বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর অনেকটা স্বস্তির বাতাস বইছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এবং দলটি আগামিকাল (শুক্রবার) থেকেই তাদের দলীয় প্রার্থী হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের কাছে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরুর ঘোষণা দিয়েছে।
উল্টো দিকে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে নানামুখী প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ মনে করছেন তফসিল ঘোষণা হলেও বৈশ্বিক চাপে সরকারকে নির্বাচনের আগেই একটি সমঝোতায় আসতে হবে।
আবার কারও ধারণা তফসিল ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগ যেভাবে চাইছে সেভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে এবং বিএনপি ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে গেলেও সেটি নির্বাচন কমিশনকে বিএনপি ছাড়াই নির্বাচন করা থেকে বিরত রাখতে পারবে কিনা, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে।
আবার তফসিল হলেই সবাই একযোগে মাঠে নেমে পড়বে বলে যে প্রচারণা চলছিলো বিএনপির ভেতরে গত কিছুদিন ধরে, তেমন কিছুও দেখা যায়নি রাজনীতির মাঠে।
এমন পরিস্থিতিতে দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে যেন কোন হতাশা না তৈরি হয় সেজন্য কর্মসূচির মাত্রা বাড়ানোর পন্থা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে।
তবে দলটির মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “হতাশার কোন সুযোগই নেই, কারণ সরকার এ নির্বাচন করতে পারবে না। আরও একবার একতরফা নির্বাচনের সুযোগ এ সরকার পাবে না।”
প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন আগামী সাতই জানুয়ারিতে ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে বুধবার। আওয়ামী লীগ এটিকে স্বাগত জানালেও বিএনপি এবং দলটির সাথে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো এ তফসিলকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে সংলাপের আহবান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে যে চিঠি দলগুলোকে দেয়া হয়েছে বিএনপি তার জবাব দিয়েছে আর আওয়ামী লীগও শিগগিরই এর আনুষ্ঠানিক জবাব দেবে। দলটি অবশ্য আগেই বলেছে যে তাদের পক্ষে সংলাপ এখন আর সম্ভব নয়।
তফসিল: বিএনপির প্রত্যাশা ও প্রতিক্রিয়া
ঢাকায় আটাশে অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে একের পর এক অবরোধের কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি।
এর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ আরও দৃশ্যমান হয়েছে। যদিও সম্প্রতি ভারতের দিক থেকে আসা কিছু বক্তব্য বিএনপিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
তবে আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা বহাল আছে। এরপর ধারাবাহিক আন্দোলন এবং সরকার বিরোধী দলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং পশ্চিমাদের চাপ – সব কিছু মিলিয়ে বিএনপির প্রায় সব স্তরের নেতাকর্মীদের একটি ধারণা হয়েছিলো যে নির্বাচন কমিশন হয়তো ‘একতরফাভাবে তফসিল’ ঘোষণা থেকে বিরত থাকবে।
বিশেষ করে সংলাপের জন্য দলগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের চিঠি দেয়ার পর দলের অভ্যন্তরে এমন ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছিলো যে ‘একতরফাভাবে তফসিল দিতে পারছে না নির্বাচন কমিশন’।
আবার দলের একটি অংশ এমন ধারণাও দিয়েছিলো যে নির্বাচন কমিশন ‘একতরফা তফসিল’ দিলে রাজপথে নেমে এসে প্রতিবাদ জানাবে আন্দোলনরত দলগুলো। তবে বাস্তবে সেটি দেখা যায় নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন যে তফসিল এখন না দিতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য হবে- এমন পরিস্থিতি বিএনপি কখনোই তৈরি করতে পারেনি।
