- Author, মরিয়ম সুলতানা
- Role, বিবিসি নিউজ বাংলা
-
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হওয়া গভীর নিম্মচাপটি উপকূলের দিকে আরো এগিয়ে আসছে। নিম্নচাপের প্রভাবে সাগর আরও উত্তাল হয়ে ওঠায় এক নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে, তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি মোকাবিলায় সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা এই ছয়টি জেলায় বিশেষ প্রস্তুতির নির্দেশ দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান।
তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে স্থানীয় প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপটি শনিবার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এরপর রোববার মধ্যরাতের দিকে এটি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে আভাস দিচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এখন মনে হচ্ছে রোববার মধ্যরাত। কিন্তু অনেক সময় ঘূর্ণিঝড়ের গতি বেড়ে যেতে পারে, অনেক দ্রুততার সাথে সে উপকূলের দিকে আসতে পারে। এ ধরনের বেশ কিছু বিষয় আছে।”
এই গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার পর এর নাম হবে ‘রেমাল’। রেমাল একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ– বালি। এটি ওমানের দেয়া নাম।
তবে, রেমাল নামে আফগানিস্তানে একটি শহর আছে। সেই শহরের নামানুসারেই এটির নামকরণ করা হয়েছে বলে এর আগে বিবিসিকে জানিয়েছিলেন মি. ফারুক।
গতিবেগ কত হবে?
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, রেমাল একটি “প্রবল ঘূর্ণিঝড়” হতে পারে।
সেক্ষেত্রে, এই ঘূর্ণিঝড়টি সর্বপ্রথম যেখানে আঘাত হানবে, সেখানের বাতাসের গতিবেশ ঘণ্টায় ১২০-১৩০ কিলোমিটার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা ২৬ দশমিক পাঁচ বা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে, তখন ঘূর্ণিঝড়ের পরিবেশ তৈরি হয়।
এখন, যদি কোনও নিম্নচাপ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার গতিবেগ অর্জন করে, তখন সেটাকে আঞ্চলিক ঝড় বলে মনে করা হয়।
কিন্তু সেটি যদি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১৯ কিলোমিটার গতিবেগ অর্জন করে, তখন সেটিকে সিভিয়ার সাইক্লোন বা প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলা হয়।
বাতাসের গতিবেগ যদি এর থেকেও বেশি হয়, তখন তা ‘ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোন’ বা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। এর পরের ধাপ হল সুপার সাইক্লোন।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে আঘাত হানা সর্বশেষ সুপার সাইক্লোন ছিল ২০০৭ সালের সিডর (চোখ)। এটির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার। তখন ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিলো।
রেমাল-এর গতিবেগ সম্বন্ধে আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, “সিডরের মতো অত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় না এটি, ঘূর্ণিঝড় রেমাল সিডরের থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল।”
কোথায় আঘাত হানবে?
শনিবারে প্রকাশিত আবহাওয়ার সর্বশেষ বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে (ক্রমিক নম্বর ৬) বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটির অবস্থান সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
এটি ২৫শে মে সকাল নয়টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্ধর থেকে ৪৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিলো।
তবে এটি উত্তরপূর্বদিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হতে পারে। ওই সময় পর্যন্ত গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মাঝে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।
এছাড়া, কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল থাকায় দেশের সকল সমুদ্রবন্দরে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
এখন, আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্তমানে যেই অবস্থান দেখাচ্ছে তাতে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি বাংলাদেশের ওপর দিয়েই অতিক্রম করার সম্ভাবনা আছে।
তবে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা এবং বরিশালের পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা জেলায় রেমাল-এর আঘাত হানার সম্ভাবনা বেশি বলে জানান মি. ফারুক।
বৃষ্টিপাত ও জলোচ্ছ্বাস
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ‘মনসুন’ (বর্ষা মৌসুম) শুরুর ঠিক আগে আগে আর্দ্রতা অনেক বেশি থাকে। ফলে এই সময় কোনও ঘূর্ণিঝড় দেখা দিলে তার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেশি হয় এবং বায়ুতাড়িত জ্বলোচ্ছাস সৃষ্টি হয়।
কিন্তু এবার সেই সম্ভাবনা আরও বেশি। কারণ “পূর্ণিমার সময় জোয়ার বেশি থাকে।”
“এটি যদি জোয়ারের সময়ে আঘাত হানে, তাহলে জলোচ্ছ্বাস বেশি হবে। আর যেহেতু এটি ‘সিভিয়ার সাইক্লোন’ আকারে আঘাত করার সম্ভাবনা আছে, তাই বৃষ্টির পরিমাণও বেশি থাকবে,” বলেন আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক।
আবহাওয়া অফিস ইতোমধ্যে তাদের পূর্বাভাসে বলেছে যে শনিবার সকাল থেকে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
তবে রোববার সকালে দেশের সকল বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তবে রেমাল-এর ফলে কতটুকু উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে জানতে চাইলে মি. ফারুক জানান, “রেমাল অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় না, প্রবল ঘূর্ণিঝড়। আর প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাধারণত তিন থেকে সাত ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে।”
গতিপথ বদলে যেতে পারে?
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত কয়েকদিন ধরেই ভ্যাপসা গরম পড়েছে। আর এই ভ্যাপসা গরম অনুভূত হওয়ার সাথে ঘূর্ণিঝড়ের সম্পর্ক আছে।
আবহাওবিদ ওমর ফারুক জানান, যখন বঙ্গোপসাগরে কোনও ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন স্থলভাগের সব মেঘ ঘূর্ণিঝড়ের আশেপাশে চলে যায়।
“কোনও স্থান মেঘমালা শূন্য হয়ে গেলে ভ্যাপসা গরম লাগে। এক্ষেত্রে যেদিকে ভ্যাপসা গরম লাগে, ঘূর্ণিঝড়টির সেদিকে যাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “যেখানে ভ্যাপসা গরম থাকে, সেখানে ধরে নিতে হবে যে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আর জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে গেলে সেখানে বায়ুরচাপ কমে যায়। এবং, বায়ুরচাপ কমে গেলে…যেদিকে বাতাসের চাপ কমে যাবে, ঘূর্ণিঝড়টি সেদিকে যায়। ভ্যাপসা গরম আসলে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব লক্ষণ।”
বাংলাদেশের কিছু কিছু স্থানের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাপপ্রবাহের সাথে সাথে “বেশিরভাগ জায়গায়ই এখন অস্বাভাবিক গরম আছে। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়ের ‘মুভমেন্ট’ বাংলাদেশের দিকে হতে পারে বলে ধারণা করা যায়।”
তবে পরিস্থিতি বদলালে ঘূর্ণিঝড় রেমাল-এর ‘মুভমেন্ট’-এও বদল আসতে পারে।
এর কারণ, বাংলাদেশে এখন যেরকম ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিকেও একইরকম গরম আছে।
“এখন বায়ুর চাপ যদি বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে বেশি কমে যায়, তাহলে ঘূর্ণিঝড় তার গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলতে পারে,” তিনি যোগ করেন।
যেসব ধাপ পার হয়ে ঘূর্ণিঝড় হয়
ঘূর্ণিঝড় হলো সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচণ্ড ঘূর্ণি বাতাস সংবলিত আবহাওয়ার একটি নিম্নচাপ প্রক্রিয়া।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় হতে হলে প্রথমে সাগরে লঘু চাপ তৈরি হয়। প্রতি ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ যখন ১৭ কিলোমিটার থাকে এবং বায়ুর চাপ কম থাকে তখন একে লঘু চাপ বলা হয়।
বাতাসে যদি ঘুর্নন তৈরি হয়, অর্থাৎ ঘূর্ণিবায়ুর আবর্তন তৈরি হলে সেখানে বায়ুর চাপ কমে যায়। কারণ আশেপাশে থেকে জলীয় বাষ্প আসে। জলীয় বাষ্প আসলে বায়ুর চাপ কমে যায়।
এরপরের ধাপে রয়েছে সুস্পষ্ট লঘুচাপ।
এর আগে আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ লঘুচাপ শক্তির মাত্রা অর্জন করে ৩১ থেকে ৪০ কিমি প্রতি ঘন্টায় বাতাসের বেগ থাকলে একে সুস্পষ্ট লঘুচাপ বলা হয়। অর্থাৎ লঘুচাপ আরো শক্তিমাত্রা অর্জন করে সুস্পষ্ট লঘুচাপে রূপ নেয়”
তৃতীয় ধাপে রয়েছে সাগরে নিম্নচাপ তৈরি হওয়া।
মি. মল্লিক বলেন, “সুস্পষ্ট লঘুচাপ আরো শক্তিমাত্রা অর্জন করে তৈরি হয় নিম্নচাপ। এরপর নিম্নচাপ আরো শক্তিমাত্রা অর্জন করে তৈরি হয় গভীর নিম্নচাপ”।
পরে এটা সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। তবে এই আবহাওয়াবিদ বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক ধাপই হচ্ছে সাগরে নিম্নচাপ তৈরি হওয়া।