বয়স মাত্র কয়েক বছর, অথচ বিরল এক রোগের কারণে দেখতে বৃদ্ধ মানুষের মতো হয়ে যায় শিশুরা। অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাওয়ার এই রোগ প্রোজেরিয়ার নিরাময়যোগ্য কোনো চিকিৎসাও নেই।
বলিউডে ২০০৯ সালে ‘পা’ সিনেমার মুক্তির পর এই রোগটি বেশ আলোচনায় আসে। বাংলাদেশেও এই রোগটির অস্তিত্ব রয়েছে।
বাংলাদেশের মাগুরায় ২০১৬ সালে শিশু বায়জিদ শিকদারের মধ্যে এমন উপসর্গ দেখা গিয়েছিল। তখন তার বয়স মাত্র চার বছর থাকলেও দেখতে একজন বৃদ্ধ মানুষের মতোই ছিল সে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় বায়জিদ শিকদার।
এরপর ২০১৮ সালে হবিগঞ্জে ১১ বছর বয়সী নীতু আক্তারের মধ্যে প্রোজেরিয়ার উপসর্গ দেখা যায়। নীতু আক্তারের মা জ্যোৎস্না বেগম বিবিসি বাংলাকে জানান, বর্তমানে নীতুর বয়স ১৪ বছর। তবে আগের চেয়ে তার মেয়ের শারীরিক অবস্থা এখন আরো খারাপ হয়েছে।
এছাড়া সিলেটের জকিগঞ্জে আবদুর নূর, জয়পুরহাটে তুহিন ইসলাম রাজু ও সর্বশেষ চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে শাহাদাত হোসেন এই রোগে আক্রান্ত বলে খবর পাওয়া যায়।
কিন্তু প্রোজেরিয়া রোগটি আসলে কী এবং কেনই বা হয়?
প্রোজেরিয়া কী?
প্রোজেরিয়া হচ্ছে একটি অতি বিরল ও প্রাণঘাতী ‘দ্রুত বৃদ্ধ হওয়ার’ রোগ। প্রোজেরিয়া শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ প্রোজেরাস থেকে, যার অর্থ অপ্রাপ্তবয়স্ক বৃদ্ধ।
১৮৮৬ সালে চিকিৎসক ডা. জোনাথন হাচিনসন ও ১৮৯৭ সালে ডা. হ্যাস্টিং গিলফোর্ড এই রোগটি সম্পর্কে ধারণা দেন। তাদের নামানুসারে এই রোগটিকে হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রোজেরিয়া সিনড্রোম বলা হয়।
প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসা করানো না হলে এই রোগে আক্রান্ত প্রায় সব শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গড়ে সাড়ে চৌদ্দ বছর বয়সের মধ্যে মারা যায়।
সংস্থাটির মতে, প্রতি ৪০ থেকে ৮০ লাখ নবজাতকের মধ্যে মাত্র একজনের প্রোজেরিয়ার উপসর্গ থাকে। আর প্রতি এক কোটি ৮০ লক্ষ থেকে দুই কোটি জীবিত শিশুর মধ্যে একজন প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। সারা বিশ্বে প্রোজেরিয়া আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা আনুমানিক ৪০০ জন। যেকোনও লিঙ্গ বা বর্ণের শিশুরা এতে আক্রান্ত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, ওয়ার্নার সিনড্রোম নামে আরেক ধরনের প্রোজেরিয়া রয়েছে যা বয়ঃসন্ধিকালে বা কৈশোরে হয়ে থাকে এবং এর ফলে অকাল বার্ধক্য দেখা দেয়।
অট্টো ওয়ার্নার ১৯০৪ সালে প্রথম এই রোগটি বর্ণনা করেন বলে তার নামানুসারে একে ওয়ার্নার সিনড্রোম বলা হয়। এই রোগের কারণেও শারীরিক ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
বার্ধক্যে সাধারণত যেসব রোগ দেখা যায় যেমন, শরীর বুড়িয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অস্টেওপোরোসিস, স্ট্রোক ও ক্যান্সারের মতো রোগে অল্প বয়সেই আক্রান্ত হয় দেহ।
প্রোজেরিয়ার উপসর্গ কী?
প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, শিশু জন্মের সময় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও, সাধারণত এক বছর বয়সের মধ্যেই শিশুদের এই রোগের উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে।
একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব উপসর্গ দেখা দেয়, তার মধ্যে রয়েছে পেট কিংবা উরুর চামড়া টানটান হয়ে যাওয়া অথবা ফুলে যাওয়া, দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেমে যাওয়া।
প্রোজেরিয়ার অন্য প্রাথমিক উপসর্গের মধ্যে রয়েছে দেহের চর্বি কমে যাওয়া, চুল পড়া, চামড়ায় পরিবর্তন, জয়েন্ট বা হাড়ের সংযোগস্থল শক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে নড়াচড়া করতে অসুবিধা হওয়া, ইত্যাদি।
এতে আক্রান্ত শিশুদের গড় উচ্চতা ৪৯.২১ ইঞ্চি এবং গড় ওজন ২৫ কেজির মতো হয়ে থাকে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর হওয়া সত্ত্বেও প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা দেখতে অনেকটা একই রকমের হয়ে থাকে।
এক নজরে উপসর্গগুলো হলো-
- শরীরের বৃদ্ধি থেমে যাওয়া, ওজন কমা
- দেহে চর্বির অভাব বা শুধু ত্বকের নিচে জমা হওয়া
- মুখের তুলনায় মাথা বড় হয়ে যাওয়া
- ছোট চোয়াল, চিবুক, মুখ ও পাতলা ঠোঁট
- চিকন, বাঁকানো নাক যা দেখতে অনেকটা পাখির ঠোঁটের মতো মনে হয়
- চোখ ও চোখের পাতা বড় হওয়া
- চুল পড়ে যাওয়া, অনেক সময় চোখের পাপড়ি ও ভ্রু পড়ে যাওয়া
- পাতলা, দাগযুক্ত ও ঝুলে পড়া ত্বক
- ত্বকের উপর থেকেই শিরা দেখা যাওয়া
- দাঁত সুগঠিত না হওয়া বা অস্বাভাবিক গঠন
- অকাল বার্ধক্য
প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা বয়স বাড়ার সাথে সাথে এথেরোস্ক্লেরোসিস বা ধমনীতে চর্বি জমে গিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ও হৃদরোগের মতো রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
সাধারণত ৬০ বছর বা এর বেশি বয়সী মানুষ যে এথেরোস্ক্লেরোসিসে আক্রান্ত হয়, প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যেও একই রোগ দেখা যায়।
প্রোজেরিয়ার কারণ কী?
কোষের এক ধরনের পরিবর্তনের কারণে এই রোগ হয়। এতে দেহের কোষ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বয়োবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি দ্রুত হয়ে যায়।
প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, এলএমএনএ যা লামিন-এ নামে পরিচিত, সেই জিনের পরিবর্তনের কারণে প্রোজেরিয়া হয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হিউম্যান জিনম রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, লামিন-এ জিন মূলত দুই ধরনের প্রোটিন তৈরি করে- লামিন-এ ও লামিন-সি। এই দু’টি প্রোটিন কোষের নিউক্লিয়াসের মেমব্রেন বা পর্দার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
কিন্তু এই লামিন-এ জিন যদি অস্বাভাবিক ধরনের লামিন-এ প্রোটিন তৈরি করে তাহলে সেটি কোষের নিউক্লিয়াসের পর্দাকে অস্থিতিশীল করে তোলে; যার কারণে প্রোজেরিয়া দেখা দেয়।
অস্বাভাবিক লামিন-এ প্রোটিন, যার কারণে প্রোজেরিয়া হয়, তাকে বলা হয় প্রোজেরিন। এর প্রভাবে অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং শিশুরা প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রোজেরিয়ায় আক্রান্তদের দেহকোষ ছাড়াও স্বাভাবিক মানুষের দেহকোষেও প্রোজেরিন প্রোটিন জমতে থাকে।
প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশন বলছে, স্বাভাবিক মানুষের শরীরে প্রতি বছর তিন শতাংশ করে প্রোজেরিন প্রোটিন হৃদযন্ত্র ব্যবস্থার কোষগুলোর মধ্যে জমা হতে থাকে। কিন্তু প্রোজেরিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে এই হার অনেক বেশি থাকে।
ফলে প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা অল্প বয়সেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণেই প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত বেশিরভাগ শিশু মৃত্যুবরণ করে।
প্রোজেরিয়া কি পরিবারের অন্যদের হতে পারে?
প্রোজেরিয়া জিনগত রোগ হলেও, এটি বংশানুক্রমিক বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রোগ নয়।
প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রোজেরিয়া সিনড্রোম বা যেটি ক্লাসিক প্রোজেরিয়া হিসেবে পরিচিত, সেটি সাধারণত পরিবারের অন্য সদস্যের হয় না। কারণ জিনগত যে পরিবর্তনের কারণে প্রোজেরিয়া হয় তা অতি বিরল ঘটনা।
কিন্তু যেসব শিশুরা হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত নন বরং প্রোজেরিয়ার অন্য ধরনের আক্রান্ত, সেক্ষেত্রে এই রোগটি পরিবারের অন্যদের হতে পারে।
যে দম্পতির এর আগে প্রোজেরিয়া আক্রান্ত সন্তান নেই, তাদের এই রোগে আক্রান্ত সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা ৪০ বা ৮০ লাখের মধ্যে একটি।
আর যে দম্পতির এরইমধ্যে প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত সন্তান রয়েছে তাদের আবার এই রোগে আক্রান্ত সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং তা দুই-তিন শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘মোজাইসিজম’ নামে এক ধরনের শারীরিক অবস্থার কারণে এই সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এর অর্থ হচ্ছে, ওই দম্পতির দেহকোষে প্রোজেরিয়া তৈরি হওয়ার মতো জিনগত পরিবর্তন অল্প পরিমাণে রয়েছে, তবে তারা প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত নন।
কীভাবে চিকিৎসা করা হয়?
এখন পর্যন্ত প্রোজেরিয়া নিরাময়ের কোনও চিকিৎসা নেই।
প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ওষুধ আবিষ্কার করা হয়েছে যেটি প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের কিছুটা উপশম দেয়। বিশেষ করে তাদের ওজন বাড়াতে, হাড়ের গঠনে ও হৃদযন্ত্র ব্যবস্থার উন্নয়নে এটি সাহায্য করে থাকে।
২০১৮ সালে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের এক জার্নালে বলা হয়, ওই ওষুধটি প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের আয়ু বাড়াতে সহায়তা করে।