“বিএনপির বড় প্রত্যাশার জায়গা ছিলো পশ্চিমাদের সংলাপের জন্য চাপ। কারণ তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছিলো যে আমেরিকা তফসিলের আগেই সংলাপের পক্ষপাতী ছিলো। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তফসিলটি হয়ে যাওয়ায় এখন সেটি আওয়ামী লীগের অনুকূলে গেছে, যা হয়তো বিএনপির অনেকের কাছে প্রত্যাশিত ছিলো না”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
রুহুল কবির রিজভী অবশ্য বলছেন তারা কারও দিকে তাকিয়ে নেই বরং জনগণকে নিয়েই আন্দোলন করছেন তারা।
“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলছে। সেটি সম্ভব হবে জনগণ ভোটের অধিকার পেলে এবং ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে পারলে। আমরা জনগণের সেই অধিকারটুকুই চাইছি।”
“আওয়ামী লীগ ইচ্ছে মতো নির্বাচন করে আগে পার পেলেও এবার পাবে না,” বলছিলেন তিনি।
বিএনপির এখন তাহলে কী করবে
নির্বাচনের তফসিল হয়ে গেছে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করবে জানতে চাইলে রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, “আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করবো। সরকার আগের মতো নির্বাচন করতে পারবে না এবং সেটিই আমরা নিশ্চিত করবো।”
কিন্তু কীভাবে সেটি হতে পারে তার কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দলটির নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে দলের একাংশের বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্র সামনে তাদের চাপ আরও বাড়াবে এবং এর ফলে তফসিল হলেও একতরফা নির্বাচনের সুযোগ শেষ পর্যন্ত সরকার পাবে না বলেই তাদের ধারণা।
মি. রিজভী বলছেন, “এখানে বিএনপি একা নয়। আরও অনেক দল আছে। ইসলামপন্থী দলগুলো আছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউই একতরফা নির্বাচন চায় না। তাই চাইলেই এখন আর আওয়ামী লীগ মর্জিমতো করে ফেলতে পারবে না।”
জোবাইদা নাসরীন বলছেন যে তফসিল হলেই নির্বাচনও হয়ে যাবে এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই এবং বাংলাদেশেও তফসিলের পর নির্বাচন বাতিলের উদাহরণ আছে।
“এটি বিএনপি-আওয়ামী লীগ সবাই জানে। তবে আমার মনে হয় বিএনপি তাকিয়ে আছে পশ্চিমাদের দিকে। কিন্তু পশ্চিমারা সবকিছু নিজের মতো করে করাতে পারবে তার তো নিশ্চয়তা নেই।”
“এখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিসেবে ভারতের ভূমিকাও তো গুরুত্বপূর্ণ,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ভারত সম্প্রতি দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ তুলে এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বলে জানিয়েছে।
এখন বিশ্লেষকদের ধারণা নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমারা যেমন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী অবস্থান নিয়েছে তেমনি উল্টো দিকে প্রতিবেশী ভারত আওয়ামী লীগ সরকারের দিকেই তাদের অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ ঠিক কতটা বাড়াতে পারবেন-তা নিয়েও নানা ধরনের আলোচনা আছে।
এসব কারণে অনেকে মনে করেন বিএনপির সামনে এখন দুটো পথ খোলা আছে। এগুলো হলো হয় যে কোনভাবে হোক নির্বাচন ঠেকানো অথবা দ্রুত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া।
“নির্বাচন ঠেকাতে হলে সহিংসতা করতে হবে। এর বিরুদ্ধে আবার যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির হুমকি আছে। আবার শুধু হরতাল অবরোধ দিয়ে এমন কোন পরিস্থিতি বিএনপি তৈরি করতে পারেনি যাতে সরকার দাবি মানতে বাধ্য হয়। এখন দেখার বিষয় হবে সামনে তারা কি কৌশল নেয়,” বলছিলেন জোবাইদা নাসরীন।
তিনি অবশ্য মনে করেন যে বিএনপি চাইছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করুক।
কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে নির্বাচন সংবিধানে থাকা নিয়ম অনুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই সম্পন্ন হবে – এক্ষেত্রে কোনও চাপ তারা গ্রহণ করতে রাজি নয়।