শত কষ্টেও হাদিস সংরক্ষণে নিবেদিত ছিলেন যাঁরা

 

ইসলামী শরিয়তের উৎস হিসেবে পবিত্র কোরআনের পর রাসুল (সা.)-এর হাদিস দলিল হিসেবে সুপ্রমাণিত। তাই আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে সাহাবায়ে কেরামসহ এমন কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে হাদিস সংরক্ষণ করেছেন, যাঁরা শত কষ্ট, বাধা-বিপত্তি, দারিদ্র্য ও বিভিন্ন প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শাস্ত্রীয় মান বিচারে বিশুদ্ধ হাদিস উম্মাহর সামনে রেখে গেছেন। আজকের লেখায় দারিদ্র্যপীড়িত যুগশ্রেষ্ঠ চার মুহাদ্দিসের সংগ্রামী জীবন তুলে ধরা হলো—

বিখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) : দারিদ্র্যপীড়িত সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস নবীজির প্রিয় সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.)। সপ্তম হিজরিতে ইসলাম গ্রহণের পর আসহাবে সুফফার নিয়মিত ছাত্র হন তিনি। সব সাহাবির মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি নবীজির হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং মুখস্থ করেছেন।

প্রখর মেধাসম্পন্ন বিখ্যাত এই সাহাবি হাদিস ছুটে যাওয়ার ভয়ে কখনো নবীজির সঙ্গ ছাড়েননি। ফলে অনেক সময় এমন হয়েছে, ক্ষুধা ও অভুক্ত থাকার কারণে তিনি হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছিলেন। সহিহ বুখারির এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, ‘আমার মুহাজির ভাইয়েরা বাজারে কেনাবেচায় এবং আমার আনসার ভাইয়েরা জমিজমার কাজে মশগুল থাকত। তখন আমি (অভুক্ত থেকে) তুষ্ট থেকে আল্লাহর রাসুলের সঙ্গে লেগে থাকতাম। তাই তারা যখন উপস্থিত থাকত না, তখন আমি উপস্থিত থাকতাম। এবং তারা যা আয়ত্ত করত না, আমি তা আয়ত্ত রাখতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ১১৮)

ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) : হানাফি মাজহাবের ভাষ্যকার ও বিশিষ্ট ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)। তাঁর নাম ইয়াকুব। উপনাম আবু ইউসুফ। উপাধি কাজিউল কুজাত। ১১৩ হিজরিতে ইরাকের কুফা নগরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন।

বিখ্যাত এই ইমামের জীবনী পড়লে দেখা যায়, তিনি খুবই স্বাভাবিক ও অসচ্ছল অবস্থায় পড়ালেখা করেছেন। দারিদ্র্যপীড়িত ছাত্রজীবনের কথা তিনি নিজেই তুলে ধরেছেন, ‘আমি খুবই অসচ্ছল ও দরিদ্র অবস্থায় পড়াশোনা শুরু করি। প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে সে সময়ের বড় মুহাদ্দিস, ফকিহ, বিখ্যাত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর কাছে হাদিস ও ফিকহ অর্জনের জন্য তাঁর ছাত্রত্ব গ্রহণ করি। শুরু থেকেই আমি নিয়মিত নির্ধারিত সময়ে ক্লাসে উপস্থিত হতাম। কিন্তু একদিন জীবিকা উপার্জনের ব্যস্ততায় আমি যথাসময়ে ক্লাসে উপস্থিত হতে পারিনি। পরে আমার প্রিয় উস্তাদ ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ক্লাসে অনুপস্থিত হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে আমার দারিদ্র্যের বিষয়টি জানতে পারেন। এরপর তিনি আমাকে ১০০ দিরহামের একটি চেক উপহার দিয়ে বলেন, এগুলো দিয়ে তুমি তোমার প্রয়োজন পূরণ করবে। শেষ হলে আবার আমাকে জানাবে। এভাবেই আমি আমার উস্তাদের খরচে হাদিস ও ফিকহের পড়াশোনা শেষ করি।’ (মানাকিবে আবু হানিফা : ১/৪৬৯)

