দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল বাংলাদেশে গরুর মাংস রফতানিতে আগ্রহী হলেও বাংলাদেশ চাইছে জীবন্ত গরু আমদানির সুযোগ। পাশাপাশি ব্রাজিল যেন তাদের বাজারে তৈরি পোশাক ও পাটের শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা দেয়, বাংলাদেশ সেই দাবিও জানাচ্ছে।
রোববার ঢাকা সফররত ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরোর সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর বৈঠকে এসব বিষয়ই উঠে এসেছে।
রোববার সকালে ঢাকায় এসে বিকেলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন মাউরো ভিয়েরো। ওই বৈঠকে কারিগরি সহযোগিতা বিষয়ক একটি চুক্তি ছাড়াও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এটাই বাংলাদেশে ব্রাজিলের কোনও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর।
বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী জুলাইয়ে ব্রাজিল সফরে যাবেন এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট ‘ব্রিকসে’র সদস্য পদ লাভের ক্ষেত্রে ব্রাজিল বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ওই জোটটিতে যোগ দিতে গত অগাস্টে নতুন ছয়টি দেশ আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশ পায়নি। তবে বাংলাদেশ ব্রিকস ব্যাংকের সদস্য হয়েছে আগেই।
ব্রাজিল আগে থেকেই বাংলাদেশে স্বল্পমূল্যে মাংসজাত পণ্য, বিশেষ করে গরুর মাংস রফতানির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে আসছিল। তবে ঢাকায় মি. ভিয়েরোর সাথে সাক্ষাতের পর বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন মাংসজাত পণ্য নয়, বরং ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি করতে চায় বাংলাদেশ।
“ব্রাজিল কম দামে মাংস উৎপাদন ও রফতানি করতে পারে। সে বিষয়ে তারা বলেছে। কোরবানি সামনে রেখে আমি বলেছি সস্তা হলে লাইভ ক্যাটল (জীবন্ত গরু) আনার ব্যবস্থা করা যায় কি না। তারা দেখবে বলেছে”, বলছিলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন ব্রাজিলের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করা গেলে দক্ষিণ আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দেশের বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে বাংলাদেশের জন্য।
“ব্রাজিল অনেক বড় অর্থনীতির দেশ এবং এর বিশাল বাজারে ঢোকার সুযোগ পেলে বাংলাদেশ লাভবানই হবে। এটি এতদিন উপেক্ষিতই ছিলো”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ব্রাজিলে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান।
আর অর্থনীতিবিদ ডঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন দূরত্বজনিত কারণে বাণিজ্যে খরচ বৃদ্ধি সহ কিছু চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিলের বাজারের মাধ্যমে দক্ষিণ আমেরিকার অন্য বাজারগুলোতেও যেতে পারবে বাংলাদেশ।
গরুর মাংস কেন আলোচনায়
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে গত কয়েক মাস ধরেই আলোচনায় আছে গরুর মাংসের দাম।
অনেকেই অভিযোগ করেন ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ থাকার সুযোগে গরুর মাংসের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে এক শ্রেণির বিক্রেতা।
এই নিয়ে শোরগোলের মধ্যেই খবর বেরোয় যে বাংলাদেশে মাংসজাত পণ্য হিসেবে গরুর মাংস রফতানির প্রস্তাব দিয়ে ব্রাজিল বলছে তারা কেজি প্রতি পাঁচশ টাকারও কম দামে গরুর মাংস সরবরাহ করতে পারবে।
আজ ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর বক্তব্যেও এর সত্যতা বেরিয়ে এসেছে।
তবে তিনি বলেছেন মাংস নয় বরং কোরবানি ঈদ সামনে রেখে জীবন্ত গরুই আমদানি করতে চাইছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেছেন গরু বা মাংস নিয়ে আলোচনাটি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
“আমাদের এখানে প্রাণীজ আমিষ রেস্ট্রিকটেড। পোল্ট্রি ও অন্য মাংস আমরা আমদানি করি না। এখন বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদন হলে দাম, হেলথ সার্টিফিকেশন, লাইসেন্সিং-সহ অন্য বিষয়ে আলোচনা হবে”, ব্রিফিংয়ে বলেছেন তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান দু বছর ব্রাজিলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। মি. রহমান বলছেন যে কৃষি ও পশু, এই দুই খাতে ব্রাজিল অনেকটা বিপ্লব করে ফেলেছে।
“এক সময় তারাও আমদানি করত। কিন্তু গরুর জেনেটিক বিবর্তনে দারুণ সফল হয়ে দেশটি এখন গরুর দুধ ও মাংস উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ দেশ। তাদের এই প্রযুক্তি বাংলাদেশ আনতে পারলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব হবে”, বলছিলেন তিনি।
মূলত কৃষি ও পশু খাতে নজিরবিহীন সাফল্যের কারণেই ব্রাজিলকে অনেকে এখন বিশ্বের ‘ফুড বাস্কেট’ হিসেবে অভিহিত করেন। ব্রাজিল গত বছর চীন ও হংকং-সহ বিশ্বের ১২৬টি দেশে গরুর মাংস রফতানি করেছে।
তবে বাংলাদেশে কিছু বড় ব্যবসায়ী গরুর মাংস ব্যবসায় (খামার ও মাংসজাত পণ্য) বিনিয়োগ করেছেন গত এক দশকে। গরু কিংবা মাংস আমদানির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান থাকায় সরাসরি মাংস আমদানির দিকে খুব একটা আগ্রহী নয় বাংলাদেশ।
তৈরি পোশাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য বাংলাদেশ ব্রাজিলের বাজারে রফতানি করতে পারছে না কিছু বিধিনিষেধের কারণে। ব্রাজিল সেসব বিধি নিষেধ সরাতে বাংলাদেশে মাংস রফতানিতে জোর দিতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান বলছেন, বাংলাদেশ মাংস আমদানির ওপর যে বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছে সেটা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার রুলসের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করে ব্রাজিল, যদিও বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে সেটি তারা ডব্লিউটিএ ফোরামে তোলেনি।
“এখন দু’পক্ষ আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে”, বলছিলেন তিনি।
বাণিজ্যে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতটা
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কয়েকদিন আগেই জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ এখন ব্রাজিল থেকে মূলত ভোজ্য তেল-সহ কিছু পণ্য আমদানি করে। ভোজ্য তেল ছাড়া চিনি ও তুলাই প্রধানত বাংলাদেশ সেখান থেকে আমদানি করে থাকে।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্রাজিল থেকে ২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আর রফতানি করেছে মাত্র ১৭৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
এর মধ্যে ব্রাজিল থেকে তুলা আমদানিতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
রোববার সন্ধ্যায় ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর মি. মাহমুদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে বৈঠকে তিনি তুলা আমদানি বাড়ানো ছাড়াও ব্রাজিলে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর কথা বলেছেন।
এছাড়া স্পেশাল ইকনোমিক জোনে ব্রাজিলের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করতে আহবান জানিয়েছেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান বলছেন ব্রাজিলের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে পারলে বাংলাদেশের উপকৃত হবার সুযোগ রয়েছে।
বিশেষ করে পশুসম্পদের ‘ভ্যারাইটি প্রযুক্তি’ এনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাজে লাগিয়ে দুধ ও মাংস উৎপাদন অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ভারত অনেক দিন ধরেই ব্রাজিলিয়ান গরুর সিমেন আমদানি করে থাকে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে তিনিও তৈরি পোশাক ও পাট রফতানির জন্য ডিউটি ফ্রি অ্যাকসেস অর্থাৎ শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছেন।
প্রসঙ্গত, এখন ৩০-৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাককে ব্রাজিলের বাজারে যেতে হয়।
তবে বিশ্লেষক, কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন দুটি বিষয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা অনেক বেশি। এগুলো হলো তৈরি পোশাক খাত ও ঔষধ।
এছাড়া বাংলাদেশে সরকার যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে সেখানে ব্রাজিল বিনিয়োগ করলে দূরত্ব জনিত পরিবহন খরচ অনেকাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ব্রাজিল-সহ দক্ষিণ আমেরিকার আরও কয়েকটি দেশের সাথে বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করতে আগ্রহী এবং এটি হলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান।
সাবেক রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান আবার বলছেন ব্রাজিলের ঔষধের বাজার প্রায় ত্রিশ বিলিয়ন ডলারের এবং এর মধ্যে দশ বিলিয়ন ডলারের মতো তারা আমদানি করে।
“এটিই বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনার জায়গা। ইতোমধ্যে বড় দুটি কোম্পানি ওই বাজারে গেছে। আরও অনেক সুযোগ আছে, যা বাংলাদেশের নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে”, বলছিলেন তিনি।
অন্য দিকে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে ব্রাজিল কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করে রাখায় বাংলাদেশ চাইলেও রফতানি বাড়াতে পারছে না। এর আগেও সরকারি পর্যায়ে ব্রাজিলের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ।
“এই বিধিনিষেধের দেওয়ালটা ভাঙ্গা দরকার। সেটা হলে আমরা ঢুকতে পারব। আমার মনে হয় তারা যদি পশু বা মাংস রফতানি করতে চায় বাংলাদেশ বলতেই পারে যে আমরা গার্মেন্ট এন্ট্রি চাই”, বলছিলেন মি. রহমান।
অবশ্য বাংলাদেশ যে মাংস আমদানি বন্ধ রেখেছে সেটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার রুলসের সাথে সাংঘর্ষিক, যা ব্রাজিল ইতোমধ্যেই নানাভাবে বলেছে।
এছাড়া ব্রিকস-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ফোরামে ব্রাজিল গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাণিজ্য ছাড়া তাদের অন্য কোনও ইস্যু না থাকাও বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির বলে মনে করা হয়।
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন ব্রাজিল অনেক দূরের দেশ হওয়াতে আমদানির ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়ার চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সেখানে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা আছে।
“ব্রাজিলে কিছু পণ্যের ওপর ট্যারিফ বিধিনিষেধ আছে। প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট করা গেলে শুল্ক সমস্যার সমাধান হবে। আর মনে রাখতে হবে যে ব্রাজিলের মার্কেটে ঢোকা মানে দক্ষিণ আমেরিকার অন্য বাজারে ঢোকার সুযোগ তৈরি হওয়া,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।