষ্য চন্দ্রপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক চরিত্র, সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলের বিশ্লেষণ করা, আর চন্দ্রপৃষ্ঠের ঠিক নীচে কী হচ্ছে, তা খুঁজে দেখা।
আনুমানিক ৬১৫ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি এই চন্দ্রযান। চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছায় পাঁচই আগস্ট এবং ১৭ আগস্ট প্রপালশন মডিউল থেকে পৃথক হয়ে যায় ল্যান্ডার বিক্রম। ২৩ আগস্ট ল্যান্ডারটি চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে অবতরণ করে। এর আগে, ২০১৯ সালে, চন্দ্রযান-২ সফট ল্যান্ডিং-এ ব্যর্থ হয়েছিল।
ডিসেম্বর মাসে, ইসরো সফল চন্দ্রাভিযানের জন্য আইল্যান্ডের হুসাভিকে অবস্থিত ‘এক্সপ্লোরেশন মিউজিয়ম’-এর পক্ষ থেকে ‘লেইফ এরিক্সন লুনার প্রাইজ’ পেয়েছে।
বিধানসভা নির্বাচন
গত বছর হিমাচল প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের পর এ বছর ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, কর্ণাটক, মিজোরাম, ছত্তিশগড়, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানায় ভোট হয়।
ত্রিপুরায় জেতে বিজেপি, মেঘালয়ে সরকার গঠন করে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন মেঘালয়া ডেমক্রেটিক অ্যালায়েন্স, নাগাল্যান্ডের বিজেপির সঙ্গে জোটে জেতে ‘ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি।
অন্যদিকে মে মাসে কর্ণাটকে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জয়ী হয়। নভেম্বরে তেলেঙ্গানাতেও একই ছবি দেখা যায়।
যদিও ছত্তিশগড়, মধ্য প্রদেশ ও রাজস্থানে জয়ী হয় বিজেপি। ওই মাসেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়- এই তিন রাজ্যের মধ্যে প্রথমটি ছাড়া বাকি দুটিতেই আবার কংগ্রেসকে হটিয়ে সরকার গঠন করছে বিজেপি।
তিনটি হিন্দিভাষী রাজ্যেই বিজেপি-র জয়ের কৃতিত্বও তাদের নেতা নরেন্দ্র মোদীকেই দিয়েছে তাঁর দল।ভারতে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি থাকতে ‘সেমিফাইনালে’ এই জয় গেরুয়া শিবিরের আত্মবিশাস দৃঢ় করেছে।
অন্যদিকে, এই তিন রাজ্যে ভরাডুবির পর কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে সরব হয়েছে ‘ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের’ শরিক দলগুলি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ফলাফল এবং ‘ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের’ অভ্যন্তরীণ গোলযোগ আসন্ন লোকসভা ভোটে মোদী সরকারের জয়ের ইঙ্গিত।