নাসিরুল হাদিস ইমাম শাফেয়ি (রহ.) : নাম মুহাম্মদ, উপনাম আবু আবদুল্লাহ, মাতার নাম উম্মুল হাসান।  পিতার নাম ইদরিস, তাঁর পূর্বপুরুষ শাফেয়ির নামানুসারে তিনি শাফেয়ি নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেন। ১৫০ হিজরি মোতাবেক ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিনের আসকালান প্রদেশের গাজা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। দুই বছর বয়সের সময় তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। ফলে জীবনের সূচনা হয় দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। তবে দারিদ্র্যের এই প্রতিকূলতা তাঁর সফল জীবনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি; বরং বাল্যকাল থেকেই তিনি  দ্বিনি ইলম শেখার বিভিন্ন মাধ্যম গ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবনের সংগ্রামের কথা তিনি এভাবে তুলে ধরেন, ‘ছোট থেকেই ইলমে দ্বিনের প্রতি আমার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। কিন্তু শৈশবে বাবা হারানো ও দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখার খরচ ও শিক্ষকের বেতন দেওয়ার মতো কোনো কিছুই আমাদের ছিল না। তাই মক্তবের ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা যখন পড়ত তখন আমিও শুনে শুনে তাদের সঙ্গে পড়তাম। এবং তারা যখন লিখত আমিও সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে লিখে মুখস্থ করে ফেলতাম। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য অর্থাভাবে আমার কোনো শিক্ষা উপকরণ ছিল না। তাই ভাঙা মাটির পাত্র, খেজুরের শুকনো পাতা ও উটের কাঁধের হাড় কুড়িয়ে শায়খদের থেকে শোনা হাদিস লিপিবদ্ধ করে মুখস্থ করতাম। এমনকি বিভিন্ন দপ্তর, অফিস ও বৈঠকখানায় গিয়ে লোকদের থেকে কাগজের উপরিভাগ চেয়ে নিতাম। হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাতেও হাদিস লিপিবদ্ধ করে সযত্নে কলসিতে ভরে রাখতাম। একপর্যায়ে আমার হাদিস লেখার কাগজগুলো দ্বারা আমার মায়ের বড় বড় কলসি ভরে গেল।’ (মানাকিবে শাফেয়ি : ১/৯৫)

মুহাদ্দিস আবুল ওয়ালিদ বাজি (রহ.) : ৪০৩ হিজরি সনে তিনি বাতাল ইউসে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষে হাদিসের উচ্চ ডিগ্রি অর্জনের জন্য উন্দুলুসের পথে যাত্রা শুরু করেন। স্বল্প পুঁজিতে যাত্রা শুরু করাতে পথিমধ্যেই অর্থের প্রয়োজন পড়ে। ফলে বাগদাদে অনেক দিন পর্যন্ত তিনি প্রহরী ও শ্রমিকের কাজ করেন। পাশাপাশি এই পারিশ্রমিক দিয়ে তিনি লেখাপড়ার খরচের ব্যবস্থা করেন। অতঃপর উন্দুলুস শহরে পৌঁছালে তাঁর আর্থিক অবস্থা আরো শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তিনি তখন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে স্বর্ণের মাধ্যমে জুতা তৈরির কারখানায় হাতুড়ি দিয়ে স্বর্ণ ভাঙার কাজ শুরু করেন।

তাঁর একজন নির্ভরযোগ্য ছাত্র বর্ণনা করেন, ‘তিনি যখন হাদিসের দরসে উপস্থিত হতেন। তখন আমরা তাঁর হাতে হাতুড়ির আঘাত ও শ্রমের চিহ্ন দেখতে পেতাম।’ (তারতিবুল মাদারেক : ৪/৮০৪)

এভাবেই তাঁরা দারিদ্র্য জয় করে পৃথিবীখ্যাত হাদিসবিদ হন।

 

সূত্র: কালের কন্ঠ

এই পোস্টটি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে ফেইসবুক পেজটি লাইক দিন এবং এই রকম আরো খবরের এলার্ট পেতে থাকুন

 আরো পড়তে পারেন:  

Loading...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *